ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ওয়াজিউল্লাহদের টিকে থাকার লড়াই

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ২১ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ওয়াজিউল্লাহদের টিকে থাকার লড়াই

‘চিনতে পেরেছেন?’

‘হ্যাঁ, চেনা চেনা লাগছে। কবে, কোথায় যেন দেখেছি! ভালো আছেন?’

‘হ্যাঁ, ভালো আছি।’

ওয়াজিউল্লাহ খানের সঙ্গে আলাপচারিতা। চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা। পরনে কালো পাঞ্জাবি, সাদা চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবির বোতামগুলো খোলা থাকায় নিচে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি বেরিয়ে আছে। মাথায় ধবধবে টুপি। হাতে একটা স্টিলের লাঠি। খবর পেয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে এগিয়ে এলেন। আলাপেই বোঝা গেল স্মৃতি বেশ প্রখর। গড়গড় করে বলে গেলেন অনেক কিছু। ৮৯ বছর বয়সেও বেশ তরতাজা চটপটে এই মানুষটা এলাকায় মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিলেন একাধিকবার। এই বয়সেও খোঁজ রাখেন এলাকার মানুষের। সকলে ‘খান সাহেব’ বলে চেনেন। মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হলেও ভয়াল মেঘনা তার সেই সুদিন আর রাখেনি। নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে। এখন থাকেন ছেলের বাড়িতে; বেড়িবাঁধের পাশে।

বিকট ভটভট শব্দ। কালো ধোঁয়া উড়ছে ইঞ্জিন থেকে। ট্রলার ভিড়লো কাঠির মাথায়। খেয়াঘাটের যাত্রী অনেকজন। কিছু নামছে ট্রলার থেকে। কিছু উঠছে। এ সময় ঘাটে হুড়োহুড়িটা খানিক বেড়েই যায়। কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না। আগে না নামলে গন্তব্যে অটো মিলবে না; আবার আগে উঠতে না পারলে ট্রলারে জায়গা পাওয়া যাবে না। ভোলা সদর থেকে কাচিয়া দ্বীপে যেতে হলে এই ঘাট দিয়েই যেতে হয়। ওপারে যাদের বাড়িঘর আছে; তাদের আবার এপারেও আসতে হয় বিভিন্ন কাজে। স্বজনদের অনেকে এপারে থাকেন। আবার হাটবাজার করতেও এপারে আসতে হয়। কাঠির মাথা মাছঘাট থেকে আবার অনেকের মাছ ওঠে। 

ঘাটের নাম কাঠির মাথা। কে কী কারণে এই নাম দিয়েছিল; সে কথা স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারেন না। বেড়িবাঁধ থেকে রাস্তা চলে গেছে নদীর ধারে। রাস্তার দু’ধারে দোকানপাট। এখন দোকানপাট কমে গেছে। ভাঙনের আগের অনেক বড় বাজার ছিল এখানে। ভয়াল মেঘনা ভাঙতে ভাঙতে কত কিলোমিটার পেছনে চলে এসেছে; এখনও কাঠির মাথা নামটা রয়েই গেছে। এখানে বিগত বছরগুলোতে ভাঙনের ছবি যেমন দেখতে পেয়েছি; এখন আবার দেখছি গড়ার ছবি। মেঘনার মাঝখানে জেগেছে বিশাল চর। ভাঙনের কারণে গত কয়েক বছরে এখান থেকে অন্যত্র চলে গেছেন বহু মানুষ। ভাঙন ভোলা সদরের কাচিয়া ইউনিয়নটিকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। অথচ মূল ভূ-খ-ের সঙ্গেই ছিল ইউনিয়নটি।  

কাচিয়ার প্রবীণ বাসিন্দা ওয়াজিউল্লাহ’র সঙ্গে এই কাঠির মাথায়ই দেখা হয়েছিল বছর সাতেক আগে ২০১৩ সালে।  তখন তিনি ভাঙনের বৃত্তান্ত জানিয়েছিলেন, এক ছেলে ঢাকা চলে গেছে বলেও জানিয়েছিলেন। কথা বলতে গিয়ে নদীর মাঝখানে নিজের হারানো সেই পুরানো বাড়ির সীমারেখা টানার চেষ্টা করেছিলেন। সেবার এ এলাকায় ছিল ব্যাপক ভাঙন। মেঘনার গ্রাসে মানুষ ছুটোছুটি দেখা গেছে চারিদিকে। বাঁধ দিয়ে, ব্লক ফেলে এলাকার ভাঙন রোধ করা হয়েছে ঠিকই; কিন্তু মানুষের মনের সেই দগদগে ঘা কিন্তু শুকোয়নি। সম্পদশালী এক একটি পরিবার পথে বসে গেছেন। তাদেরই একজন ওয়াজিউল্লাহ খান।

