ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ইলিশকাল-শেষ পর্ব

ইলিশে অপার সম্ভাবনা, জেলেদের খাতা শূন্য

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩১, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইলিশে অপার সম্ভাবনা, জেলেদের খাতা শূন্য

ইলিশ বদলে দিচ্ছে উপকূল, ইলিশ বদলে দিচ্ছে বাংলাদেশ। ঐতিহ্যের ধারা বয়ে নিয়ে ফি-বছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। জিডিপিতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ইলিশ যাচ্ছে বিদেশে, অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। স্বীকৃতি মিলেছে- বাংলাদেশই ইলিশের ঠিকানা। ইলিশের জিন উদঘাটন বাংলাদেশেই। ইলিশ রক্ষায় রাষ্ট্র নিচ্ছে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। তারই সুফল মিলছে এখন।

সূত্র বলছে, মৎস্যখাত উপকূলের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে ইলিশ। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী মাত্র দেড় দশকের ব্যবধানে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ২ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরে দেশে ইলিশ উৎপাদন হতো ১ লাখ ৯৫ হাজার টন। ২০০২-০৩ অর্থবছরে ইলিশ পাওয়া যায় ১ লাখ ৯১ হাজার টন। ইলিশ উৎপাদন যে বেড়েছে তার প্রমাণ মিলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসে। এই সময় ৩ লাখ ৯৫ হাজার টন ইলিশ উৎপাদন হয়। দেশের জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদনে) ইলিশের অবদান ১.১৫ শতাংশ। এর অর্থমূল্য আনুমানিক সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। আর ইলিশ রফতানির মাধ্যমে আসে ১৫০-৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।

মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে দেশে ১০ হাজার ৯০০ টন, ২০১৩ সালে সাড়ে ১১ হাজার টন, ২০১৪ সালে ১১ হাজার ৮০০ টন জাটকা ধরা হয়। এগুলোর আকার ১৪-২০ সেন্টিমিটারের মধ্যে। ওজন গড়ে ৩০ গ্রাম। এই হিসাবে প্রতিবছর প্রায় ৪০ কোটি জাটকা ইলিশ ধরা পড়ছে দেশে। এই নিধন বন্ধ রাখতে পারলে ইলিশ উৎপাদনে বিপ্লব ঘটতে পারে- বিশেষজ্ঞরা এমন মতামত দেয়ার পর গত কয়েক বছর জাটকা ইলিশ ধরা বন্ধে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এতেই মিলেছে বড় সুফল।

চাঁদপুরের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. মো. আনিছুর রহমান বলেন,  আমাদের দেশের মোট মাছের ১১ শতাংশ উৎপাদন আসে ইলিশ থেকে। পাঁচ লাখ জেলে সরাসরি ইলিশ আহরণের সঙ্গে জড়িত। আরো ২০ লাখ লোকের জীবিকার প্রধান উৎস ইলিশ। ২০০৭ সাল থেকে জাটকা রক্ষায় সরকার পদক্ষেপ নেয়ার পর ইলিশের উৎপাদন ও বিস্তৃতি বেড়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে আরেকটু নজর দিলে বাংলাদেশের নদীগুলো ইলিশে ভরে উঠবে।

মৎস্য খাতে এই বিপুল সম্ভাবনার বিপরীতে উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় জেলেদের সঙ্গে আলাপে উঠে আসে তাদের কষ্টের কথা। তাদের কথায়, মাছের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের সব পদক্ষেপে ভোগান্তি পোহাতে হয় জেলেদের। বছরের বিভিন্ন সময় নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। দিনের পর দিন অভিযান চলে মাছের বিচরণ ক্ষেত্রে। মাছ ধরা বন্ধ থাকাকালীন সরকারের দেয়া পুনর্বাসন সহায়তা পৌঁছায় না জেলেদের ঘরে। জেলে পরিচয়পত্র প্রদানেও রয়েছে অনিয়ম। নিষেধাজ্ঞার  সময় পার করে মাছের মৌসুমে জেলেরা মাছ পেলেও সে মাছ বিক্রি করতে হয় পানির দামে। জেলেরা নিষিদ্ধ সময়ে কষ্ট করে দিন কাটাতে চান কিন্তু তারা মৌসুমে ইলিশের ভালো দামও চান।

জেলেরা বলেন, সরকারের মাছ ধরা নিষিদ্ধ কর্মসূচিতে মাছের উৎপাদন হয়তো কিছু বাড়ে, কিন্তু জেলেদের মাছ বিক্রি করতে হয় পানির দরে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, মাছের উৎপাদন বাড়াতে কিংবা জেলেদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও প্রকৃত জেলেরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মাছধরা, মাছের দাম পাওয়া সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে প্রভাবশালী চক্র। ইলিশ আহরণের ক্ষেত্র মেঘনা তীরবর্তী এলাকা ঘুরে জানা গেছে, গত দুই মৌসুমে এইসব এলাকায় প্রচুর পরিমাণে ইলিশ আহরণ হয়েছে। মেঘনার তীরের ছোট জেলেদের জালেও অনেক মাছ উঠতে দেখা গেছে। কিন্তু বেশি মাছ পাওয়ায় জেলেদের মুখে হাসি ফোটেনি।

