ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘আস্থাহীনতার’ কারণে প্রত্যাবাসনে অনীহা রোহিঙ্গাদের

সুজাউদ্দিন রুবেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৩, ২৪ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘আস্থাহীনতার’ কারণে প্রত্যাবাসনে অনীহা রোহিঙ্গাদের

কক্সবাজার প্রতিনিধি : মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তাসহ নাগরিক অধিকার নিশ্চিতের আস্থা অর্জিত না হওয়ায় রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনে রাজি হচ্ছে না; প্রত্যাবাসনের জন্য তৈরি সর্বশেষ তালিকাভুক্ত এবং তালিকার বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রত্যাবাসনের সর্বশেষ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য মূলত ‘আস্থাহীনতাকেই’ দায়ী করেছে এ সকল রোহিঙ্গা। এমনকি, রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ কেউ জোর করে পাঠিয়ে দেয়ার ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে্।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রত্যাবাসনের জন্য বিভিন্ন তথ্য সম্বলিত ২২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠায়। যাচাই বাছাই শেষে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সাড়ে ৩ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার চূড়ান্ত তালিকা বাংলাদেশের কাছে পাঠায়।

সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই মাসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নতুন করে উদ্যোগের অংশ হিসেবে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। দুই দিন ধরে ১৫ সদস্যের দলটি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা ও বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে রোহিঙ্গাদের তরফে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ও চলাফেরায় স্বাধীনতার দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।

এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের কাছে পাঠানো তালিকা ধরে মিয়ানমার ২২ আগস্ট দিনক্ষণ ঠিক করে প্রত্যাবাসন শুরুর। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হয়। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের প্রতিনিধি এবং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর যৌথভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের স্বীকৃতি দেয়া রোহিঙ্গাদের গত ২০ আগস্ট থেকে মতামত নেয়া শুরু করে।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা পর্যন্ত টেকনাফের নয়াপাড়া ২৪, ২৫ ও ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের তিন শতাধিক পরিবারের মতামত নেয়া হয়। মিয়ানমারের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে এসব পরিবারের কেউ রাজি হননি।

বৃহস্পতিবার দুপুরে টেকনাফের নয়াপাড়া ২৬ নম্বর ক্যাম্পে আয়োজিত এক প্রেস বিফ্রিংয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সার্বিক প্রস্তুতি থাকার পরও মিয়ানমারের স্বীকৃতি পাওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ যেতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি। 

এর আগে গত নভেম্বর মাসেও প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ঠিক করে সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেইবারও রোহিঙ্গারা যেতে অনীহা প্রকাশ করায় প্রত্যাবাসন আলোর মুখ দেখেনি।

এ নিয়ে প্রত্যাবাসনের রাজি না হওয়ার ব্যাপারে কথা হয় নয়াপাড়া ২৬ নম্বর ক্যাম্পের বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে। তাদের কেউ মিয়ানমারের স্বীকৃতি পাওয়া তালিকাভূক্ত, কেউ কেউ তালিকার বাইরের।

নয়াপাড়া ২৬ নম্বর ক্যাম্প ইনচার্জ কার্যালয়ের সামনে সড়কের পাশে রোহিঙ্গা মুদির দোকানদার জাফর আলম বলেন, মিয়ানমারের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তাসহ নাগরিক অধিকার নিশ্চিত না হওয়ায় রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে রাজি হচ্ছে না।

জাফর বলেন, দীর্ঘ বছর ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জাতিগত নির্যাতন নিপীড়নের শিকার। এ নিয়ে বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ ভিটেমাটি হারিয়েছে। রোহিঙ্গারা নাগরিক অধিকারসহ নানা বৈষম্য ও শোষণের শিকার।

তিনি বলেন, নাগরিকত্বের স্বীকৃতি, নিরাপত্তা, নির্যাতনের বিচার ও ভিটেমাটিসহ হারানো সম্পদ ফিরে পাওয়ার নিশ্চিয়তা পেলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তারা মিয়ানমার সরকারের জিন্মায় ফিরে যেতে রাজি নয়। কারণ মিয়ানমারের ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের ভয় রয়েছে।

এ জন্য শর্তপূরণ সাপেক্ষে প্রত্যাবাসনের পর ইউএনএইচসিআর এর তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে আশ্রয় দেয়ার নিশ্চিয়তা পেলে রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে বলে মন্তব্য করেন জাফর।

নয়াপাড়া ক্যাম্পের বাসিন্দা জাফর বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের স্বীকৃতি পাওয়া তালিকাভূক্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ কেউ জোর করে পাঠিয়ে দেয়ার ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। মূলত নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তাসহ নাগরিক অধিকারের নিশ্চিয়তা না পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের মনে ফিরে যেতে শংকা তৈরি হয়েছে।

জাফরের দোকানের রাস্তার বিপরীতে রোহিঙ্গা মুদির দোকারি ছুরত আলম প্রত্যাবাসনের তৈরি মিয়ানমারের স্বীকৃতি পাওয়া তালিকাভূক্তদের একজন। তিনি দোকানের সঙ্গে সংযুক্ত বাড়িতে বসবাস করেন।

জাফর জানালেন, প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের মতামত গ্রহণ শুরু হলে এবারে জোর করে পাঠিয়ে দেয়ার ভয় ধরে ছুরত আলমের (৫০)। এ কারণে প্রত্যাবাসনের নির্ধারিত দিনের আগেরদিন  (২১ আগস্ট) রাতে তিনি পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যান।

পরে বৃহস্পতিবার দুপুরে জাফরে তথ্যের সূত্র ধরে ছুরত আলমের দোকান ও বাড়িতে গিয়ে প্রতিবেদক তালাবদ্ধ দেখতে পায়।

একই কারণে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন নয়াপাড়া ২৬ নম্বর ক্যাম্পের ডি-ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ নুর (৫৫)। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে দরজায় তালাবদ্ধ।

মোহাম্মদ নুরের প্রতিবেশী খদিজা বেগম (৩৫) বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য মতামত গ্রহণ শুরু হওয়ার থেকে মোহাম্মদ নুরের পরিবারে জোর করে পাঠিয়ে দেয়ার ভয় তৈরি হয়। এ কারণে তিনিও বুধবার রাতে (প্রত্যাবাসনের আগেরদিন) পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যান।

প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমরের স্বীকৃতি পাওয়া তালিকাভূক্ত আব্দুল খালেক (৫২) নয়াপাড়া ২৬ নম্বর ক্যাম্পের ই-ব্লকের বাসিন্দা।

আব্দুল খালেক বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য মতামত গ্রহণকারী শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন এবং ইউএনএইচসিআর এর প্রতিনিধি দলের কাছে তিনি কথা বলেছেন। দলটির কাছে কেন মিয়ানমার ফিরতে চান না তা অবহিত করেছেন।

মিয়ানমারে ফিরে যেতে রোহিঙ্গাদের দেয়া শর্তগুলো পূরণের এখনো নিশ্চিয়তা না পাওয়ায় রোহিঙ্গারা রাজি হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভূক্ত এ রোহিঙ্গা।


রাইজিংবিডি/কক্সবাজার/২৪ আগস্ট ২০১৯/সুজাউদ্দিন রুবেল/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়