ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

এসেছে আনন্দময়ী ।। তাপস রায়

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০১, ১৯ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এসেছে আনন্দময়ী ।। তাপস রায়

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

গত শরতে কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, শরত প্রেমের ঋতু। আমি সবিস্ময়ে জানতে চেয়েছিলাম, বসন্ত নয়?
তিনি উহু উচ্চারণে আকাশের দিকে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, এমন নীল ছড়ানো আকাশ আর কবে দেখা যায়?
আমি বললাম, শুধু এ কারণেই!
তিনি বললেন, নীল আকাশে পেঁজো তুলোর মতো দলছুট মেঘগুলো মনটা নরম করে দেয়।
আর?
কাশবনে বাতাসের দোল।
আর?
আর ওই যে, বাঁশ-কাপড় দিয়ে পূজার প্যান্ডেল তৈরির তোড়জোড়, প্রতিমার শরীরে শিল্পীর একের পর এক মাটির প্রলেপ, ঢাকের বাড়ি- এ সবই তো শরতের বৈশিষ্ট্য।
এবার আমার মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার দুর্গাপূজার কথা। এই যান্ত্রিক নগরে বহুমুখী শব্দদূষণে ঢাকের শব্দ কান অবধি পৌঁছায় না। বাস-ট্রাক-ট্যাক্সির ধোঁয়ায় চাপা পড়ে যায় কাশফুলের ঘ্রাণ, তারপরও বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় ‘পূজা আসছে’, ‘পূজা আসছে’ রব। মন্দিরে মন্দিরে উলুধ্বণি এবং শঙ্খের সুরে বেজে ওঠে আনন্দময়ীর আগমনী গান। কৈলাস থেকে মা একা আসেন না। সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে আসেন। এ এক আশ্চর্য রূপক! তাকে হৃদয়ে ধারণ করেই ধরণীতে বইছে আনন্দধারা। পাঠক, শারদ উৎসবের এই আনন্দযজ্ঞে আপনার আমন্ত্রণ। এখানে কেউ ব্রাত্য নয়, নয় অপাঙ্ক্তেয়।  

দুর্গা পূজা সানতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। যে কারণে এর আয়োজনের ব্যাপকতা সহজেই চোখে পড়ে। এ সময় বাবা, জেঠুরা যেমন লিস্ট ধরে কেনাকাটায় তাল মেলাতে হিমশিম খান, মা কাকীমারাও কোমরে আঁচল গুজে খই, মুড়িতে গুড়ের পাক দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ব্যস্ততা টিনএজদেরও কম নয়- ষষ্ঠী থেকে দশমী, পাক্কা পাঁচদিনের প্ল্যানিং। একটু এদিক ওদিক হলেই পুরোটাই মায়ের ভোগে। এই অভিশাপ এ সময় শত্রুও বুঝি দেয় না। তারপরও তাদের চাই পারফেক্ট প্ল্যানিং। কখন কোথায় বেড়ানো, কার সঙ্গে বেড়ানো, সঙ্গী বিশেষ কেউ থাকলে তো কথাই নেই। পরিবার সঙ্গে থাকলে এক রকম সাজ, তার সঙ্গে অন্যরকম; দেখাটা হবে কোথায়, ফুলপিসির সঙ্গে দেখা হয় না এক বছর, তাকেও তো একবার দর্শন দিতে হবে- চলতে থাকে মহাপরিকল্পনা। বাড়ির ছোটদের অবশ্য এতো হ্যাপা নেই। পূজার ছুটি। তারা এমনিতেই হ্যাপি। আনন্দে তাদের এখন পথ হারিয়ে কোন বনে যাই অবস্থা! সেই আনন্দের ষোলো কলা পূর্ণ হয় নতুন জামা পরে মণ্ডপে মণ্ডপে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে। আর রাতে পাড়ার প্যান্ডেলে নাচাগানা, পূজার এ ক’দিন- সে তো কুড়িয়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা!

বৈশাখের পর থেকেই গিন্নির গুঞ্জন শোনা যায়, ডিপ ফ্রিজটা এবার আর না কিনলেই নয়। মোবাইলটার চার্জ থাকে না, চেঞ্জ করতে হবে। পূজায় নতুন জামাকাপড় কম হবে না, সেগুলো ধোবে কে? ওয়াশিং মেশিনটা কিনলে হয় না?

