ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

এই আমতলা, সেই আমতলা

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এই আমতলা, সেই আমতলা

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ঐতিহাসিক আমতলায় ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি। ছবি: রফিকুল ইসলাম

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এক রক্তিম সকাল। সূর্য কেবল কিরণ দিতে শুরু করেছে। ঢাকা শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজমান। কারণ পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারা চলমান। ছাত্রজনতা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিলেন ১৪৪ ধারা ভাঙার। আর সভার স্থানটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল। সেই স্থানটি তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ ছিল। আজ তা ঢাকা মেডিকেল কলেজের অংশ। বলছিলাম, ঐতিহাসিক আমতলার মিটিংয়ের কথা।

আমগাছটি নেই, জায়গাটিও অনেক বদলে গেছে। কালের যাত্রায় সঠিকভাবে সংরক্ষিত হয়নি আমতলা। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি ফটক হিসেবে ব্যবহৃত এ স্থান। ঐতিহাসিক এ স্থান নানা সমস্যায় জর্জরিত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রবেশপথের পূর্বপাশের গেট থেকে শুরু হয়েছিল ভাষা রক্ষার মিছিল। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমতলার ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণ আজও যথাযোগ্য মর্যাদা পায়নি।

এখন সেই আমতলা চিহ্নিত করার জো নেই। যদি না সেই ফটকের উপর ‘ভাষা আন্দোলন পরিষদ’-এর উদ্যোগে কালো প্লেটে সাদা কালিতে লেখা ‘ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমতলার ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণ থেকে’। এরপর লাল কালিতে নিচের দিকে একটি তীর চিহ্ন দিয়ে সাদা কালিতে লেখা—‘১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী এই দিনে ছাত্র সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে’। সাইনবোর্ডটি ততটা চোখেও পড়ে না। এই সাইনবোর্ডের একাংশ দেয়াল থেকে নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে। ভাষা সংগ্রামীরা যে স্থানে শহীদ হয়েছেন, সেই স্থান আজও অরক্ষিত।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা ফটক থেকে মিছিল বের হয়। মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত, শফিউর রহমান, আবদুস সালাম। অনেক শহীদের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঐতিহাসিক এ ফটক সংস্কারের মাধ্যমে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো তা পড়ে আছে অবহেলা আর অনাদরে।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, দেশের তৎকালীন ছাত্র রাজনীতির সব কর্মকাণ্ডই এই আমতলা থেকে পরিচালিত হতো। আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির বহু স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম এই আমতলা। ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে আমতলায় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৯৬) বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘১৬ তারিখ সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রসভায় আমরা সকলেই যোগদান করেছিলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সকলেই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হলো। অনেকেই বক্তৃতা করল।’

ঐতিহাসিক আমতলার বর্তমান চিত্র

সরেজমিনে দেখা যায়, একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ফুটপাতে বসতে পারেনি অস্থায়ী দোকানিরা। তবে বছরের সব সময়ই আমতলা গেটের সামনে বসে ছোটখাটো বাজার। হাঁড়ি-পাতিল, থালা-গ্লাস, প্লাস্টিকের বালতি, মগ, টুল, চেয়ার, বালিশ-চাঁদর-মাদুর-মশারি, জুতা, প্রসাধনী দ্রব্য, ফল, পান-সিগারেট, চা, ফিরনি, ঝালমুড়ি, খাবার হোটেল। কী নেই সেখানে? যেন জায়গাটি ‘মিনি বাজার’। এ স্থানের যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে, সে খবর অনেকে জানেন-ই না।

ঐতিহাসিক এই স্থাপনার গায়ে লোহার পেরেক দিয়ে সেঁটে দেয়া হয়েছে ঢাকা মেডিকেলের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী সমিতির নির্বাচনের ব্যানার সহ বেশকিছু রাজনৈতিক ব্যানার ও পোস্টার। সামনের ফুটপাত হকারদের দখলে। গেটের ভেতরের দুই পাশে দুটি ভাসমান বসত ঘরও রয়েছে। সামনের ফুটপাতের দোকানিকে এই গেট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা কিছুই বলতে পারেনি। দেখে বোঝার উপায়ও নেই, এখান থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের হয়েছিল। যে মিছিল পাল্টে দিয়েছিল এ দেশের ইতিহাস।