টিনের দোতলা বাড়ি, বিশাল বাগানবাড়ি, সান বাঁধানো পুকুর, গরু, ছাগলসহ অনেক বড় এক বাড়ি ছিল ওয়াজিউল্লাহ খানের। এক বাড়িতে ৬টি ঘর ছিল। কালিকানগর গ্রামে ছিল তার এই বাড়ি। ৫ বার বাড়ি বদল করে এখন তিনি আছেন ষষ্ঠ স্থানে। ভয়াল নদীর পানি প্রবাহ বিক্ষুব্ধ হয়; সেইসঙ্গে ওয়াজিউল্লাহ খানেরা নিঃস্ব থেকে নিঃস্ব হতে থাকেন। নদী ভাঙে, আবার গড়ে। মূল ভূ-খ-ের সঙ্গে থাকা এক জনপদ কীভাবে আলাদা করে দিল, ওলটপালট করে দিল জনজীবন- এলাকার মানুষ ভাবতেই পারছেন না। গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে গেল, অবশেষে বছর বিশেক পড়ে নদীর মাঝখানে মাথা তুললো আরেক জনপদ। ওয়াজিউল্লাহদের জীবনের যুদ্ধ তবুও শেষ হলো না।

পড়ন্ত বিকেলে নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে মেঘনার তীরে হাঁটছিলেন ওয়াজিউল্লাহ। খবর পেয়ে ছুটে এলেন। কাঠির মাথার একটি চায়ের দোকানের বারান্দায় আলাপ। বয়সের ভারে ন্যূয়ে পড়েছেন। নদীর ভাঙনে সম্পদ হারিয়েছেন। শারীরিকভাবে শক্তিও হারিয়েছেন। কিন্তু মনোবল এখনও হারাননি। খান বংশের আভিজাত্যের সেই ভঙ্গিতেই কথা বলতে শুরু করলেন। কথার ফাঁকে চায়ের অর্ডার দিয়ে আবার চা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন- ‘চা নেন। আমরা আর কীভাবে আপনাদের আপ্যায়ন করতে পারি!’

ওয়াজিউল্লাহ বলতে থাকেন- এখন যেখানে নদীর কিনার, এখান থেকে অন্তত দশ মাইল দূরে ছিল প্রথম বাড়ি। ৩ মেয়ে ৫ ছেলে নিয়ে তার সংসার। জীবনে যা অর্জন করেছেন সবই নদীর গ্রাসে চলে গেছে। ভাঙনের কারণে ছেলেমেয়ের লেখাপড়াও ঠিকঠাক করাতে পারেননি। অভাবে পড়ে নামতে হয়েছে কাজে। ৫ ছেলের মধ্যে একজন শেখ ফরিদ ভাঙনের তীব্র সংকটকালে ঢাকায় গিয়েছিল কাজে। শেষ পর্যন্ত সে সেখানেই রয়ে গেছে। বাড়ি বদল করতে করতে জীবনের সব সঞ্চয় শেষ করেছেন ওয়াজিউল্লাহ। পুরানো বাড়িতে প্রায় তিন কোটি টাকার সম্পত্তি ছিল, বাবার কথার সঙ্গে পাশ থেকে যোগ করেন ছেলে কামাল উদ্দিন। তিনি তার বাবার সেই সাবেক অবস্থা দেখেছেন। মনে করতে পারেন গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছের কথা। ছোটবেলায় সেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশের কথা। বাবার সংসারে তাদের ছোটবেলাটা বেশ ভালো কাটলেও বড়বেলায় এসে তারা বিপাকে পড়েন।

কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ে যায় সাত বছর আগের কথা। সেদিন বাড়ির কথা জানতে চাইলে সত্তরোর্ধ ওয়াজিউল্লাহ খান ভয়াল মেঘনার দিকে আঙুল তুলে চোখ ছলছল দৃষ্টিতে বললেন ‘ওইখানে মোর বাড়ি ছিল। এখন কিছুই নাই। ভাঙ্গনের তাড়া খেয়ে শুধুু পালাই। বছরে কতবার যে পালাতে হয় তার হিসাব নেই। ভাঙ্গন কাছে এগিয়ে এলে বাড়ি সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজি।’ নদীর ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে তখনও পুরানো ভিটেমাটি খুঁজে ফেরেন বৃদ্ধ ওয়াজিউল্লাহ। আঙুল তুলে বোঝানোর চেষ্টা করেন এই নদীতে ছিল তার বাড়িঘর। অথচ এখন সেই ভুখ-জুুড়ে শুধু জলরাশি। তবুও তারই মধ্যে দূরের একটি জায়গায় আঙুল দিয়ে সীমারেখা টানার চেষ্টা করেন। যে জায়গাটায় এক সময় ছিল তার ঘর-গেরস্থলি। এখন সেই ঘর রাক্ষুসে মেঘনার অতলে। বারবার ঘর বাঁধেন একটু এগিয়ে, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই আবার বিলীন। সাত বছর পরে কথা বলতে গিয়ে ওয়াজিউল্লাহর চোখে পানি আসেনি। ‘অধিক শোকে পাথর’ বলে একটা কথা আছে না! তার অবস্থা হয় সেরকম হয়ে গেছে।

