ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ঈদ আনন্দ যেখানে গৌরবের || অজয় দাশগুপ্ত

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৮, ২৪ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঈদ আনন্দ যেখানে গৌরবের || অজয় দাশগুপ্ত

ঈদের আনন্দ এখন আর তখন কি এক রকম? আমার উত্তর: না। আমাদের সময় কর্পোরেট জগত ছিলো না। ছিলো সহজ সাধারণ জীবন। তখন এত তথ্যপ্রযুক্তি ছিলো না। মাঝে মাঝে মনে হয় দরকারও ছিলো না। যা ছিলো তাতেই সন্তুষ্ট ছিলাম আমরা। এখন যত আনন্দ আর বাড়তি সুযোগ তত বিষাদ। মানুষ মূলত এখন ছুটছে। কী যে তার চাই আর কী চাই না সেটাই ঠিক করতে পারছে না। এই জায়গাটাতেই বিপত্তি।

ঈদ আগে যেমন, এখনও তেমন- আপন মহিমায় উজ্জ্বল। কিন্তু তার গায়ে চাপিয়ে দেয়া পোশাকী আবরণই মাঝে মাঝে কেমন যেন লাগে! আগে কোনো দিন আমরা কাউকে কোন ধর্মের মানুষ বা কী তার আচরণ- এসব দিয়ে বিচার করিনি। প্রযুক্তি বলুন আর আধুনিকতা, আমাদের মনে এমন সব প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছে যাতে আমরা সহজেই কাউকে ধর্ম দিয়ে শনাক্ত করতে পারি। শুনতে পাই মানুষ ধর্মের বাইরে নাকি আর পা রাখতে পারছে না। অথচ আমাদের দেশে সম্প্রীতি আর সহনশীলতা যুগ যুগ ধরে একসাথে চলছে। কোনো দিন প্রয়োজন হয়নি আজ দরকার পড়েছে স্লোগান দেয়ার, কি সেই স্লোগান? ধর্ম যার যার উৎসব সবার।

সে তো সব সময় ছিলোই, নতুন করে তাকে লিখে, বলে প্রচার করতে হচ্ছে কেন?  বলছিলাম তখনকার কথা। আহা! সেই দিনগুলোয় কোরবানি নিয়ে আসতো ত্যাগের মহিমা। এখনো আনে। তবে ফারাক এই, তখন আমরা সবাই মিলে সবুর করতাম। জানতাম কারো বাড়িতে উপহার বা বিতরণের খাবার আসতে দেরী হবে না। এটাই আমাদের দেশের সৌন্দর্য্য। আমাদের দেশ পাকিস্তান না। ভারতও না। ভারত পাকিস্তানে এখনো মুসলমান-অমুসলমানরা জায়গা বিশেষে নিজেদের ভেতর থাকে। বিশেষ এলাকায় বসবাস করে। আমাদের তা নয়। বাংলাদেশের সর্বত্র একসঙ্গে থাকা আর এক উঠোনে ভাগ করা প্রতিবেশীরা তাই নিজেদের পৃথক ভাবতে পারে না। সে চেষ্টা মানুষ করেনি। করিয়েছে রাজনীতি। সত্যি বলছি, পাক আমলেও কোনো রাষ্ট্রপ্রধান কোথায় নামাজ আদায় করলেন বা কোন নেতা কোথায় কোলাকুলি করলেন এগুলো মূখ্য ছিলো না। মূখ্য ছিলো মানুষের খবর। সে মানুষ এখন পরের কাতারে। এজন্যে মিডিয়াও দায়ী বৈকি। তারা ইচ্ছা অনিচ্ছায় প্রচারে এমন সব বিষয় আনছে যাতে মনে হতে পারে, আমাদের দেশের মানুষ রাজনৈতিক নেতাদের ছাড়া উৎসবও উদযাপন করতে পারে না।

ঈদের আনন্দ নিয়ে মানুষের মনে দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব কোনোটাই কোনোকালে ছিলো না। বাড়ি ফেরার তাড়নায় যারা মরিয়া হয়ে ছোটে তারা সবাই এক ধর্মের মানুষ? কখনোই না। সবাই যার যার মতো করে প্রিয়জনের সাথে ঈদ করার জন্য ছোটে। এই যে আনন্দ বা উৎসব এতেই কিন্তু সার্বজনীনতা। কারণ এই মানুষগুলোও সেদিন বা দু’একদিন সমান আবেগে ভাসেন। দেশ ও জাতির জীবনে যে প্রভাব বা যে বিপুলতা সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। সে বিপুলতায় কোনো মন্দ বিষয় বা উগ্রতা ভাগ বসাক এটা আমরা চাই না। আমাদের জীবনে এমনিতেই অশান্তির শেষ নাই। মারামারি খুন জখম হত্যা লুট সব চলছে। এসব ক্লান্তিকর বিষয় থেকে মুক্তি দিতে আসে উৎসব। সেখানে ভেদাভেদ পাপ বা অন্যায়। আজকাল কেউ কারো সাথে দেখা করে না। সবাই বাড়িতে বসে মুখ লুকিয়ে টিভি দেখে বা মোবাইলে থাকে। এটা বন্ধ করা দরকার। মানুষ যদি মানুষের মুখোমুখি না হয়, একে অপরের সাথে মন খুলে মিশতে না পারে সে মেলামেশা কি আসলেই কোনো অর্থ বহন করে? তা ছাড়া বায়বীয় জগতের এই অন্ধকার কতদিন টানবে মানুষ? কবে আবার তারা আনন্দ ও  উৎসবের জন্য খোলা মাঠে নেমে আসবে? একবার ভাবুন শুধু নামাজটা শেষ করা, তারপর আর কেউ থাকে সেখানে? আমাদের কালে মানুষ মাঠ ছেড়ে যেতে চাইতো না। দলে দলে মানুষ একে অপরের জন্য ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো। এখন তার বিপরীত। কী করে নিয়মটা শুধু পালন করবে- ব্যস তারপর আবার সেই অন্ধকার ঘর। আবার নীল পর্দা। এই ভবাবহ বাস্তবতা থেকে সমাজকে মুক্ত করা দরকার। একমাত্র উৎসবই পারে তা করতে।