ইলিশ আহরণ ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, মাছের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের উদ্যোগ ইতিবাচক। কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে জেলেদের কোনো আপত্তি নেই। তবে সহায়তা প্রদানের জন্য প্রকৃত জেলেদের তালিকা করা জরুরি। ভোলার দৌলতখান, লক্ষীপুরের রামগতির স্থানীয় মৎস্যজীবী সংগঠণের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আবেদন করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার সময় মাছধরা বন্ধ রাখতে সর্বাত্মক সহায়তা করতে চায় এইসব সংগঠন। বিপরীতে তারা চায় জেলেদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, জেলেদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে পরিচয়পত্র দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সে পরিচয়পত্র প্রদানেও রয়েছে নানা সমস্যা। প্রকৃত জেলেদের অনেকে এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে, আবার অ-মৎস্যজীবীরাও ঢুকে পড়েছে তালিকায়। ভোলা জেলা কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম এ বিষয়ে বলেন, এক শ্রেণীর অ-মৎস্যজীবী দাদনদার ও জলমহালের দখলদার প্রকৃত মৎস্যজীবীদের মাছ আহরণে বাধার সৃষ্টি করছে। তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অনেক দাবির পর জেলেদের পরিচয়পত্র দেয়া হলেও ভূয়া মৎস্যজীবীরা তালিকাভূক্ত হয়েছে। সে কারণে এই পরিচয়পত্র দিয়ে জেলেদের অধিকার নিশ্চিত হবে না। জেলেসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, জেলেদের একটি বড় অংশ চরম দারিদ্র্যে দিন কাটায়। মাছ ধরতে তারা প্রতিনিয়ত প্রভাবশালীদের কাছে জিম্মি থাকে। ধরে আনা মাছ বেচাকেনা থেকে মাছ ধরার ক্ষেত্রেও তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এই প্রভাবশালীরা গায়ের জোরে নিজেদের লোক দিয়ে খুটাজাল, নেট খরচি জাল, মশারি জাল, বিহুন্দি জাল, বের জাল দিয়ে মাছ ধরে। এইসব জালে ২-৩ ইঞ্চি থেকে ৮ ইঞ্চি পর্যন্ত ইলিশের বাচ্চা, পোয়া, পাঙ্গাস, আইর, শিলমসহ সব ধরণের ছোট মাছ উঠে আসে। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় প্রকৃত জেলেদের।

ভোলার ইলিশা ঘাটের জেলে আবু জাহের অভিযোগ করেন, নদী থেকে ধরে আনা যে মাছ তারা আড়তে ১২০০ টাকায় বিক্রি করেন, সে মাছ বাইরে ১৫-১৬শ’ টাকায় বিক্রি করতে পারেন। ভোলার দৌলতখান, ইলিশা, লক্ষীপুরের রামগতি, হাতিয়ার বুড়িরচরের অনেক জেলের অভিযোগ, মহাজনেরা সিন্ডিকেট করে মাছের দাম কমিয়ে রাখে। লক্ষীপুরের রায়পুরের চরবংশী ইউনিয়নের নাইপাড়ায় গিয়ে দেখা মেলে দাদনের কারণে নিঃস্ব বহু জেলের। তবে এইসব অভিযোগ অস্বীকার করেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির নেতারা। মৎস্য অধিদপ্তরের সূত্রগুলো বলেছে, জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছে। মহাজন ও দালালচক্রের হাত থেকে জেলেদের উদ্ধার করাসহ ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য ৯৭২ কোটি ১৭ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছয় বিভাগের ২৯টি জেলার ১১১টি উপজেলায় মহাজনদের হাত থেকে জেলেদের রক্ষা। ৭১ উপজেলায় মৎস্য সংরক্ষণ আইন বাস্তাবায়ন, তিন বিভাগের পাঁচ জেলার ২১ উপজেলার ১৩০টি ইউনিয়নে ইলিশের অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জোরদার করা। ওই প্রকল্পের আওতায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার জেলের পরিবারের জন্য। এই ১০ হাজার জেলে গ্রুপকে মাছ ধরার জাল সহায়তা দেয়া হবে, যাতে তারা দাদনদার ও মহাজনদের হাত থেকে মুক্ত থাকে। ৪৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে বোট কিনে জেলেদের মধ্যে সরবরাহ করা হবে। ২০০ মৃত জেলের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। জাটকা আহরণ থেকে জেলেদের বিরত রাখাতে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা উল্লেখ রয়েছে প্রকল্পে।

ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি ইলিশের ন্যায্য মূল্য চান জেলেরা। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের মতিরহাটের জেলে মোবারক হোসেন বলেন, ‘আমরা ইলিশ ধরি। সুফল আমাদের ঘরে ওঠে না। বছরের কয়েকমাস খুব কষ্ট করে জীবন চলে। নদীতে ইলিশ পড়লে তার ন্যায্য মূল্য আমরা পাই না। ইলিশ আগের চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। সরকার চাইলে আমরা একদিন এর সুফল পাবো।’ তার গলায় সুর মিলিয়ে পাশ থেকে আরেকজন বলেন, ইলিশে এত সম্ভাবনা বিকাশের পরেও শেকড়ই অন্ধকার। জেলেদের খাতা তো শূন্য। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, দস্যুদের ভয় উপেক্ষা করে, রাতদিন পরিশ্রমকারী জেলে সম্প্রদায়ের ভাগ্য বদল হয় না। আমরা দাদনের কব্জায় বন্দি যুগ যুগ। ইলিশের পেছনে জীবন শেষ করে দিলেও ঘরে সেই মিটিমিটি আলো। অপেক্ষায় আছি, কোনদিন হয়তো সুফল মিলবে। ইলিশের সম্ভাবনা বিকশিত হোক, টিকে থাকুক ঐতিহ্য, জেলেরা পাক ইলিশের ন্যায্যমূল্য।

 

ঢাকা/রফিকুল ইসলাম মন্টু/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়