ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

একাত্তরের যে নৃশংস ঘটনা শুনে এখনো শিউরে ওঠে মানুষ

রুমন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১৩ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একাত্তরের যে নৃশংস ঘটনা শুনে এখনো শিউরে ওঠে মানুষ

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি: একাত্তরের ১৩ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের বড়ইতলায় রক্তের স্রোত নেমেছিল। বড়ইতলার সে লোমহর্ষক গণহত্যার স্মৃতিচারণ শুনে এখনো শিউরে ওঠে মানুষ।

এই গ্রামে পাক হানাদাররা স্থানীয় রাজাকারদের মদদে নির্মমভাবে হত্যা করে কয়েকশ’ গ্রামবাসীকে। বড়ইতলার স্মৃতিস্তম্ভ আজো স্মরণ করিয়ে দেয় ইতিহাসের নৃশংসতম ওই গণহত্যার কথা।

সেই দিন পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে একসঙ্গে হত্যা করে ৩৬৫জন নিরীহ মানুষকে। জ্বালিয়ে দেয় কয়েকটি গ্রাম। দেশের জন্য জীবন দিলেও, ওইসব হতভাগ্য লোকজন স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও পাননি শহীদের মর্যাদা।

স্থানীয় প্রবীণরা জানান, একাত্তরের ১৩ অক্টোবর সকালে পাকসেনারা একটি ট্রেনে এসে নামে বড়ইতলা গ্রামের কাছে। নেমেই তারা স্থানীয় রাজাকারদের নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে একটি সমাবেশ করার চেষ্টা চালায়। এ সময় এক পাকসেনা দলছুট হয়ে পড়ায় রাজাকাররা গুজব রটিয়ে দেয় তাকে হত্যা করা হয়েছে। এরপরই হিংস্র পশুর মতো নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী।

বড়ইতলা, চিকনিরচর ও দামপাড়াসহ আশপাশের এলাকার পাঁচ শতাধিক লোককে ধরে এনে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেল লাইনের পাশে জড়ো করে তারা। এক পর্যায়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় ৩৬৫ জনকে। এ সময় আহত হয় দেড় শতাধিক ব্যক্তি।

বড়ইতলা স্মৃতিসৌধটি যেখানে তৈরি করা হয়েছে সে জমিটি দান করেছিলেন স্থানীয় মো. মর্ত্তুজা আলী। আর সেই জমির উপরেই দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান স্মৃতি সৌধটি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বর্তমান সরকার স্মৃতিসৌধটির আংশিক কিছু কাজ করলেও পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পারেনি। দিনের পর দিন এ স্মৃতিসৌধটি জরাজীর্ণ অবস্থায় পরে আছে। ১৩ অক্টোবর ছাড়া কখনও এ জায়গা বা স্মৃতিসৌধটির খোঁজ কেউ রাখেনা। ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা বিবেচনা করে, স্মৃতিসৌধটি রক্ষার জন্য বাউন্ডারী, গেইট ও একটি পাঠাগারের দাবি জানান তিনি।

পুরো বড়ইতলা ও আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক গণকবর। প্রতিটি পরিবারই হারিয়েছে কোনো না কোনো স্বজনকে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পূর্বচিকনিরচর গ্রাম। এখানকার বহু মানুষকে হত্যাসহ জ্বালিয়ে দেওয়া হয় পুরো গ্রামটিকেই। কিন্তু স্মৃতিস্তম্ভে গণহত্যার শিকার লোকজনকে শহীদ উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে তাদের দেওয়া হয়নি শহীদের মর্যাদা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে দেওয়া হয়নি কোনো ধরণের সহায়তা।

বেয়নেটের আঘাতে আহত হয়ে গণহত্যার ঘটনায় সেদিন সোভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া চিকনিরচর গ্রামের মোমতাজ উদ্দিন বলেন, ‘পাকসেনারা আমাকে ও আমার ভাইকে রাস্তা থেকে ধরে বড়ইতলা নিয়ে যায়। হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে একজন পাকসেনা আমাকে বেয়নেট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে গুরুতর আহত হয়ে অচেতন হয়ে মাটিতে লাশের স্তুপের উপর পড়ে যাই। পাকসেনারা আমি মারা গেছি মনে করে ফেলে রেখে যায়। পুরো একদিন আমি লাশের স্তুপের মধ্যে পড়েছিলাম। পরদিন একজন মহিলা আমাকে লাশের স্তুপ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।’

স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন গণহত্যার স্থানটি অবহেলায় পড়ে থাকার পর ২০০০ সনে শহীদদের স্মরণে উক্ত স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। জেলা পরিষদের উদ্যোগে বড়ইতলায় ৬৬৭ বর্গফুট এলাকা জুড়ে নির্মিত হয় ২৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি স্মৃতিসৌধ। মূল সৌধের পাশে বড়ইতলা গণহত্যায় শহীদদের নাম সম্বলিত দু’টি সু-উচ্চ পিলার। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো, মূল সৌধের পাশে দু’টি সু-উচ্চ পিলারে বড়ইতলা গণহত্যায় দেড় শত শহীদদের নাম সম্বলিত ফলক লাগানো হলেও এখন পর্যন্ত বাদবাকি শহীদদের নাম সংগ্রহ করে তাতে উঠানো হয়নি। এছাড়া নিম্নমানের দায়সারাভাবে লেখার কারণে অধিকাংশ নামই মুছে গেছে ফলক থেকে। এখনও বড়ইতলার শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা সংগ্রহ করে ফলকে না উঠানোয় ক্ষোভ রয়েছে শহীদ পরিবারের সদস্যদের মাঝে।

জেলা প্রশাসক সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘এ হত্যাকান্ডটি একটি নৃশংসতম ঘটনা। বড়ইতলায় একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে যেখানে সকলের নাম নেই। আমরা চেষ্টা করছি আরো যারা মারা গিয়েছেন তাদের নাম সংগ্রহ করে সেখানে যুক্ত করতে। এছাড়া এ হত্যাকান্ডে স্থানীয় যে সকল রাজাকার, আলবদররা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে যেন বিচারের আওতায় আনা হয়, সে ব্যাপারেও মন্ত্রণালয়ে কথা বলব।’

এলাকাবাসীর অভিযোগ এ তালিকাটিও অসম্পূর্ণ। এসব নিয়ে আক্ষেপ, ক্ষোভ ও হতাশার শেষ নেই তাদের। গণহত্যার শিকার লোকজনকে শহীদের মর্যাদা, তাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধটির সংস্কার ও স্থানীয় রাজকারদের বিচার এবং সেই সাথে দিনটিকে সরকারিভাবে পালনের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।




রাইজিংবিডি/কিশোরগঞ্জ/১৩ অক্টোবর ২০১৮ /রুমন চক্রবর্তী/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়