ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

আশ্বাস এবং শিক্ষকগণের অনশন ভঙ্গ

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪০, ১২ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আশ্বাস এবং শিক্ষকগণের অনশন ভঙ্গ

মাছুম বিল্লাহ : স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে গত ২৫জুন থেকে শিক্ষকগণ আমরণ অনশন করে আসছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত টানা আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে নন-এমপিও শিক্ষকগণ আন্দোলন থেকে সরে আসেন। তারা আশা করেছিলেন যে, বর্তমান অর্থবছরে এমপিওভুক্তির সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসবে। কিন্তু বাজেটে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় তারা পুনরায় আন্দোলনে নামেন।

নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি করা নিয়ে বহু আলোচনা, আন্দোলন, প্রস্তাবনা, আশ্বাস বহু বছর ধরেই চলছে কিন্তু কার্যকরী , রাজনীতি মুক্ত এবং রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর স্থায়ী ব্যবস্থা আজও গড়ে ওঠেনি। যখন যেখানে সুবিধা হয়েছে, সেখানে এমপিও দেওয়া হয়েছে কিংবা জাতীয়করণ করা হয়েছে। সঠিক কোন নিয়ম মেনে বিষয়গুলো করা হয়নি বলেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ রাজপথে আন্দোলনে নেমেছেন। তারা এ পর্যন্ত যা কিছু  অর্জন করেছেন তা সবই তাদের আন্দোলনের ফসল। তাই, এখনও চলছে তাদের আন্দোলন। আর সেই আন্দোলের পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার জারি করেছে এমপিও নীতিমালা-২০১৮। সদ্য জারি হওয়া নীতিমালা অনুযায়ী এমপিও পেতে কোন বিদ্যালয়কে প্রথমে আবেদন করতে হবে। এরপর তথ্য যাচাই বাছাই করে এমপিও দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে আবেদনের শর্ত হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সময়  শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ও উত্তীর্ণের সংখ্যাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে। এসব শর্ত মানতে হলে একশর বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও-র জন্য আবেদন করার যোগ্যতা থাকার কথা নয় বলে জানিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। ফলে তারা আমরণ অনশন শুরু করেন।

আগামী অর্থবছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিকরণের জন্য বরাদ্দ আছে কি নেই- এ নিয়ে বিভিন্ন কথা শোনা যাচ্ছে।  ফলে শিক্ষকদের আন্দোলন আরও জোরদার করা হয়েছে। শিক্ষকরা আন্দোলনে নামলে গত ১৪ জুন ঈদের আগের শেষ কর্মদিবসে জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ জারি করা হয়। এ অবস্থায় নতুন কোন প্রতিষ্ঠানকে এমপিও পেতে হলে এই নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। শিক্ষা সচিব বলেছেন, বাজেটে সব বিষয় উল্লেখ থাকে না। আবার একসঙ্গে সব প্রতিষ্ঠান এমপিও করাও সম্ভব নয়। এ জন্যই শর্ত সাপেক্ষে এমপিও দিতে এমপিও নীতিমালা-২০১৮ জারি করা হয়েছে।  এমপিও নিয়ে খোদ সরকারের মধ্যেই কিছুট অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। নন-এমপিও শিক্ষকরা আন্দোলনে নামার পর ঈদের আগে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি নিয়ে কাজ চলছে। এ নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। এদিকে একজন মন্ত্রী জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবাজেটের উপর আলোচনায় বলেন, ‘এমপিওভুক্তির কথা বলা হলেও বাজেটে কাগজে-কলমে কিছু দেখছি না। আল্লাহর ওয়াস্তে এমপিওভুক্তি করে দেন, তা না হলে আমাদের কষ্ট হচ্ছে।’ তিনি এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া চালু রাখারও অনুরোধ জানান। এখন কথা হলো, এমপিও না দিয়ে সাংসদদের কষ্ট হচ্ছে, কী ধরনের কষ্ট হচ্ছে তা তিনি উল্লেখ করেননি, তবে আমরা বুঝে নিতে পারি কি ধরনের কষ্ট হচ্ছে। এটি অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।

এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী, একটি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি পেতে হলে চারটি প্রধান শর্ত মানতে হবে। এগুলোর জন্য রাখা হয়েছে ১০০ নম্বর। এতে একাডেমিক স্বীকৃতির তারিখের জন্য রাখা হয়েছে ২৫ নম্বর। প্রতি দুই বছরের জন্য ৫ নম্বর এবং ১০ বা এর চেয়ে বেশি বছর হলে পাবে ২৫ নম্বর। শিক্ষার্থী সংখ্যার জন্য ২৫ নম্বর। আর শিক্ষার্থীর কাম্য সংখ্যা থাকলে ওই প্রতিষ্ঠান পাবে ১৫ নম্বর এবং পরবর্তী ১০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য পাবে ৫ নম্বর। পরীক্ষার্থী এবং উত্তীর্ণের সংখ্যায়ও শিক্ষার্থী সংখ্যার মতো একইভাবে নম্বর বন্টন করা হয়েছে। এমপিওভুক্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবকে আহবায়ক করে একটি কমিটি থাকবে, যারা বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করবে। এরপর ওই কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। সরকার এমপিওভুক্তির শর্ত পূরণ সাপেক্ষে আদেশ দিবে। কাম্য যোগ্যতা পূরণ করতে নীতিমালা অনুযায়ী সহশিক্ষা ও বালক প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় শহরে ২০০ ও মফস্বলে ১৫০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। মাধ্যমিকে শহরে ৩০০ ও মফস্বলে ২০০ শিক্ষার্থী থাকতে হবে। স্কুল অ্যান্ড কলেজে শহরে ৪৫০ ও মফস্বলে ৩২০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে শহরে ২০০ ও মফস্বলে ১৫০জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। স্নাতক পাস কলেজে শহরে ২৫০ ও মফস্বলে ২০০ শিক্ষার্থী থাকতে হবে। আর প্রতিটি শ্রেণির পরীক্ষায় শহরে ৬০ ও মফস্বলে ৪০ জন শিক্ষার্থীর অংশ নিতে হবে এবং তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে উত্তীর্ণ হতে হবে। একটি বেসরকারি নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার জন্য সর্বক্ষেত্রে এবং সব সময় উপরোক্ত নিয়মগুলো সঠিকভাবে পালন করা হলে সমস্যা হয়তো এতদূর গড়াতো না। কিন্তু অন্যান্য অনেক অলিখিত বিষয় বিবেচনায় নেওয়ায় এক্ষেত্রে অনেক দুর্নীতি হয়েছে যা মাননীয় অর্থমন্ত্রী মাঝে মাঝে উল্লেখ করে থাকেন।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিষ্টেম (ইএমআইএস) সেলের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী জানা যায় যে, দেশে বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। বর্তমানে সরকার স্বীকৃত নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার সংখ্যা ৫,২৪২টি। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৮০হাজারেরও বেশি শিক্ষক কর্মচারী কাজ করছেন। গত ১ জুলাই নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক  এবং সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে এমপিওভুক্তির বিষয়ে লিখিত প্রস্তাবনা দেন। তারা প্রস্তাবনায় বলেছেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে পর্যাপত অর্থ বরাদ্দ না থাকলেও সব নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান এমপিওর আওতায় এনে আংশিক বেতন চালু করতে হবে। পরবর্তী অর্থবছরে বেতন সমন্বয় করতে হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, দীর্ঘ ১৫-২০ বছর এমপিওভুক্ত না হওয়ায় অনেক নন-এমপিও  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই দুর্বল হয়ে  পড়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাই করার জন্য এমপিওভুক্তির পর তিন বছর সময় প্রদান করতে হবে। এই সময়কালে সক্ষমতা অর্জনে ব্যর্থ হলে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এই প্রস্তাবের আলোকে সারা দেশের সব নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে এমপিওভুক্ত করার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে। প্রস্তাবনাটি যুক্তিযুক্ত। দেশের অর্থ বিভিন্নখাতে বিভিন্নভাবে অপচয় হয় অথচ শিক্ষা আমরা যেনতেন প্রকারে চলতে  দিতে পারি না। একজন নাগরিককে সুশিক্ষা দান করলে সেই নাগরিক দেশের জন্য একটি সম্পদে পরিণত হবে। শিক্ষার পেছনের বিনিয়োগই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। এর রিটার্ন বা ফল যদিও একটু বিলম্বে আসে, তবু এই খাতে আমাদের উপযুক্ত বিনিয়োগ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হলে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টিও এগিয়ে নেওয়া যাবে। অর্থের অভাবে কোন প্রতিষ্ঠান ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে না, আবার ভালো বেতন না পেলে মানসম্মত শিক্ষক এই পেশায়  আসবে না। নাগরিকদের শিক্ষা দান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর রাষ্ট্রকে সেটি দায়িত্বশীলতার সাথে পালন করতে হয়। বর্তমানে শিক্ষার ক্ষেত্রে যা চলছে তা হচ্ছে শিক্ষার দায়িত্ব স্ব স্ব ব্যক্তির। নাগরিকগণ নিজ নিজ উদ্যোগে শিক্ষা গ্রহণ করবে। কোথা থেকে কীভাবে করবে রাষ্ট্র যেন তা দেখেও না দেখার ভান করতে চায়- এই অবস্থা চলতে দেওয়া ঠিক নয়।

মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা কি ব্যক্তি পর্যায়ে বা বেসরকারি পর্যায়ে চলবে? তাহলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী? এলাকায় এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে,  এটি  কমিউনিটির অবদান। কোন এলাকায় কি পরিমাণ প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন, কলেজ স্থাপন করা প্রয়োজন, জনসংখ্যা অনুপাতে কোন এলাকায় কি ধরনের এবং কতটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন সেগুলো নির্ধারণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্র সে দায়িত্ব গুরুত্ব দিয়ে পালন করেনি। তাই ব্যক্তি ও কমিউনিটির উদ্যোগে যত্রতত্র বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেখান প্রাথমিক স্কুল দরকার তিনটি সেখানে হয়তো আছে একটি, আবার যেখানে দরকার দুটি সেখানে হয়তো চারটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার প্রতি রাষ্ট্রের উদাসীনতা কিংবা রাজনীতি এজন্য দায়ী। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশাল এক মন্ত্রণালয়। এটি আবার দুইভাগে বিভক্ত। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এত বিশাল বহর জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলে অথচ রাষ্ট্রের মাধ্যমিক পর্যায়ে এখনও ৯৭ শতাংশ বিদ্যালয় পরিচালিত হয় বেসরকারি পর্যায়ে। যেনতেন প্রকারে চলছে শিক্ষাদান পদ্ধতি, মানের প্রশ্ন এখন সুদূর পরাহত। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় যেখানে রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত হওয়ার কথা, এই দুই পর্যায়ের শিক্ষা যেখানে জাতীয়করণ করা প্রয়োজন সেখানে আমরা সরকারি অনুদানকেও যদি বলি যে,  এ দ্বারা শিক্ষার কোন উপকার হয় না, তাহলে বিষয়টি খুব ভালো দেখায় না।

তবে এটি ভালো সংবাদ যে, শিক্ষকদের অনশন ভাঙাতে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা  রাশেদা কে চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী ও ড. সারওয়ার আলী জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ধর্মঘট স্থলে গিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন এমপিওভুক্তির সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। এজন্য মন্ত্রণালয়ে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যে সকল শিক্ষক এমপিওভুক্ত হবেন, তারা জুলাই মাস থেকেই বেতন প্রাপ্ত হবেন। আমরা আশাকরি মানুষ গড়ার কারিগরদের জাতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করবে।

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়