ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

এক হাতে তামিম আর এক বুক দেশপ্রেম

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এক হাতে তামিম আর এক বুক দেশপ্রেম

জাফর সোহেল: ছোটবেলা পরীক্ষার জন্য খুব করে পড়তাম ‘স্বদেশপ্রেম’ নামে একটি রচনা (প্রবন্ধ)। সেখান থেকে শেখার চেষ্টা করতাম- দেশপ্রেম কী? রচনাগুলোতে কিছু উদাহরণও ছিল গা-গরম করা। সেগুলো পড়ে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেত উদ্দীপনায়। এরপর মুক্তিযুদ্ধের অসম সাহসী বীর- আমাদের ৭ বীরশ্রেষ্ঠর গল্পগুলোও পড়তাম বারবার। যতবার পড়তাম ততবারই আবেগে আপ্লুত হতাম। দেশের জন্য তাঁদের এ আত্মত্যাগের গল্প জেনে অজান্তেই স্যালুট জানাতাম হৃদয় থেকে। নিজে সুযোগ পেলে এমন কিছু করার ইচ্ছেটা হতো প্রবল। একাত্তরের শহীদ আজাদ আর তার মায়ের গল্প, শহীদ রুমি আর জননী জাহানারা ইমামের গল্পগুলোও একই রকম আলোড়িত করে মন। দেশপ্রেমী এসব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে।

দেশের জন্য যত ত্যাগের গল্প যতদিক থেকে কানে আসে বা দৃষ্টিগোচর হয়, সবক্ষেত্রেই দেহমনে একটা ভালো লাগার নাচন ওঠে। এটা ঠিক কী ধরনের অনুভূতি তা বলে-কয়ে প্রকাশ করতে পারব না। কেউ পারবে বলে বিশ্বাসও হয় না। যুদ্ধ আর মানবিক প্রতিবাদী ঘটনার বাইরে দেশপ্রেমের আরও অনেক ঘটনার প্রকাশ ঘটে নানা ঘটনায়, নানা ভাবে। মাশরাফি বিন মুর্তজার গল্পগুলো যেমন আমাদের বলে, দেশপ্রেম আছে হাঁটুর মধ্যেও! তাঁর হাঁটু আছে, হাঁটুর ভেতর আছে জমাট পানি! সুঁচ দিয়ে টেনে টেনে সেই পানি বের করে আনতে হয় দেশপ্রেমী মাশরাফিকে! তারপর তাঁকে আবার দৌড়াতে হয় ২২ গজের দিকে। উইকেট নিতে হয়, চার-ছয় হাঁকাতে হয়, জেতাতে হয় দেশকে। এসবের জন্য যে পরিমাণ দেশপ্রেম দরকার তা মাশরাফির আছে, আমার নেই। সত্যি বলছি, আমার নেই। আমি হয়ত একসময় বলতাম, ‘থাক, অনেক হয়েছে- আর আমার হাঁটুর বারোটা বাজানোর দরকার নেই।’ কিন্তু মাশরাফি বলেন- ‘ঠিক আছে, দেশের জন্য যদি প্রয়োজন হয়, আমি টেস্টেও আবার বোলিং করতে রাজি!’ বিস্ময়ে বিস্ময়ে আপনি হয়ত নির্বাক হয়ে যাবেন, কিন্তু আপনাকে আমাকে নতুন নতুন বিস্ময় উপহার দিতে মাশরাফিদের কোন ক্লান্তি নেই। দেশপ্রেম বিষয়ে আমরা কেবল অফিসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে আলাপ করি, মাশরাফিরা তা করে দেখান মাঠে, লড়াইয়ের ময়দানে।

গত শনিবার মরুর বুকে আরেকজনকে দেখলাম, যিনি হয়ত মাশরাফি নন, তবে তাঁকে মনে রাখতে বলছেন, ‘হ্যাটসঅফ’ বলছেন, স্বয়ং মাশরাফিই! জাতীয় দলে পূর্বসুরি থাকায় একসময় যাকে শুনতে হতো স্বজনপ্রিয়তার অপ্রিয়, মিথ্যা অপবাদ; দেশপ্রেম নাকি ক্যারিয়ার এটা নিয়েও শুনতে হযেছে কথা, যখন বিদেশী লিগ খেলতে গিয়েছিলেন! সেই তামিমকে মাশরাফি মনে রাখতে বলছেন কেন? কারণটা গোটা বাংলাদেশেই এমনকি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেও এখন পরিষ্কার- তামিম ইকবাল খান দেখিয়েছেন, তিনি ক্রিকেটটা খেলেন দেশের জন্যেই; দেশপ্রেম তাঁর মধ্যে ততখানি আছে, যতখানি থাকা উচিত, কিংবা হয়ত তার চেয়ে একটু বেশিই। পৃথিবীর ইতিহাসে, ক্রিকেট খেলার ইতিহাসেই মাত্র কয়েকজন মানুষ এমন কিছু করে দেখিয়েছেন ২২ গজের মধ্যে। দুদিন ধরে বাকিদের অবদান দেখে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, তামিম যা করেছেন তা সবার উপরে স্থান পাবে। সুতরাং তামিম ইকবাল খান ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অবদানটি রেখে ফেলেছেন তাঁর দলের জন্য, তাঁর দেশের জন্য।