বৈশাখের এই গুঞ্জন আশ্বিনের শুরুতে আল্টিমেটামে রূপ নেয়। কারণ কেনাকাটার একটা উপলক্ষ লাগে। পূজা বিলক্ষণ সেই উপলক্ষ। কর্তাকে তখন ক্যালকুলেটর নিয়ে বসতে হয়। গিন্নির দেয়া তালিকায় পাজামা থেকে প্লাজমা সবই থাকে। এরপর ছেলেমেয়ের বায়না। সেগুলো না মেটালেই হ্যাভি মেটাল ব্যান্ডের মতো শুরু হয়ে যাবে হইচই। তখন জিভে চুকচুক শব্দ তুলেও কাউকে বশে আনা যাবে না। তাছাড়া বাবারা সতেরো দোকান ঘুরে ‘বাপরে বাপ’ বলে ঘেমে নেয়ে সন্তানের জন্য পছন্দের জিনিস কেনেন কেন? সেটা ওদের হাসিমুখ দেখবেন বলেই। আত্মতৃপ্তিটা ওখানেই। পূজার এ-ও এক আনন্দ।

পূজার কেনাকাটার তৃপ্তি আরো আছে। সেটা অপ্রকাশ্য। এ সময় আত্মীয়-স্বজনদের জন্য কিছু না কিছু কিনতে হয়। এই মোবাইলের যুগে অনেক আত্মীয়তাই তো ফিকে হয়ে গেছে। সম্পর্কের প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু। সেই প্রদীপের সলতেতে বৎসরান্তে একবার হলেও তেল জোগায় পূজার উপহার। কর্তা যখন গিন্নির বড় ভাইয়ের জন্য পূজার পাঞ্জাবি কিনছেন, তখন এর ফিরতি উপহার তিনিও পাবেন এটা ধরে নেয়া যায়। চতুর কর্তা এ কারণে নিজের জন্য কিছুই কিনতে চান না। অথচ কুটুম ধরে ধরে কেনাকাটা চলতেই থাকে। এখানেই শেষ নয়, গৃহকর্তা যখন ধরে নেন পাকাপাকিভাবে কেনাকাটা সব শেষ, তখনই আসে কাঁচাবাজারের প্রশ্ন। পূজার কাঁচাবাজার একটু ব্যতিক্রম বইকি! কেননা এ সময় অতিরিক্ত কিনতে হয় চিড়া, মুড়ি, খই, দুধ, চিনি, গুড়, নারিকেল, দই, মিষ্টি, সন্দেশ আরো কত কী!

মা দুর্গাকে দেবতারা সাজিয়েছিলেন। নাগরাজ বাসুকি দিলেন হার, গিরিরাজ হিমালয় দান করলেন দেবীর বাহন সিংহ। ক্ষীরসমুদ্র দেবীকে দিলেন মুক্তার মালা, নতুন কাপড়, দশ হাতের জন্য বলয়, বাহুতে বাজু, পায়ে নূপুর আর আংটি। আপনার সাজ কেমন হবে?

বুঝেশুনেই বলছি, উৎসবে চাই উজ্জ্বল রং। কেননা পূজার এ কয়দিন জমিয়ে মাস্তি হবে। তাই বলে হলটার নেক টপ ও ড্রেন পাইপ জিনস অথবা স্কিন টি শার্ট পরে অঞ্জলী দিতে মন্দিরে গেলে অনেকের চোখ কাপালে উঠে যেতে পারে। মা-কাকীরাই বা মানবেন কেন? এর সহজ সমাধান দিচ্ছে ফ্যাশন হাউসগুলো। তারা পূজার কথা মাথায় রেখে গত কয়েক বছর ধরে পোশাকের রং ও নকশা নির্বাচন করে পোশাক তৈরি করছে। সেখান থেকে পছন্দের পোশাকটি বেছে নেয়া যেতে পারে। এ ছাড়া সুকুমার রায় যেভাবে বলে গেছেন:

