ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ইলিশের বাড়ি নিয়ে টানাটানি

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইলিশের বাড়ি নিয়ে টানাটানি

জুনাইদ আল হাবিব : ‘ইলিশ’ শব্দটি কানে এলেই অনুভূত হয় মনোরম ঘ্রাণের। চোখে ভাসে রুপালি ঝিলিক দেয়া তাজা ইলিশ। সুস্বাদু মাছ হিসেবে ইলিশের সুনাম দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন বিদেশেও পৌঁছে গেছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে ইলিশ মানেই বাংলাদেশের মাছ। এর কারণও রয়েছে, গবেষকরা জানিয়েছেন, বিশ্বে ইলিশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৬০ ভাগ বাংলাদেশে হয়। প্রায় চার লাখ মানুষ সরাসরি ইলিশ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ইতিমধ্যে উদঘাটন হয়েছে ইলিশের জীবন রহস্যও। যা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রয়াসের ফল। ইলিশ উৎপাদনে ইতিমধ্যে জেলা ব্র্যান্ডিং কার্যক্রমও শেষ হয়েছে। এখানে চাঁদপুরকে ইলিশের বাড়ি হিসেবে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। কিন্তু ব্র্যান্ডিং-এর পরপরই শুরু হয়েছে এ নিয়ে টানাটানি। পাশের জেলা লক্ষ্মীপুরের মানুষের দাবি, ইলিশের বাড়ি লক্ষ্মীপুর। বিষয়টি নিয়ে রীতিমত তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনায় সরগরম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

কেন ইলিশের বাড়ি লক্ষ্মীপুর? এমন প্রশ্নে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর ফ্রেন্ডস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. ওয়াহিদুর রহমান মুরাদ বলেন, ‘যখন ইলিশ সুরক্ষার অভিযান দেওয়া হয়, তখন মেঘনা অববাহিকায় চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের রামগতি পর্যন্ত ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা থাকে। তাহলে আয়তনের দিক থেকে কে এগিয়ে? নিশ্চয় লক্ষ্মীপুর এগিয়ে। কারণ লক্ষ্মীপুরের চারটি উপজেলার মেঘনা উপকূলের আওতায় আর চাঁদপুরের মাত্র একটি উপজেলা। পদ্মার অনেক অংশ চাঁদপুরের সীমানায়। কিন্তু পদ্মায় কী ইলিশ তেমন মেলে? বিগত দিনের খবরের কাগজের দিকে তাকালে পদ্মায় ইলিশের আকালের চিত্র আমরা দেখি। অতএব, চাঁদপুরকে তাদের মনগড়া প্রচারণা বন্ধ করতে হবে।’

এর বিপরীত ব্যাখ্যা দিলেন চাঁদপুরের হাইমচরের এমজেএস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সরদার মো. মাহবুব। তিনি বলেন, ‘আয়তনের বিচারে নয়। চাঁদপুরের সীমানাতে ইলিশের প্রজনন বেশি এবং এখানের ইলিশগুলোর স্বাদ বেশি। যে কারণে চাঁদপুরের ইলিশের দামও বেশি। এই দিকগুলো বিবেচনা করে, চাঁদপুরের জেলা ব্র্যান্ডিং হিসেবে ইলিশকে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর নয়, সেটা হাইমচর হতে পারে। চাঁদপুরের অন্যান্য সীমানা তো পদ্মা। পদ্মার মোহনায় কোনো ইলিশ নেই। এটা আমরাও স্বীকার করি।’

লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ থেকে সদ্য মাস্টার্স উত্তীর্ণ তরুণ খুরশিদ আলম চৌধুরী বলেন, ‘ইলিশ মাছ খুবই দ্রুত বেগসম্পন্ন প্রাণী। এর পেটে যখন ডিম আসে তখন এটি স্থির থাকতে পারে না। খুব বেগ নিয়ে ছুটে চলে। যেখানে যত বেগে ইলিশ চলাফেরা করতে পারবে, সেখানে ইলিশ উৎপাদন তত সম্ভাবনাময়।’ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মো. ফয়সল হাসান বলেন, ‘১০০ কিলোমিটার ইলিশ অভয়াশ্রমের মধ্যে ৭০-৭৫ কিলোমিটার লক্ষ্মীপুরের মধ্যে পড়েছে। চাঁদপুর মূলত প্রচার-প্রচারণার কারণে ইলিশের বাড়ি হিসেবে ব্র্যান্ডিং করতে পেরেছে। কেননা, ইলিশের বড় ল্যান্ডিং স্টেশন ও আড়ত চাঁদপুরে। সেখানে লক্ষ্মীপুর থেকে যাওয়া ইলিশগুলোও চাঁদপুরের ইলিশ নামে বিক্রি হয়। লক্ষ্মীপুরের ইলিশ সারাদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সরকারিভাবে মেঘনাতীরের মতিরহাট, মজু চৌধুরীহাট ও আলেকজান্ডারে ৩টি বড় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র স্থাপন জরুরি।’

জার্মানির হুমবোল্ট ইউনিভার্সিটির পিএইচডির গবেষক ও লক্ষ্মীপুরের কৃতি সন্তান আল আমিন উল্লাস মনে করেন, ‘ইলিশ যত উজানে যায় ততই মিষ্টি হতে থাকে এবং এর বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তিত হয়। তবে প্রকৃত ইলিশের স্বাদ মোহনার ইলিশেই সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, লক্ষ্মীপুরে লবণ জল অঞ্চল থাকায় ওমেগা-৩ এর পুরো পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন থাকে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে বুদ্ধির জন্য হিংসা করা হয়। আর এর উৎস হচ্ছে সামুদ্রিক মাছের ওমেগা-৩। আগে ইলিশের বাড়ি হিসেবে আমরা আলেকজান্ডারকে বলতাম। এখন পুরো জেলায় মেঘনার মোহনা ইলিশ উৎপাদন হচ্ছে। ইলিশের বাড়ি কেবল লক্ষ্মীপুরকেই মানায়।’

জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ এর এএসপি ও লক্ষ্মীপুরের কৃতি সন্তান মো. মিরাজুর রহমান পাটোয়ারি বলেন, ‘ইলিশের বাড়ি অবশ্যই লক্ষ্মীপুর। লক্ষ্মীপুরের লক্ষাধিক মানুষ সরাসরি ইলিশ শিকার করে জীবনযাপন করেন। লক্ষ্মীপুরের ইলিশ শুধু ঢাকার বাজারে আসে না, আন্তর্জাতিক বাজারে যায়। লক্ষ্মীপুরের মেঘনার ইলিশের গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমাদের লক্ষ্মীপুরেও ইলিশ উৎসব করা হয়। ইলিশ লক্ষ্মীপুরের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। আর যে মেঘনায় ইলিশের উৎপাদন প্রচুর, সে মেঘনার উৎপত্তি তো লক্ষ্মীপুরেই। আমরা বলবো, ইলিশের বাড়ি লক্ষ্মীপুর। এই জেলার সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে জেলা ব্র্যান্ডিংয়ে ইলিশকে যুক্ত করা জরুরি।’

লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মাইন উদ্দিন পাঠানও মনে করেন, ‘ইলিশকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীপুরে হাজার হাজার বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে। ইলিশ ঘাটগুলো থেকে মটরসাইকেল, সিএনজিতে করে প্রতিদিনই ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে। এমনকি পিকআপ-ট্রাকে করেও। অসংখ্য বরফ কারখানা এবং ইলিশ ধরার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যও চলছে বেশ ধুমধামে। লক্ষ্মীপুরে ইলিশ নিয়ে এই যে বিরাট একটা সম্ভাবনার চিত্র উঠে আসে, তার দিকে তাকালে অবশ্যই লক্ষ্মীপুরের জেলা ব্র্যান্ডিংয়ে ‘ইলিশের বাড়ি লক্ষ্মীপুর’কে স্থান দেওয়া এখন গণমানুষের দাবি। পাশাপাশি এখানে ইলিশ সম্পদের বিকাশের জন্য মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও প্রয়োজনীয় হিমাগার স্থাপনে উদ্যোগ নিতে হবে। এতে দেশের অর্থনীতিও বদলে যাবে।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়