আমতলার গেটের সামনে গত ৭/৮ বছর ধরে চা বিক্রি করছেন অলি উল্লাহ। বিকেলেই আবার চা দোকান বসাবেন বলে জানান তিনি। এই আমতলার গুরুত্ব তিনি ততটা জানেন না। তার ভাষায়, ‘শুনছিলাম এখানে কিছু লোককে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। আমরা গরিব মানুষ। পেটের দায়ে এখানে বসি। মাঝে মাঝে সিটি করপোরেশনের লোকজন দোকান তুইল্লা দ্যায়। কয় দিন পর আবার বসি। তবে ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই এই জায়গার কদর বাড়ে। অনেকেই এখানে আসে। কিন্তু এরপর আর কেউ খোঁজ রাখে না।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) প্রাণী তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করতেন এলাহী বক্স শেখ। ১৯৭৭-২০১৫ সাল পর্যন্ত এখানে চাকরি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে এখানে কাজ করতেন বলেও জানান। এখন অবসর নিয়েছেন। কিন্তু মেডিকেলের পাশেই একটি হোটেল পরিচালনা করেন এলাহী বক্স শেখ। পুরাতন কর্মচারী হিসেবে ঢামেক’র অনেক কিছুই তার জানা। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘আমতলার আম গাছের আমগুলো ছিল মধুর মতো মিষ্টি। বাচ্চারা কাঁচা আমই খেয়ে ফেলত। বঙ্গবন্ধু এই আমতলায় আসতেন। মিটিং করতেন। এছাড়া বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণী মানুষ ও নেতারা এখানে মিটিং করতেন। আমতলা, বেলতলা, মধুর ক্যান্টিন, রশিদ বিল্ডিং কোনো কিছুই এখন আর আগের মতো নেই। হাসপাতালে নতুন নতুন বিল্ডিং উঠছে। সব কিছুই বদলে গেছে। আগের দৃশ্যগুলোর কথা বলা যায় কিন্তু দেখানো তো যায় না! কোনো চিহ্নই তো আজ আর নেই।’

হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানান, ভ্রাম্যমাণ দোকানের পাশাপাশি এখানে রাজত্ব চলে মাদকসেবীদের। দিনেরবেলা এ স্থান হকারদের দখলে আর রাতে বসে মাদকসেবীদের জমজমাট আড্ডা। সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা এবং হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নেতারাও জড়িত। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কয়েকবার উচ্ছেদ করলেও তারা পুনরায় ফিরে আসে। ফলে স্থানটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব হারাতে বসেছে।

ঐতিহাসিক আমতলার বর্তমান চিত্র

শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসা বদরুন নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী জান্নাতুল শিফা বলেন, ‘অনেকেই হয়তো এই আমতলার ইতিহাস জানেন না। অথচ আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা। এটা নিয়মিত ব্যবহার করা হলে হয়তো এর ইতিহাস সম্পর্কে মানুষ জানতেন।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ভাষা গবেষক এবং ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘরের নির্বাহী পরিচালক এম আর মাহবুব বলেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সাক্ষী আমতলা। এই ঐতিহাসিক বেলতলা থেকেই ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিল বের হয়েছিল। কিন্তু বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেছে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমতলা।’

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘আমতলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। বলা যায়, এখান থেকে মাতৃভাষার জন্য ডাকসু সংগ্রহশালায় যে মিছিল শুরু হয়েছিল তা এখনো চলামান। আক্ষরিক অর্থে এই আমতলাকে যথাযথ সংরক্ষণ করাই এখন আমাদের বড় দায়িত্ব। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন নিদর্শন সংগ্রহ করেছে। তাদের উচিত এই সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করতে ঐতিহাসিক আমতলাকে সংরক্ষণ করা।’

ঐতিহাসিক এ স্থানের অবৈধ দখল বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী শাহ্ মো. ইমদাদুল হক বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময়ে এ স্থানে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু অভিযান শেষ হওয়ার পরপরই তা আবার দখল হয়ে যায়।’


ঢাকা/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়