ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বিশ্ব পানি দিবস

উপকূলজুড়ে সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ২২ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উপকূলজুড়ে সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে

‘লবণে তো আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে। মিঠা পানির খুব অভাব। দূর থেকে পানি আনতে হয় কিনে। এক সময় মিঠা পানি পাওয়া যেত ৬০-৭০ ফুট গভীরে। এখন ১২০ ফুট গভীরেও লবণ পানি।’ পানি সংকটের কথা তুলে এভাবে অবস্থার বিবরণ দিচ্ছিলেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বড় কুমিরা গ্রামের কৃষ্ণপদ জলদাস। খুলনার দাকোপের সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগি গ্রামের মো. ইদ্রিস মোড়লের স্ত্রী আছমা খাতুনের কণ্ঠে একই সুর- ‘চারিদিকে থইথই লবণ পানি। ট্রলারে করে মিঠা পানি আনতে হয় দূরের উপজেলা সদর থেকে।’ সাতক্ষীরার শ্যামনগরের তালবাড়িয়া আর আটুলিয়া গ্রাম দিয়ে যাওয়ার সময় বাসিন্দারাও বললেন একই কথা: ‘গ্রামে ভালো পানির পুকুরের সংখ্যা কম। তাই পানি সংগ্রহের জন্য লড়াই শুরু হয় ভোর থেকেই। মিঠা পানির এলাকাটি যে কীভাবে লবণ পানিতে ডুবলো; ভাবতে পারছি না।’

পানি সংকটের এই ছবিগুলোই ধরিয়ে দেয় উপকূলজুড়ে সুপেয় পানির সংকট ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পূর্বে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে শুরু করে পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র পানি সংকটের চিত্র চোখে পড়ে। এক কলসি পানি সংগ্রহের জন্যে নারী-পুরুষ আর শিশুদের ছুটতে হয় সেই সকাল থেকে। এক সময় শুধু পশ্চিম উপকূলের পানি সংকটের খবর পাওয়া গেলেও এ সংকট ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়েছে উপকূলজুড়ে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মিঠা পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। অনেক স্থানে গভীর নলকূপগুলো ভাঙনে হারিয়ে যাওয়ায় মিঠা পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও আবার মিঠা পানির সংরক্ষিত পুকুরগুলো সংস্কারবিহিন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় আইলা, সিডর মধ্য ও পশ্চিম উপকূলের কোথাও কোথাও পানি সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে। পশ্চিম উপকূলে লবণাক্ততার মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় মিঠা পানির আধার সংকুচিত হয়ে গেছে।

সরেজমিন পর্যবেক্ষণে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, উপকূলের কিছু এলাকায় আগে মাত্র ৬০-৭০ ফুট গভীরে নলকূপ বসিয়ে মিঠা পানি পাওয়া যেত। এখন সেসব স্থানে ১২০ ফুটেও মিলছে না মিঠাপানি। কোন কোন স্থানে ৮-৯ শ ফুট নিচে না গেলে গভীর নলকূপের মিঠা পানি পাওয়া যায় না। এই নলকূপগুলো বসাতে এক লাখ টাকার মতো খরচ হয়। আর প্রতিটি গভীর নলকূপ থেকে ৮০টি পরিবার পর্যন্ত পানি নিতে পারেন। এ হিসাবে দেখা যায় প্রতি নলকূপ থেকে ৩০০ থেকে ৩৫০ জনের পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। কিন্তু উপকূলীয় দ্বীপ-চরগুলোর অধিকাংশ স্থানে পর্যাপ্ত গভীর নলকূপ নেই। ফলে সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্যে বাসিন্দাদের হাঁটতে হয় দীর্ঘ পথ। বিশেষ করে, এই পানি সংগ্রহের দায়িত্ব থাকে নারী এবং কন্যা শিশুদের। ঘরের অন্য কাজকর্ম বাদ দিয়ে, কিংবা শিশুদের লেখাপড়ার সময় থেকে সময় বাঁচিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সলিমপুর, শীতলপুর, বড় কুমিরাসহ কয়েকটি গ্রামে দেখা গেল তীব্র পানির সংকট। ড্রাম ভর্তি সুপেয় পানি এদের কিনতে হয়। এসব স্থানে দেখা গেল, নিত্যপ্রয়োজনের কাজগুলো সারছে পুকুর-ডোবার ময়লা পানিতে।

খুলনার দাকোপের কালাবগি এলাকার ঝুলন্ত পাড়ার জালাল মীরের স্ত্রী বাসিন্দা সকিরন বিবি (৪৫) বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে তিনবেলা ভাত হয়তো পেট ভরে খেতে পারি। কিন্তু প্রায়োজনমত পানি পান করতে পারি। অন্যান্য কাজেও পানি ব্যবহার করতে হয় মেপে। বর্ষাকালে পানির কষ্ট কম থাকে। কারণ, তখন বৃষ্টির পানি পাই। তখন পানি ব্যবহার করি এবং সংরক্ষণ করেও রাখি। তবে ধরে রাখা বৃষ্টির পানিটুকু শেষ হয়ে গেলে শুকনো মৌসুমে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়।’ সকিরনের কথায় তাল মেলান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জায়েদা খাতুন- ‘আমরা যে কীভাবে পানিকষ্টে বেঁচে আছি, সরকারকে একটু লিখে জানান।’
 