‘ফিনফিনে জামা ধুতি,
চরণে লপেটা জুতি জুরিদার
এ হাতে সোনার ঘড়ি,
ও হাতে বাঁকান ছড়ি,
আতরের ছড়াছড়ি চারিধার’
বাবুদের জন্য এটাও চলতে পারে। ভেবে দেখুন, এই আপনি কলেজে, আড্ডায়, বন্ধুদের সঙ্গে যেখানে রাফ অ্যান্ড টাফ, সেখানে হঠাৎ করে এই সাজে মায়ের সঙ্গে অঞ্জলী দিতে গেলে সবাই কেমন চমকে তাকাবে। আপনার চিরাচরিত স্টাইল স্টেটমেন্ট একদিনের জন্য বদলে ফেললে ক্ষতি কি? উল্টো দেখবেন বন্ধুমহলে তো বটেই প্রিয় মানুষটির মনমহলে আপনিই হয়ে উঠবেন আলোচনার বিষয়। মা-ও তখন দেখবেন ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলে কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে মনে মনে বলবেন, ঠাকুর এতদিনে ছেলের সুমতি দিলে!

শুভ মহালয়া থেকেই দুর্গা পূজার দিন গণনা শুরু। ষষ্ঠীতে বোধন, সপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ, অষ্টমীতে কুমারী পূজা, নবমীতে হোমযজ্ঞ এবং দশমী তিথিতে বিসর্জন। পাঁচদিন শুধু আনন্দ আর আনন্দ। এই আনন্দ মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে প্রতিমা দেখার মধ্য দিয়েই পূর্ণতা পায়। যে কোনো শহরে ঘুরে ঘুরে পূজা দেখতে চাইলে চুক্তিভিত্তিক রিকশা অথবা অটোরিকশা ভাড়া করে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। বন্ধুরা হুল্লোড় করে এক অটোতে ঘুরে ঘুরে নিমকি, গজা মুখে পুরে পুরে পূজা দেখার আনন্দের তুলনা হয় না। এ দিন না হয় ঘরে ফিরতে রাত দুপুর হলো তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।

রাজধানীতে অবশ্য একদিনে সব মণ্ডপ দেখা সম্ভব নয়। এ জন্য আগে থেকেই পরিকল্পনা করে নিতে হবে। উত্তরা, গুলশান, ফার্মগেট, ধানমন্ডি, মিরপুর একদিন হলে, পরদিন জগন্নাথ হল, ঢাকেশ্বরী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন হয়ে পুরান ঢাকা- ব্যাস কোর্স কমপ্লিট। পুরান ঢাকাতেই মিলবে পূজার সত্যিকারের আমেজ। ছোট্ট গলিপথের ওপর মঞ্চ বানিয়ে বিভিন্ন নকশার প্রতিমা রাতের আলোক সজ্জায় অনিন্দ্য সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতিক হয়ে ওঠে।

রাজধানীর পাশে কোথাও পূজা দেখতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ চমৎকার জায়গা। অবশ্য এবারে পূজায় দেশের বিখ্যাত কোনো মন্দিরে যাওয়ার প্ল্যানও আপনি করতে পারেন। এতে রথ দেখা এবং কলা বেচা দুটোই হবে। অর্থাৎ পরিবার নিয়ে ট্যুরও হলো, পূজা দেখাও হলো। সুতরাং তালিকায় রাখুন বিখ্যাত কিছু মন্দিরের নাম।

শ্রী শ্রী চণ্ডী তীর্থ। চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে বোয়ালখালীতে এর অবস্থান। ঐতিহাসিক মতে ব্রহ্মবৈবর্ত পূরাণে মেধস মুনির যে আশ্রমের কথা রয়েছে এটিই সেই আশ্রম। মর্ত্যলোকে এখানেই হয়েছিল দেবী দুর্গার প্রথম পূজা। আরেকটি ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত জায়গা রাজশাহীর তাহেরপুর। অবিভক্ত বাংলায় সর্বপ্রথম শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা করেছিলেন রাজা কংস নারায়ণ এই তাহেরপুরে। পরিবার সমেত মায়ের প্রতিমা গড়ে পূজা করার এই রীতির সূচনা তখন থেকেই। এটি ষোড়শ শতাব্দির শেষের দিকের ঘটনা। যদিও সেই মন্দিরটি এখন আর নেই। তবুও দেখে আসতে পারেন সেই পুণ্যভূমি।

