ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

এক ইলিশের দাম ৬ হাজার টাকা

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৮, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এক ইলিশের দাম ৬ হাজার টাকা

জুনাইদ আল হাবিব : চট্টগ্রামের সমুদ্রোপকূল থেকে ফেরা নাগর আলী মাঝি। বয়স তার ৪০ ছুঁয়েছে। লক্ষ্মীপুরের মেঘনা উপকূলের জেলে তিনি। মেঘনার জেলে হলেও মাঝে মাঝে মেঘনায় ইলিশের দেখা না মিললে নৌকার অন্য জেলেদের নিয়ে সমুদ্রে পাড়ি জমাতে হয় তাকে।

গভীর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়েন। স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন রেখে যেন অন্য কোনো জগতে বিচরণ তাদের। চাই ইলিশ, তাজা-টাটকা। সম্প্রতি ভরা মৌসুমেও মেঘনায় তেমন কাঙ্ক্ষিত ইলিশের ছোঁয়া না পেয়ে সিদ্ধান্ত নেন সমুদ্রে যাবেন। ৬ দিন সমুদ্রোপকূলে থাকবেন। সর্বমোট ১৭ হাজার টাকার বাজার সদাই করেছেন। সঙ্গের অন্য জেলেরা হলেন আরিফ হোসেন (১৭), সুমন হোসেন (২৫), মো. রাশেদ (১৫), আবুল কাশেম (২০), মো. কাশেম (৩৫), মনির হোসেন (৩০), হোসেন আহম্মদ (১৩)।

টানা ৬ দিন সবাই খেঁটেছেন ইলিশ শিকারে। অবশেষে মোট মিলিয়ে পেলেন ১২০ হালি ইলিশ। যেগুলো লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের মেঘনাতীরের বাত্তিরখাল ইলিশ ঘাটে আনলে বিক্রি হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। ইলিশগুলোর মধ্যে একটি ইলিশের ওজন আড়াই কেজি। যার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার টাকা।

‘আঁই এ হর্যন্ত যত ইলিশ মাছ ধইচ্ছি, কোনো দিন এত বড্ডা ইলিশ আর হাই ন। এত বড্ডা ইলিশ হাইছি আর অনেক খুশি অইছি। আল্লা দিলে কেউ ঠেকাইতে হারে না।’ বলছিলেন, নৌকার জেলে আরিফ।

নৌকার মাঝি নাগর আলী বলছিলেন, ‘গাঙ্গে ইলিশ না হাইলে সাগরে যাই। এটা আঁঙ্গো ভিন্ন বুদ্ধি। কারণ অবরোধ দিলে ইলিশ আগের মতো মেঘনায় থা না। মেঘনায় যন ইলিশ আইয়ে, তনি অবরোধ শুরু হয়। এজন্য আমরা বেশিরভাগ সাগরে চলি আই। কী কইত্তাম। হেটতো (পেটতো) বাঁচাইতে অইবো। হোলাইন-সাবাইন নইলে কী খাইবো?’



বাংলাদেশের নদী কিংবা সমুদ্রের ইলিশগুলো বেশ সুস্বাদুও বটে। এজন্য আন্তর্জাতিক বাজারে ইলিশ বলতে বাংলাদেশের ইলিশই প্রাধান্য পেয়েছে। কিছুদিন আগেই আবিষ্কার হয়েছে ইলিশের জীবন রহস্য। ইলিশ নিয়ে চলছে নানা রকমের গবেষণা। ইলিশ উৎপাদনের রেকর্ড গড়ায় উপকূলকেন্দ্রিক শহরগুলোতে তৈরি করা হয় ইলিশ চত্বর। যার বাস্তবতা লক্ষ্মীপুর ও ভোলা শহরে।

বিগত বছরগুলোর তুলনায় মেঘনায় এবার ভরা মৌসুমে ইলিশ কম। জেলে জনগোষ্ঠীর অভিযোগ, ‘সরকারকে উল্টো তথ্য দেওয়া হচ্ছে।’ যার কারণে মেঘনার জেলেরা ইলিশ পাচ্ছে না। মেঘনায় যখন ইলিশ আসে, তখনি শুরু অভিযান। ফলে মেঘনার জেলেদের জীবন দিন দিন ধুঁকে ধুঁকে চলছে। জেলেদের দাবি, ইলিশ অভিযান আর কয়েকদিন পিছিয়ে দিলে ইলিশও ঠিক মতো ডিম পাড়বে।

গত বছর অভিযান পরবর্তী সময়ের দিকে চোখ ফেরালে জেলেদের এ অভিযোগের সত্যতা মিলে। জেলেরা তখন দেখিয়েছেন, অভিযানের পরেও ইলিশের পেটে ডিম! সে বিবেচনায় মেঘনায় ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে যথাসময়ে অভিযানের সময় নির্ধারণের জোরালো দাবি এসেছে।

আড়তদার আলিম আল রাজু ও জুয়েল হাওলাদার বলছিলেন, ‘যে সময় নদীতে ইলিশ পাবে জেলেরা, সে সময় পায় না। আবার ইলিশ পাওয়া শুরু করলে অভিযান শুরু হয়। এতে শুধু জেলে নয়, এ পেশার ওপর নির্ভর করা সকল মানুষের দুর্দিন চলে। যেমন এ বছর ভরা মৌসুমেও নদীতে ইলিশ নেই। কারণ কি? যদি ডিমওয়ালা ইলিশ রক্ষার জন্য কাজই করা হয়, তবে কেন ভরা মৌসুমেও ইলিশ পাওয়া যায় না?’

বাত্তিরখাল ইলিশ ঘাটের সভাপতি ও চর কালকিনি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহমুদুর রহমান বেলায়েত বলছিলেন, ‘অভিযানের সময় আমরা নিজ দায়িত্বে জেলেদের সাবধান করে দেই। কোনো চক্র কোনোভাবে নদীতে ইলিশ শিকার করতে পারে না। রাষ্ট্রের আইনকে আমরা সম্মান করি। অভিযান দেওয়া হয় মা ইলিশ রক্ষায়, মা ইলিশ যেন ঠিকমতো ডিম ছাড়তে পারে নদীতে। কিন্তু দেখা গেছে অভিযান শেষে যে ইলিশগুলো ধরা পড়ে, সেগুলোর পেটে অনেক বড় ডিম পাওয়া যায়। বিজ্ঞানের গবেষণার দিকে তাকালে আমরা দেখি, এটা আমাদের রাষ্ট্রের জন্যও অপূরণীয় বিশাল ক্ষতি।’



কিন্তু লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম মুহিবুল্লাহ বলছিলেন, ‘আসলে অভিযানের সময়টা নির্ধারণ করা হয় এইভাবে যে, বাংলা মাস আশ্বিনের পূর্ণিমা চাঁদ উঠার আগের ৪ দিন এবং পরের ১৭ দিন হিসেব করে। মূলত এ সময়টাতেই বেশি ইলিশ পড়ে নদীতে। এজন্য এ সময়ে অভিযান দেওয়া হয়।’

কিন্তু জেলেরা বলছেন যে, অভিযানের সময় পরিবর্তন না করা হলে ইলিশের ডিম থেকে যায়। সেক্ষেত্রে আরো ক’দিন পরে অভিযান শুরুর ব্যাপারে আপনাদের কাছে কি তথ্য আছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অভিযানের পরেও কিছু ইলিশে ডিম থাকবে। সব ইলিশ যে ডিম ছাড়বে তাতো না।’ তবে এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চলমান রয়েছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়