কী করেছেন তামিম? আমি দেখেছি। আপনি দেখেননি তো? সমস্যা নেই, ইউটিউবে বা ফেসবুকে ঢুঁ মারলেই দেখতে পাবেন। তবু এখানে একবার বলি। তামিম ইকবাল শ্রীলংকার বিপক্ষে এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচে মাত্র ২ রান করার পর সুরঙ্গ লাকমলের বলে হাতে আঘাত পান। তাঁকে মাঠ থেকে সরাসরি হাসপাতালে যেতে হয়। অন্তত ৬ সপ্তাহের বিশ্রামের ডাক্তারি নির্দেশ নিয়ে তিনি ফিরে আসেন ড্রেসিং রুমে। এদিকে দলের অবস্থা তখন খুব খারাপ। এক প্রান্তে মুশফিক ছাড়া বাকিরা কেবল আসা যাওয়ার মধ্যে আছেন। রান দুইশ’ হবে কি না সেই সন্দেহ। এই রান দিয়ে তো আর শ্রীলংকার বিপক্ষে জেতা যাবে না। দুঃখে তামিমের মনটা একেবারে মরে গেল; এক তো নিজের এশিয়া কাপ শেষ, তারওপর দল হারবে! ব্যথাতুর অনুভূতির এই সময়ে মাশরাফি হঠাৎ তামিমকে বলেই ফেললেন, ‘বাকিরা আউট হয়ে গেলে আর মুশফিক থেকে গেলে ননস্ট্রাইকে তুই নেমে যাস!’ উসখুশ করা তামিম যেন এর অপেক্ষাতেই ছিলেন; ভাঙা হাত নিয়ে, আরো ক্ষতির ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নেমে পড়লেন মাঠে। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় থেকে গ্যালারি আর ধারাভাষ্যকার- সর্বত্র মহা বিস্ময়- এক হাতে ব্যাট করতে নামছেন তামিম! এ যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না! কেবল নামাতেই শেষ নয়, তামিম ঠেকালেন লংকান ফাস্ট বোলার লাকমলেরই আরেকটি বাউন্সার- এক হাতেই! এই দৃশ্য যারা দেখেননি আমি নিশ্চিত, তাঁরা বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে আবেগময় অধ্যায়টি দেখা থেকে বঞ্চিত হলেন। একটি বল, একটিমাত্র ডট- গোটা বিশ্ব এখন মেতে আছে সেই বল আর তামিমকে নিয়ে। অবিশ্বাস্য এ গল্প যারাই পড়ছেন, চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, বুকের ভেতরে কী যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। সেই একটি বল ঠেকানোয় বাংলাদেশ পায় আরও ৩২টি রান। মুশফিক একাই করেন সবগুলো রান। তবু রান না করা তামিমের ভূমিকাটাকেই কুর্ণিশ করছে ক্রিকেটবিশ্ব। দেশপ্রেমের এমন দৃষ্টান্ত যে নজিরবিহীন, অন্তত পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় তামিম থাকবেন দেশপ্রেমীদের সবার ওপরে।

আমাদের দেশে প্রায়ই ক্রিকেটারদের কারও কারও দেশপ্রেম আর কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। খারাপ করলে তাদের বিরূপ সমালোচনায় একরকম ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু আমার সবসময় এইটুকু বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, আমাদের কোনো ক্রিকেটার অন্তত জাতীয় দলের হয়ে খেলতে গিয়ে এতটুকু কম দেন, কম চেষ্টা করেন। কারণ তিনি বা তাঁরাও তো রক্ত মাংসের মানুষ, তাঁদেরও তো দেশ এটি। দেশপ্রেম তাদের ভেতরেও তো সমানভাবে থাকে। আমার বিশ্বাস, সবাই সর্বোচ্চটাই চেষ্টা করেন, হয়ত কখনো কখনো তারা পারেন না, ব্যর্থ হন। নতুন করে এই বিষয়টিই স্পষ্ট করে দিলেন তামিম ইকবাল। আমরা যেন এটি ভুলে না যাই- আমরা যেন তামিমকে ভুলে না যাই, মাশরাফি সেটাই বলেছেন!

এই এশিয়া কাপে এবং আগামীতে আরও অনেক খেলা হবে, আরও অনেকবার দেশের হয়ে লড়াই করবেন টাইগাররা। সেসব লড়াইয়ে আমরা চাইব সবগুলোতেই জিত হোক। কিন্তু যদি দু’একটাতে হার হয়, আমরা যেন আমাদের দেশকে গৌরব এনে দেয়া সূর্যসেনাদের মুণ্ডুপাত না করি, যেন তাদের পরিবার পরিজন আত্মীয়স্বজনকে গালি না দিই। আমরা সবসময় তাদের সাহস দেব, তারা যেন বুঝতে পারে, ১৬ কোটি মানুষ তাদের পেছনে আছে, তাদের কোনো ভয় নেই। তাহলে দেখবেন নির্ভিক এই সেনারা একদিন আমাদের জন্য সবকিছু জয় করে আনবে। এশিয়া কাপ আনবে, বিশ্বকাপও আনবে। শুধু একটু তাদের পাশে থাকুন, তাদের কীর্তি মনে রাখুন।

লেখক: সাংবাদিক

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা        

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়