মা ভবানীর মন্দির উপমহাদেশের অন্যতম শক্তিপীঠ। পূরাণ মতে বগুড়ার ভবানীপুরে সতী মাতার ৫১টি দেহ খণ্ডের মধ্যে থেকে বাম পাঁজর মতান্তরে বাম পায়ের নুপূর এসে পড়েছিল। এই মন্দিরে এখনও দুর্গা পূজা হয়। কান্তজির মন্দিরের নাম না শেনার কোনো কারণ নেই।  দিনাজপুরে অবস্থিত এই মন্দিরটি দেশের সবচেয়ের দৃষ্টিনন্দন মন্দির। এই মন্দিরের প্রতিমা কতটা দৃষ্টিনন্দন হয় একবার গিয়ে দেখেই আসুন না।

সমুদ্রবেষ্টিত মহেশখালী দ্বীপের অন্যতম দর্শনীয় পূণ্যস্থান আদিনাথ মন্দির। সমুদ্রের পাড়ে প্রায় ২০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের ওপর মন্দিরের অবস্থান। পুরাণ অনুযায়ী মহেশখালী দ্বীপে দেবতা শিবের আগমন ঘটে ত্রেতা যুগে। রাম-রাবণ যুদ্ধের সময় শিবের কৃপা লাভের জন্য রাবণ কৈলাস পর্বত থেকে শিবকে আনতে যান। রাবণ শর্ত ভঙ্গ করায় রওনা দিয়েও পথিমধ্যে শিব মৈনাক পাহাড়ে থেকে যান। সে অনুযায়ী আদিনাথ মন্দিরের এই পাহাড়ের নাম মৈনাক। মৈনাক থেকেই মইশখালী এবং আরো পরে মহেশখালী শব্দের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়।

পটুয়াখালী দয়াময়ীর মন্দিরের কপাল ঠেকিয়ে আসতে পারেন। ১২০৮ সন থেকে সেখানে পূজা হয়ে আসছে। মৌলভীবাজার জেলার রাজনগরের পাঁচগাঁওয়ে দেবী দুর্গার পূজা অতটা প্রাচীন  না হলেও বেশ ব্যতিক্রম। একমাত্র এই মন্দিরেই লাল রঙের প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করে পূজা করা হয়। দেশের কোথাও আপনি আর এমনটি পাবেন না। সতের শতক থেকে সেখানে এভাবে পূজা হয়ে আসছে। কল্যান্দী সর্বজনীন দুর্গা মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামেন্দ্র রায় চৌধুরী। তিনি প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে ১ একর জায়গায় মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এটিও প্রসিদ্ধ দুর্গা মন্দির।

সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী পঞ্চমন্দিরও কম জাগ্রত নয়। সেখানেও জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গা পূজা হয়। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দিরের কথাই বা ভুলি কী করে? পূণ্যতীর্থ হিসেবে মন্দিরটি ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। মায়ের সঙ্গে মায়ের মন্দিরের কথাও তো জানতে হবে। এখন না হলে আর কখন? সেই জানাটাই না হয় হোক এবার।

কথায় বলে, রসুইঘরে এ সময় নাকি চুলার আগুন নেভে না। তৈরি হতে থাকে একের পর এক পদ। সত্যি বলতে কী, পেট পূজা ছাড়া দুর্গা পূজা ভাবাই যায় না! মা স্বয়ং এসেছেন দুয়ারে। ঘরে ঘরে মা, মাসিরা তাই ঢেকিতে পাড় দিচ্ছেন। কেউ বানাচ্ছেন নারকেলের নাড়ু–, কেউ আবার তিল, মুড়ি, খইয়ে দিচ্ছেন গুড়ের পাক। প্যাঢ়া, সন্দেশ তো আছেই- পেট পূজার সে এক মহা আয়োজন। তবে এই ফাঁকে বলে রাখি, রেসিপির অধিকাংশই কিন্তু নিরামিষ। সেটা ঘরে বাইরে সবখানেই। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সামনে যে হোটেলগুলো দেখবেন সেখানেও পূজার ক’দিন দেদার বিক্রি হবে ফুলকো লুচি আর সাত পদের সবজি দিয়ে তৈরি নাবড়া। আহ্! যেন অমৃত। ঘন বুটের ডালের ঘনচক্করেও এ সময় পড়ে যেতে পারেন। আর সময়মতো মণ্ডপে যেতে পারলে মার দর্শন যেমন মিলবে, সঙ্গে বোনাস মিলে যাবে মায়ের ভোগ- তিন পদের খিচুড়ি, লুচি আর পূজার তুলসী পাতা দেয়া পায়েস।
পিৎজা, কোক, বার্গার অথবা বিরিয়ানিও যে এ সময় চলে না তা কিন্তু নয়, তবে এ জন্য নামজাদা ফাস্টফুড শপ, বড় বড় রেস্তোরাঁ তো রয়েছেই। বন্ধুবান্ধব নিয়ে সটান চলে যান, মানিব্যাগে টান না পড়া পর্যন্ত চলতে থাকুক ভুরিভোজ- কে নিষেধ করেছে? তবে সাবধান, রসনা তৃপ্তির বাসনায় লাগাম টানতে না পারলে পরে কিন্তু ভুগতে হতে পারে আপনাকেই।