 

বাসিন্দারা জানালেন, লবণাক্ত এলাকা বলে এখানে খাবার পানির সংকট তীব্র। আইলার পরে নদীর পানিতেও লবণাক্ততা বেড়েছে বলে আমরা অনুভব করি। এলাকায় নলকূপ বসলেও তা থেকে লবণ পানি ওঠে। ১৬০-১৬৫ ফুট পাইপ বসিয়েও দেখা গেছে নলকূপ থেকে লবণ পানিই ওঠে। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে নদীর পানি মিষ্টি থাকে। তখন পুকুরের পানিও মিষ্টি থাকে। এরপর থেকে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে। দূর থেকে এক কলসি পানি নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন তারাবানু। ক্যামেরাওয়ালা লোক দেখে সাংবাদিক বুঝতে পেরে বললেন, ‘পানির জন্য আমরা কী কষ্ট করি। খাবার পানিসহ নিত্যপ্রয়োজনের পানি সংগ্রহ করতেই আমাদের অনেক সময় এবং অর্থ চলে যায়।’

ঝুলন্ত পাড়ার কয়েকটি স্থানে পানির পাকা ফিল্টার চোখে পড়লেও সেগুলো অকেজো। পানির সংকট নিরসনে বিভিন্ন সময়ে হয়তো এগুলো দেওয়া হয়েছিল বেসরকারি উদ্যোগে। ইটবালুর এ ফিল্টারে পানি ধরে রাখা যাচ্ছে না। প্লাস্টিকের ড্রামকেই পানি সংরক্ষণের টেকসই মাধ্যম বলে মনে করেন এলাকার মানুষেরা। কিন্তু সব পরিবারের পক্ষে এই ড্রাম পর্যাপ্ত পরিমাণে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এনজিও থেকে কিছু ড্রাম দেওয়া হলেও তার সংখ্যা হাতে গোনা। পানি সংকট নিয়ে আলাপকালে এলাকার ইউপি সদস্য মোনতাজ সানা বলেন, ‘এখানে নলকূপ বসিয়ে কিংবা ফিল্টার দিয়ে পানির অভাব পূরণ করা সম্ভব নয়। এখানকার প্রতিটি পরিবারে দেড় হাজার লিটারের একটি করে ট্যাংকি দিলেই তারা সারাবছরের পানি ধরে রাখতে পারবে।’

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম আটুলিয়া ইউনিয়নের তালবাড়িয়া আর আটুলিয়া। এখানে প্রায় ৩০০ পরিবারের বাস। কম করে হলেও লোকসংখ্যা দেড় হাজারের ওপরে। এই গ্রাম থেকে সুপেয় পানির উৎস্য কমপক্ষে তিন কিলোমিটার দূরে। এই দুই গ্রামের মানুষ পানি সংগ্রহ করেন একই ইউনিয়নের হেঞ্চি গ্রামের মনোরঞ্জন বৈরাগির বাড়ির পুকুর পাড়ে বসানো ফিলটার থেকে। দিনের প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করার কাজ শুরু হয় ভোর থেকে। কার আগে কে যাবে। লাইনের আগে থাকার চেষ্টা সবার। আগেভাগে পানি ঘরে তুলতে পারলে অন্যান্য কাজে সময় দেওয়া সম্ভব হবে। সকালের পালা শেষ হলে শুরু বিকালের পালা।

সরেজমিনে ঘুরে চোখে পড়ে পশ্চিম উপকূলে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, খুলনার কয়রা, পাইকগাছা আর বাগেরহাটের শরণখোলার প্রত্যন্ত গ্রামে পানি কষ্টের বিপন্ন রূপ। কষ্ট নিরাবণে মানুষগুলোর দীর্ঘ পথ পায়ে হাঁটা। সকাল-বিকেল-দুপুর জলের আঁধারগুলো ঘিরে নারী-পুরুষ ও শিশুদের জটলা। কলসি, বালতি, ড্রাম, জগ, যার যা আছে, তা নিয়েই ছুঁটে যান পানির কাছে। সুপেয় পানির সংকটটাই সবচেয়ে বেশি। কোথাও আবার গোসল, রান্নাবান্না আর সেচের পানির কষ্টটাও তীব্র হয়ে ওঠে। অর্থের বিনিময়ে মানুষের পানি কিনতে হয়।

 

 