আলাপে আলাপে বলছিলেন, এক সময় সচ্ছল পরিবারের কর্তাব্যক্তি ছিলেন ওয়াজিউল্লাহ। সেকথা তার চেহারা আর কথাবার্তাই বলে দেয়। গ্রামের বিচার-সালিশি করতেন। এলাকায় সাবেক মেম্বার হিসাবে পরিচিতি রয়েছে তার। এলাকার মানুষের ভোটে নির্বাচিত মেম্বার ছিলেন একবার। বাবার পথ ধরেই বড় ছেলে মনির হোসেন ৩বার মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওয়াজিউল্লাহ খানের স্ত্রী শামসুন্নাহার, যার বয়স এখন ৭০, তিনিও একবার সংরক্ষিত আসনে নারী ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন একবার। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়লেও ওয়াজিউল্লাহ এখনও এলাকার খোঁজ রাখেন। জীবিকার তাগিদে এখনও তাকে যেতে হয় বাইরে। ভাবতে হয় পরিবারের কথা।

একজন ওয়াজিউল্লাহ খান ৮৯ বছরের দীর্ঘ জীবনে শুধু ভাঙন নয়, দেখেছেন আরও অনেক দুর্যোগ। ভাঙনে পাঁচবার বাড়ি বদল করতে গিয়ে সব হারিয়েছেন। অন্তত দশটা ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা করেছেন সারাজীবনে। এরমধ্যে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন ’৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে। সে প্রলয়ে এই এলাকার বহু মানুষ ভেসে গিয়েছিল। ওয়াজিউল্লাহ আশ্রয় নিয়েছিলেন গাছে। কাচিয়ার এই প্রবীন মানুষটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার মনে পড়ে উপকূলের এমন আরও কয়েকজনের কথা। হাইমচরের আবু সরদার, ঢালচরের জেবল হক, কুমিরার ক্ষীরমোহন জলদাস, তেলির চরের আলাউদ্দিন মাষ্টার, উড়িরচরে আবুল কাশেমসহ আরও অনেকজন একইভাবে জীবনের লড়াই করে টিকে আছেন। ক্ষীরমোহন জলদাস গ্রামের সর্দার হয়েও জীবনের শোচনীয় অবস্থার মধ্যেই পরপারে চলে গেলেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই মানুষদের জীবন বিপন্ন করে তোলে। 

কাচিয়া ইউনিয়নের কাঠির মাথা নামক স্থানে ভয়াল মেঘনার ভাঙ্গনে বিপন্ন মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল সে বছর। পথে যেতে যেতেই দুর্যোগের ক্ষতচিহ্ন দেখেছি। বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ সবখানেই প্লাবনের চিহ্ন দেখি। ফসলি মাঠ ডুবেছিল জোয়ারের পানিতে। কোমর পানিতে ডুবে থাকা পিচঢালা সড়কটি কোনভাবে চলাচলের উপযোগী করা হলেও তা দিয়ে যানবাহন চলাচল ছিল কষ্টসাধ্য। এবার অবশ্য ছবি একটু ভিন্ন। ভাঙন নেই। বাইরে থেকে মানুষের দুর্ভোগের ছবি বোঝার উপায় নেই। কিন্তু ভেতরটা বেদনায় ভরা। ওয়াজিউল্লাহ খান একা তো নন, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থদের মিছিল অনেক দীর্ঘ। কালিকানগরের মো. কামাল, বজলু মাল, মোসলেহউদ্দিন, ফরিদ আহমেদ, জয়নব বিবি, বিলকিস বেগম- কতজনের নাম লিখে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের ছবি দেখানো যাবে!

বেলা পড়ে গেছে। সন্ধ্যা নামছে। সূর্যটা এরইমধ্যে গাছের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। গোধূলির পূর্বক্ষণে কাঠির মাথা মাছঘাটে ভিড়েছে কয়েকটি নৌকা। কয়েকজন ঘাট মজুর মাছ নিয়ে ফিরছে। মসজিদ মুখে অপেক্ষমান কয়েকজন নামাজী। কিছুক্ষণ পড়েই আজান পড়বে। ওয়াজিউল্লাহ বিদায় নেন। লাঠি ভর দিয়ে মসজিদের দিকে পা বাড়ান।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়