টিনএজাররাই পূজার পার্টির প্রধান নাচিয়ে। একে তো ঢোলে বাড়ি তার ওপর এরাই নাচুনে বুড়ি। সুতরাং পার্টি হবে- সপ্তমীর রাতে সতীশদের পাড়ার মণ্ডপ তো, অষ্টমীতে সুনীলদের মণ্ডপে মাস্তিও জমবে। এ জন্য যা লাগে হাতের কাছেই মিলবে ওই দশভূজার মন্দিরে। সাউন্ড বক্সের স্পিকারগুলোর তো ত্রাহী অবস্থা। সারাক্ষণ শুধু তড়পাচ্ছে। ঢাক বাজছে, ঢুলি নাচছে। বন্ধুরা মিলে নেচে গেয়ে পার্টি জমানোর এই তো সময়। একটু লজ্জা ভেঙে ধুপতি নিয়ে আরতি করলে লাভটা কিন্তু আপনারই। বন্ধুরাও দেখুক আপনার ক্যারিশমা। কারিশমারাও ভাবতে থাকুক সামথিং সামথিং। হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে যাওয়া, একটু হাসি- পূজার পাঁচদিন দেদার ঘটবে। ঘটুক। গত এক বছরে মুখ ফুটে যে কথা বলা হয়নি সে কথাটিও এই পূজায় ফুটুক। এর চেয়ে ভালো উপলক্ষ আর হয় না।
ফ্যামিলি পার্টিতে জামাইবাবু টাইপ কাউকে সঙ্গে রাখলে জমবে ভালো। চাই কি খরচটাও উঠে আসতে পারে। বাবা-কাকাদের পাশে বসিয়ে তাদের ছোটবেলার পূজার গল্প শুনতে ভালোই লাগবে। হারমোনিয়ামের ধুলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে আসর জমিয়ে বসতে পারলে তো সোনায় সোহাগা। এ সময় ছোট ছোট গেমের আয়োজন করলে পার্টির আনন্দযজ্ঞে ঘি পড়বে নির্ঘাৎ।

পূজার সময় আসলে পারিবারিক গেট টুগেদারের মতো হয়ে যায়। ঘরে শুধু মা আসেন না, মায়ের ঘরে পূজার ছুটিতে অনেক ছেলেরাও ফেরে। কাছের-দূরের কুটুম দিয়েও বাড়ি ভরে ওঠে। কতদিন পর দেখা, আড্ডা জমবে না তাও আবার হয় নাকি? ফলে বাড়িতে আনন্দঘন পরিবেশ এমনিতেই তৈরি হয়ে যায়। পূজার আনন্দে এ আরেক আনন্দ।

দেবী দশভূজা। সেই হাতের অস্ত্রগুলো দেবতাদেরই দেয়া। ত্রিশূলটা দিয়েছেন মহাদেব। বিষ্ণু দিয়েছেন চক্র। অগ্নিদেব দিলেন শক্তি। বিশ্বকর্মা কুঠার, দেবরাজ ইন্দ্র দিলেন বজ্র ও ঘণ্টা। দেবী দশ হাত দিয়ে দশ দিক সামলান। আপনি দুই হাতে সামলাবেন কী করে? সামাজিকতা বলেও তো একটা কথা আছে! শেষের এই কথাটি বড়দের মুখ থেকে আপনাকেও শুনতে হতে পারে। পূজার ছুটিতে বাড়ি এসেছেন সবার সঙ্গে দেখা তো করতেই হবে। দুই বাড়ি পর নিমাই কাকা কেমন আছেন সেই খোঁজটিও নিতে হবে। ছোটপিসির সঙ্গে দেখা হয় না অনেক বছর। এই সেদিনও ফোন করেছিল- যেতে বলেছে। সেখানেও যেতে হবে। খালি হাতে নয়, পিসির জন্য শাড়ি নিয়ে।