সূত্র বলছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে সুপেয় পানির সংকট দীর্ঘদিনের। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলা প্রলয়ের পর এই সংকট আরও তীব্র হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পানির উৎস্যগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এখনও পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরতে পারেনি। সরকারি জলাশয়গুলো সংরক্ষিত পানির আধার হিসাবে থাকার কথা থাকলেও এগুলো বাণিজ্যিকভাবে লিজ ও ভরাট করার প্রতিযোগিতা চলছে। এক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না নিষেধাজ্ঞা। অন্যদিকে চিংড়ি ঘের থেকে লবণ পানি ঢুকছে মিঠা পানির জলাশয়ে। এসব কারণেও খাবার পানির সংকট বাড়ছে বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সামাজিক আন্দোলনের নেতারা উপকূলীয় অঞ্চলের সুপেয় পানি সমস্যার নেপথ্যে সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি ও শহরমুখী পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন। তাদের দাবি, পানির উৎসের লিজ বন্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্রামাঞ্চল ভিত্তিক সমন্বিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) কর্মকর্তারা বলেছেন, পানি সংকটে থাকা এলাকাগুলো ব-দ্বীপের নিম্নভাগে হওয়ায় ভূগর্ভে জলাধারের জন্য উপযুক্ত মোটা দানার বালু বা পলিমাটির পরিবর্তে নদীবাহিত অতি সূক্ষ্ম দানার বালু ও পলি বেশি দেখা যায়। যে কারণে এসব অঞ্চলে ভূগর্ভেও পানযোগ্য পানি পাওয়া যায় না। কোনো কোনো অঞ্চলে ৯০০ থেকে এক হাজার ফুট গভীরে কখনো কখনো সুপেয় পানি পাওয়া যায়। খুলনার পাইকগাছা, কয়রা ও দাকোপ, সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও দেবহাটা, বাগেরহাটের মংলা ও শরণখোলা, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া, বরগুনার পাথরঘাটা এবং পটুয়াখালীর গলাচিপা ও কলাপাড়া উপজেলায় গভীর নলকূপ বসিয়েও মিষ্টি পানি পাওয়া যায় না।

মৃত্তিকা গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের (এসআরডিআই) গবেষণা জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাগরবাহিত নদীগুলোর নোনার মাত্রা আগে চেয়ে অনেক বেড়েছে। এ অবস্থা দীর্ঘ স্থায়ী হচ্ছে বেশি সময় ধরে। বছর দশেক আগেও এই অঞ্চলের নদীগুলোয় নোনার মাত্রা বাড়তো এপ্রিল থেকে মে-জুন মাসে। এখন কপোতাক্ষ, শিবসা, পশুর, ভৈরব, রূপসা, বলেশ্বর, কচা, পায়রা, বিষখালীসহ সংশ্লিষ্ট নদীতে নোনা আসে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস থেকে। আর ভারি বৃষ্টি না হলে সেই নোনার মাত্রা কমে না। এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত-এর অভিমত, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলে পানি সংকটের অবস্থা আমরা শহরবাসী গরম কালে টের পাই। খুলনা মহানগরীর অনেক গভীর নলকূপে পানি উঠছে না। এর কারণ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া। ভূগর্ভের পানির ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে পুনর্ভরণের (রি-চার্জ) সমস্যা। যে পরিমাণ ভূগর্ভের পানি তোলা হচ্ছে, আনুপাতিক হারে সেই পরিমাণ পানি আবার ভূগর্ভে যাচ্ছে না। সুপেয় পানির সংকট সমাধানে, ভরাট হওয়া সরকারি পুকুর ও খাল-নদী সংস্কার এবং পানির উৎসের লিজ বন্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি গ্রামাঞ্চল ভিত্তিক সমন্বিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

সূত্র বলছে, পানি সংকট নিরসনে উপকূলের কিছু এলাকায় লবণাক্ততা-নিরোধ প্ল্যাণ্ট বসানো হয়েছে। বিদ্যুত থাকলে এতে খরচ পড়ে ২০-২২ লাখ টাকা। সৌর বিদ্যুতে চালাতে হলে খরচ হয় ৪৪-৪৫ লাখ টাকা। যেসব স্থানে অনেক গভীরেও বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায় না, সেখানে এ ধরনের প্ল্যাণ্ট স্থাপন করা হচ্ছে। এই সাইজের প্ল্যাণ্ট থেকে ঘণ্টায় ৮০০ থেকে এক হাজার লিটার বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়। এসব প্ল্যান্ট থেকে ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২৫ জনের জন্য পানি সরবরাহ করা যায়। লবণাক্ত এলাকায় এ ধরনের প্ল্যান্ট স্থাপন করে পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। অন্যান্য স্থানে পর্যাপ্ত সংখ্যক গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে মিঠা পানির চাহিদা মেটানো যেতে পারে। আর এর পাশাপাশি মিঠা পানির সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা প্রয়োজন। যা থেকে ফিল্টার করে সুপেয় পানি সরবরাহ করা যায়।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়