ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ইলিশ || তাপস রায়

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৮, ১২ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইলিশ || তাপস রায়

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

ইয়ামিনের ইলিশ মাছ খুব পছন্দ। সে ওই ইলিশের লোভেই ভোরের আলো না ফুটতেই নদীর ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সারারাত পদ্মায় ইলিশ ধরে এ সময় বাবা নৌকা নিয়ে ফেরে। পাড়ে ইয়ামিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাবা তাকে নৌকায় ডেকে নেন। তারপর বলেন, ‘ক দেহি, কোনডা তর পছন্দ?’

একসঙ্গে এত ইলিশ দেখে ইয়ামিনের ধাঁধা লেগে যায়। আগেপিছে না ভেবেই সে একটা ইলিশের দিকে আঙুল তুলে দেখালে ওই ইলিশ বাবা তার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘বাড়িত যা। মায়েরে কইবি সইরষা দিয়া রানতে।’

ইলিশ নিয়ে কাগজের প্লেনের মতো উড়তে উড়তে বাড়ির পথ ধরে ইয়ামিন। পথে হঠাৎ পুরনো বটগাছের নিচে আসতেই সে থমকে দাঁড়ায়। কে ডাকে? আশপাশে কাউকে দেখা যায় না। হেমন্তের সকাল কুয়াশাঘেরা। ইয়ামিন পা বাড়ায়। কিন্তু এবার সে আরো স্পষ্ট শুনতে পায় তার নাম। ইয়ামিন চোখ কচলে ভালোভাবে তাকাতেই বটগাছের নিচে এক বুড়িকে দেখতে পায়। সে খুব অবাক হয়- এই সাতসকালে বুড়ি এলো কোত্থেকে! তাকে এর আগে কখনও দেখেছে বলেও তার  মনে পড়ে না। ইয়ামিন একটু ভয়ে ভয়েই বুড়ির কাছে এগিয়ে যায়।  
‘আমারে ডাকছেন?’
‘হ, বাজান। আয়, কাছে আয়।’
ইয়ামিন এক পা এগিয়ে যেতেই কুয়াশা সরে গিয়ে স্পষ্ট হয় বুড়ির মুখ। একি!  বুড়ির এক চোখ রক্তজবার মতো ফুটে আছে কপালজুড়ে। এটুকু দেখেই ইয়ামিন যা বোঝার বুঝে ফেলে। সে ভীষণ ঘাবড়ে গেলেও জ্ঞান হারায় না। ইয়ামিন দ্রুত বাঁচার উপায় ভাবতে থাকে। তাকে চুপ থাকতে দেখে বুড়ি চিকন গলায় বলে, ‘অনেকদিন ইলিশ খাই না। আমায় দিবি?’

বুড়ি ইলিশের দিকে হাত বাড়াতেই ইয়ামিন উল্টো দিকে ঘুরে দৌড়াতে শুরু করে। এমন দৌড় এই জীবনে ইয়ামিন আর কখনও দেয়নি। দৌড়াতে দৌড়াতে সে ওসমান হুজুরের বাড়ির ভেতর ঢুকে পরে। আসলে হুজুরের বাড়ি ইয়ামিনদের বাড়ির পথেই। সুতরাং জীবন বাঁচাতে সে ওখানেই ঢুকে পড়ে। হুজুরের সামনে দাঁড়িয়ে ইয়ামিন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। ইয়ামিনের ভয় পাওয়া ফ্যাকাশে চেহারা দেখেই হয়তো হুজুরের মন নরম হয়। তিনি গুরুগম্ভীর গলায় জানতে চান- ‘বিয়ানবেলা এইহানে কী?’
‘না মানে’ ইয়ামিন মিন মিন করে বলে, ‘ভূত। না না, ভূতানী!’

‘ভূতানী!’ হুজুর ধমকে ওঠেন। ইয়ামিনকে তিনি বিলক্ষণ চেনেন। তার মক্তবের সবচেয়ে দুষ্ট ছাত্র। ফলে তিনি ইয়ামিনের মতলব বুঝে উঠতে পারেন না। কিন্তু কিছু একটা যে হয়েছে এটা বুঝতে পেরে নরম গলায় পুনরায় জানতে চান। এবার একটু দম নিয়ে ইয়ামিন পুরো ঘটনা খুলে বললে তিনি ইয়ামিনের কাঁধে হাত রেখে অভয় দেন। তারপর ইয়ামিনকে দাওয়ায় বসিয়ে রেখে ঘরের ভিতর থেকে একটা লাঠি এনে দেন।
‘নে ধর। রূপ ধইরা আইছিল। ইলিশ দ্যাকছে না! এইবার সামনে পরলে আল্লার নাম নিয়া দিবি একখান বাড়ি। পারবি না?’
ইয়ামিনের এতক্ষণে সাহস ফিরে এসেছে। সে লাঠিটি হাতে নিয়ে শক্ত করে ধরে বলে ‘পারুম’।

এক হাতে লাঠি, এক হাতে ইলিশ নিয়ে ইয়ামিন দ্রুত পায়ে বাড়ির পথ ধরে। পূর্ব আকাশে সূর্য উঁকি দিয়েছে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্যের আলো এসে পিছলে যাচ্ছে রূপালি ইলিশের গায়ে। তবুও ইয়ামিনের মনের ভয় পুরোপুরি কাটে না। সে বাড়ির ভিতর ঢুকতেই আচমকা দাদির মুখোমুখি হয়। আর ঠিক তখনই বট গাছের নিচের ওই বুড়িটার মুখ তার চোখের সামনে এক ঝটকায় ভেসে ওঠে। ইয়ামিন চিৎকার দিয়ে লাঠি উচিয়ে ধরে দাদির মাথা বরাবর। তার চিৎকার শুনে ছুটে আসে বাড়ির অন্যরা। তারা জোর করে ইয়ামিনের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নেয়। কিন্তু ইলিশ মাছটা ইয়ামিন ছারে না। বাম হাতে শক্ত করে মাছটা ধরে সে চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘না, আমি দিমু না। দিমু না। এই ইলিশ আমার।’
দাদি ডাকে, ‘ও নাতি কী হইছে?’
মায়ে ডাকে, ‘ইয়ামিন, বাপ আমার কী হইছে?’
কারো কথাই যেন ইয়ামিনের কানে যায় না। সে ইলিশ মাছটা আরো শক্ত করে ধরে রাখে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ এপ্রিল ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়