পূজা এভাবেই আমাদের বন্ধনটুকু একেবারে ছিড়ে যেতে দেয় না। বিজয়া দশমী আমাদের আরো সামাজিক করে তোলে। সিঁদুর খেলা থেকে শুরু করে প্রণামী দেয়া অথবা নেয়া- সামাজিক না হয়ে উপায় আছে? শাখা, সিঁদুর অক্ষয় থাকুক- সিঁদুর পরিয়ে দিতে দিতে এই কল্যাণ কামনা করা হয়। বিবাহিতা মহিলারা এর মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার সঙ্গে নিজেদের আরো একাত্ম করে নেন। একাত্ম হয়ে কল্যাণ কামনা সর্বজনীন হওয়াই উচিত। আর এই সর্বজনীনতাই সামাজিকতা।

প্রতিমা ভাসিয়ে বাড়ি ফিরে আসার পর শুরু হয় প্রণামী পর্ব। বাড়ির বড়দের তো বটেই প্রতিবেশী বড়দের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেয়াটাই রেওয়াজ। উল্টো পাওয়া যায় অর্থকড়ী। তারপর একেবারে বিনাপয়সায় সব জায়গায় মিষ্টিমুখ। এই ফাঁকে আপনার প্রিয় মুখটিকে এক নজর দেখার উসিলায় সেই  বাড়িতে উপস্থিত হয়ে হবু শ্বশুর শাশুড়িকে ঢুপ করে একবার প্রণাম করে আসতে পারলে লাইন ক্লিয়ার হতে কতক্ষণ। তাছাড়া এক বছর যার মুখ দেখাদেখি বন্ধ, তাকে মুখে বলতে না পারেন ‘শুভ বিজয়া’ লিখে একটা এসএমএস তো অন্তত করতে পারেন এই বিজয়ায়। এতে বিজয় আপনারই হবে। দেখবেন কীভাবে গলতে শুরু করেছে সম্পর্কের জমাট বরফ। তবে বলে রাখছি, এ দিন ভুলেও ছোটদের কবলে পরবেন না। তাহলে প্রণামী দিতে দিতে আপনার প্রাণ বায়ু বেরিয়ে গেলে এ লেখা পড়বে কে?

দুর্গতি থেকে উদ্ধার করেন বলেই তিনি দেবী দুর্গা। সুতরাং অভ্যস্ত নন বলে সব এড়িয়ে যাবেন না। অন্যদিকে পূরাণ অনুযায়ী দুর্গম নামক অসুর বধ করেছিলেন বলেই তিনি দুর্গা। এক মায়ের শত নাম- কখনও পাবর্তী, কখনও কালিকা, কখনও চণ্ডী, উমা, হৈমতী, শিবানী আবার কখনও অম্বিকা, বাসন্তী। সব রূপেই মায়ের পূজা হয়। যার শেষ বিসর্জনে। বিসর্জনে বাজে বিদায়ের সুর। এ দিন বিজয়েরও বটে! কেননা বিজয়া দশমীর এই তিথিতেই শ্রী রামচন্দ্র রাবণকে বধ করেছিলেন। শেষ হয়েছিল অত্যাচারীর কাল। কালো মেঘ শরতের আকাশে এখনও লগ্ন হয়ে আছে। সেই দুশ্চিন্তায় না থেকে পূজার এই ক’টা দিন তেড়েফুঁড়ে জেগে উঠুন। জীবনের দুশ্চিন্তাগুলো দু’হাতে সরিয়ে রেখে শরতের নীলাকাশের মতো হাসি-আনন্দ-আড্ডায় গা ভাসিয়ে দিন। মেতে উঠুন শারদ উৎসবে। বহু দিন, বহু বছর পর যেন বলা যায়- সেবার পূজা দারুণ কেটেছিল!





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ অক্টোবর ২০১৫/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়