ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আলোচিত সাত খুনের ঘটনাক্রম

সাইফুল আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৬ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আলোচিত সাত খুনের ঘটনাক্রম

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রায় তিন বছর আগের ঘটনা। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি লাশ, পরদিন মেলে আরেকটি লাশ।

নিহত বাকিরা হলেন কাউন্সিলর নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম। এই সাতজনকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাটি আলোড়ন তুলেছিল সারাদেশে।

এই হত্যাকাণ্ডের পর উত্তেজিত জনতা সন্দেহভাজন কয়েকজনের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। ঘটনার এক দিন পর কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা (পরে বহিষ্কৃত) নূর হোসেনসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন।

এছাড়া আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় ১১ মে একই থানায় আরেকটি মামলা হয়। এই মামলার বাদী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল।

হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি আরেক কাউন্সিলর নুর হোসেন পালিয়ে গেলেও পরে ভারতে ধরা পড়েন। এরপর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই মামলায় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। কয়েকদফা শুনানির পর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক এ বছরের ১৬ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।

নির্ধারিত দিনেই সোমবার আদালত নূর হোসেন ও র‌্যাবের প্রাক্তন তিন কর্মকর্তাসহ ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন।

যেভাবে খুনের ঘটনা : ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিতে যান নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম। গাড়িতে করে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম এলাকা থেকে নজরুলসহ অপহৃত হন পাঁচজন। প্রায় একই সময়ে অপহৃত হন অপর এক গাড়িতে থাকা আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক।

এ ঘটনার পরদিন নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ছয়জনকে আসামি করে ফতুল্লা থানায় অপহরণের মামলা করেন। যেটি পরে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

নদী থেকে লাশ উদ্ধার :  অপরহরণের তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল বিকেলে বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া শান্তির নগর এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় নজরুল, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করা হয়। এর পরদিন একই জায়গায় মেলে নজরুলের আরেক বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশ। উদ্ধার করা সব লাশের পেটেই ছিল আঘাতের চিহ্ন।

এরপর উত্তেজিত জনতা ১ মে সকালে কাউন্সিলর নূর হোসেনের কার্যালয় এবং রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হাজি মো. ইয়াসিনের বাড়ি ভাংচুর ও কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।

৪ মে নজরুলের শ্বশুর অভিযোগ করেন, র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম এম রানা ও মেজর আরিফ হোসেন ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে এ সাতজনকে অপহরণের পর খুন করেন।

৭ মে চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে ফতুল্লা থানায় আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

১১ মে নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, সদস্য মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ও চন্দনের জামাতা বিজয় কুমার পালের রিট আবেদনে হাই কোর্ট তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। ১৫ মে রাতে মিলিটারি পুলিশের সহায়তায় ঢাকা সেনানিবাসের বাসভবন থেকে তারেক সাঈদ ও মেজর আরিফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ।

এর পরদিন রাতে নৌ-বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা এম এম রানাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশের কাছে তুলে দেন। এই তিন কর্মকর্তাকেই বাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়।

পালিয়ে যাওয়া সাত খুন মামলার প্রধান আসামী কাউন্সিলর নুর হোসেনকে ওই বছরের ১৪ জুন গভীর রাতে কলকাতার দমদম বিমানবন্দর সংলগ্ন বাগুইআটি থানা পুলিশ আটক করে। পরে ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তাকে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ওই বছরের ১৪ নভেম্বর তাকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠান।

৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন : চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৫ জনকে আসামি করে ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠন করে পুলিশ। এদের মধ্যে ২৫ জনই র‌্যাবের সদস্য। এই ৩৫ আসামীর মধ্যে গ্রেপ্তার হয় ২৩ জন। বাকী ১২ জন পলাতক রয়েছেন।

গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা ২৩ আসামি হলেন- চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহি আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দ বালা, করপোরাল রুহুল আমিন, এএসআই বজলুর রহমান, হাবিলদার নাসির উদ্দিন, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, সৈনিক নুরুজ্জামান, কনস্টেবল বাবুল হাসান ও সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, তাঁর সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী, মোর্তুজা জামান (চার্চিল) ও আবুল বাশার ।

মামলার পলাতক আসামিরা হলেন- করপোরাল মোখলেছুর রহমান, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সৈনিক আল আমিন, সার্জেন্ট এনামুল কবীর, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান এবং নূর হোসেনের সহযোগী সেলিম, সানাউল্লাহ ছানা, ম্যানেজার জামাল উদ্দিন ও ম্যানেজার শাহজাহান ।

গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের মধ্যে ২১ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলায় ১২৭ জনকে সাক্ষী করা হয়। তবে আদালত সাক্ষ্য নেন ১০৬ জনের ।

 

 

 

রাইজিংবিডি/১৬ জানুয়ারি ২০১৭/সাইফুল/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়