তবে সবচেয়ে জরুরি মন ঠিক রাখা। কারণ যে কোনো উৎসবই এখন অনেকটা লোক দেখানো। আগে কখনো পশুর দাম বিশেষত গরুর দাম নিয়ে এমন ছেলেখেলা দেখিনি। যার যার সাধ্যমতো মানুষ কোরবানির পশু কিনতো। সামাজিক মিডিয়া আসার পর এটা এখন ইজ্জতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু নামীদামি মানুষকেও দেখি এসবে শামিল হতে। মনের পশু কোরবানি দিতে না পারলে কারো ত্যাগ যে গৃহীত হয় না এটা জানার পরও তারা এ ধরনের ছেলেমানুষী করেন। এক বিখ্যাত কবিকে দেখেছি বীভৎস এক চেহারায়। নিহত গরুর শিং হাতে নিয়ে পোজ দিয়েছিলেন। আমার মনে হয়েছে কোরবানির আসল মাজেজাই নষ্ট হয়ে গেছে সে ছবিতে। নানাভাবে আপদ ঢুকছে। আবার শান্তি এই, প্রযুক্তি আমাদের শিখিয়েছেও অনেক। বিদেশে উন্নত দেশে বা সভ্য সমাজে কীভাবে এসব উৎসব পালিত হয় সেটা দেখে নিশ্চয়ই শিখবো আমরা।

দেশের সাথে বিদেশের কোরবানির একটা বিরাট তফাৎ হচ্ছে দৃশ্যমান কোরবানি আর অদৃশ্য ত্যাগ। দেশে এটা একটা উৎসবে রূপ নিয়েছে। যত্রতত্র জবাই আর রক্তের ছোপ ছোপ দাগ অনেকের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। বিশেষ করে শিশুদের। বিদেশে সে সুযোগ নেই। আপনি জানবেন না, টেরও পাবেন না। আপনার দায়িত্ব তাদের জানিয়ে দেয়া। আর আপনি কতটা দিলেন সেটাও জানিয়ে রাখা। ব্যস। বাদবাকী তারাই করবেন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জবাই হবে। নিয়ম মেনে আইন মেনে। এতে দুটো লাভ। একদিকে যেমন আপনি আপনার ত্যাগ ও ধৈর্যের নমুনা দেখালেন, অন্যদিকে বজায় রইলো স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। সবাই এখন মানেন, এক শ্রেণীর মানুষ আসলে ত্যাগের চাইতে তার শোআপ মূখ্য মনে করে। কোরবানির মূল আদর্শের সঙ্গে এটি যায় না। আইন করেও এ কাজ বন্ধ করা যাবে না। কারণ আছে ধর্মীয় আবেগ। কোরবানির পর বিদেশের মিডিয়ায় ঢাকার রক্তমাখা রাজপথের ছবি দিয়ে যে প্রচারণা চলে তা বন্ধ করতে হলে নিয়মের আওতায় এনে কোরবানির প্রচলন করতে হবে।

বিদেশে নিয়ম মেনে কোরবানি হয়। আমি ধর্মীয় নিয়মের কথা বলছি না। নির্দিষ্ট কসাইখানায় ধর্মীয় বিধান মেনে সেখানে কোরবানি দেয়া হয়। মনে হয়, এটাই হওয়া উচিৎ। কারণ মূল উদ্দেশ্য ত্যাগ। একসময় দেশেও নীরবে, নিভৃতেই কোরবানি হতো। যদিও ঈদের আনন্দ হতো ঘটা করে। এখন মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া আর নানা মনস্তাত্বিক কারণে আমরা তা মানি না। বিদেশে পশু জবাই কতটা আধুনিক আর সমাজ উপযোগী সেটা বাইরে গেলে অথবা নেটের কল্যাণে চাইলে জেনে নিতে পারেন। মূল বিষয় আমরা আসলে কী চাই? এ নিয়েই যত দ্বন্দ্ব আর কলহ। আমাদের চাওয়া পাওয়ার সাথে আধুনিকতা যোগ না হলে সমস্যা বাড়বে। অথচ ত্যাগ ও নিষ্ঠা  বলছে, আড়ম্বর চাই না, চাই শুদ্ধতা। উৎসব সবার হোক- কথাটা যত জোর দিয়ে বলি, তত জোর দিয়ে তাকে বাস্তবে চাই না আমরা। চাইলে অনেক কিছু হতো। বাংলাদেশের সৌভাগ্য এদেশের জন্ম ও ইতিহাস অসাম্প্রদায়িক। তার নদী পাখি মানুষ এক নামেই তাদের পরিচয়। সেই বাঙালিয়ানা ছেড়ে যারা অন্য দেশের কায়দায় কিছু জোর করে চাপাতে চেয়েছে তারাই পরাস্ত হয়েছে। উৎসবও সেই বার্তা দিয়ে যায় আমাদের। ঈদ মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব হলেও বাংলাদেশে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তা সবার- এটাই আমাদের গৌরব।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়