ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘কবিতা’ বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশ

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২১, ৭ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘কবিতা’ বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশ

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান : বাংলা ভাষার অগ্রগণ্য সাহিত্যপত্রের কথা বলতে গেলে নিঃসন্দেহে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’র নাম প্রথমে চলে আসবে। ১৯৩৫ সালের অক্টোবর মাসে বুদ্ধদেব বসু প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহযোগিতায় ‘কবিতা’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করেন। বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদনার অভিজ্ঞতা পূর্বেও ছিলো। তিনি এর আগে হাতে লেখা ‘পতাকা’, ‘ক্ষণিকা’ ও মাসিক ‘প্রগতি’ পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন। বুদ্ধদেব ছাড়াও প্রগতির আরেক সম্পাদক ছিলেন অজিতকুমার দত্ত। এ পত্রিকার হাত ধরেই সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর সাথে কবি জীবনানন্দ দাশের যোগসূত্র স্থাপিত হয়।

প্রগতির ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যায় (শ্রাবণ ১৩৩৪) জীবনানন্দের ‘খুশ-রোজী’ কবিতাটি ছাপা হয়। জীবনানন্দের প্রথম গ্রন্থ ‘ঝরা পালক’র ৩৫টি কবিতার মধ্যে একটি প্রগতিতে প্রকাশিত হয়েছিলো। এ পত্রিকাটিতে বুদ্ধদেব বসু সযত্নে জীবনানন্দ দাশের কবিতা ছাপতেন। বিশিষ্ট জীবনানন্দ দাশ গবেষক ক্লিনটন বি সিলি জানিয়েছেন: ‘প্রগতি কেবল জীবনানন্দ দাশের কবিতা ছাপেনি, বুদ্ধদেব নিজে দায়িত্ব নিয়েছিলেন জীবনানন্দের ওপর দুটি সম্পাদকীয় লেখার, যা ছিলো তাঁর ওপর লেখা প্রথম আলোচনা।’

এ বক্তব্যে থেকে এটা স্পষ্ট হয়, বুদ্ধদেব বসু ছিলেন প্রথম সুহৃদ যিনি জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্রথম আলোচনা করেছিলেন। জীবনানন্দের প্রতি বুদ্ধদেবের এ মনোভাব আমৃত্যু ছিলো। ১৯২৭ সালের জুলাই মাস থেকে প্রকাশিত প্রগতি নানা কারণে দীর্ঘায়ূ পায়নি। এটি ১৯২৯ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

বাঙালি সাহিত্যিক ও পাঠকদের চিন্তার বিকাশে মানসম্মত একটি সাহিত্য পত্রিকা করার ইচ্ছে বুদ্ধদেব বসুর মনে-মগজে গেঁথে ছিলো। ‘কবিতা’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর সে ইচ্ছার কেবল প্রতিফলনই হলো না, তাঁর ইচ্ছে সফলভাবে বাস্তবায়িতও হয়েছিলো। ১৯৬০ সালে কবিতা পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত এর ১০৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রকাশনার দীর্ঘ ২৫ বছর এ সাহিত্যপত্রটি বাঙালি সাহিত্যিক ও পাঠকের কাছে পরম মহার্ঘ হয়ে উঠেছিল। কেননা, বুদ্ধদেব বসু লেখা নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রকাশনা পর্যন্ত দরদ দিয়ে সম্পাদনা করতেন। বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ এ সাহিত্যপত্রের বিভিন্ন সংখ্যায় ৩৪৫ জন লেখক লিখেছিলেন। সে সময়ের প্রখ্যাত সব লেখকই ‘কবিতা’য় লিখতেন। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদক হিসেবে কবিতায় ‘প্রকাশযোগ্য’ কবিতা ছাপতে চাইতেন না। তিনি চাইতেন ‘ভালো’ কবিতা। ১৯৫৫ সালের ৫ জানুয়ারি শামসুর রাহমানের কাছে লেখা এক পত্রে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন: ‘প্রকাশযোগ্য কবিতা ছাপাতে চাই না, ভালো কবিতা চাই’।

পরিচিত-অপরিচিত কবির প্রতি দৃষ্টি দেয়ার চেয়ে তিনি কবির লেখা কবিতার প্রতি দৃষ্টি দিতে ইচ্ছুক ছিলেন। এই উদার দৃষ্টিভঙ্গির বড় উদাহরণ জীবনানন্দ দাশ। যখন সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠিতে জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে নির্দয় সমালোচনা করেছিলেন, কবিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কটাক্ষ করেছিলেন তখন বুদ্ধদেব বসু সেদিকে কর্ণপাত না করে তাঁকে আগলে রেখেছেন। কবির কবিতা গুরুত্ব সহকারে ছেপেছেন। আরেকটি বিষয়ও এখানে উল্লেখ করার মতো। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও প্রথম দিকে জীবনানন্দের কবিতার সমালোচনা করেছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা পাঠ করে ১৩২২ বঙ্গাব্দের ২২ অগ্রহায়ণ এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারি নে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহাসিত করে। বড়ো জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি, সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্টো।’

জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৮৯৯ সালে, আর বুদ্ধদেব জন্মেছিলেন ১৯০৮ সালে। বয়সে জীবনানন্দ দাশ বুদ্ধদেব বসু থেকে প্রায় দশ বছরের বড় ছিলেন। অনুজ হলেও বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দের পূর্বেই সেসময়ে সাহিত্য মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং প্রশংসা কুড়িয়েছেন। অন্যদিকে ১৯২৭ সালে ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হলেও জীবনানন্দ দাশ পাঠক মহলে সমাদৃত হতে পারেননি। এর অবশ্য যৌক্তিক কারণও ছিলো। কবিতা প্রকাশের পর জীবনানন্দ দাশের পরবর্তী গ্রন্থগুলোর আলোচনা পরম যত্নে সেখানে স্থান পেয়েছে। ঝরা পালক প্রকাশের পর জীবনানন্দ দ্বিতীয় কবিতার বইটি প্রকাশ করতে দীর্ঘ সময় নিয়েছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটি তিনি বুদ্ধদেব বসুকে উৎসর্গ করেছিলেন। ঝরা পালকের জীবনানন্দ দাশ নজরুল ইসলামসহ কয়েকজন কবি দ্বারা প্রভাবিত হলেও ধূসর পাণ্ডুলিপিতে এসে তিনি নিজস্বতা খুঁজে পেয়েছেন। বুদ্ধদেব বসুর সহধর্মিণী প্রতিভা বসুর স্মৃতিকথার মাধ্যমে জানতে পারি, ধূসর পাণ্ডুলিপি প্রকাশনার পেছনে বুদ্ধদেবের শ্রম-ঘাম স্মরণযোগ্য। তিনি কাব্যটি প্রকাশে ‘ধাত্রীর’ ভূমিকায় ছিলেন। পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করা, প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে প্রকাশের অর্থচিন্তা-সবকিছুই বুদ্ধদেব করেছিলেন। এমনকি প্রকাশের পর কাব্যটির আলোচনার দায়িত্ব নিজেই নিজের ওপর বর্তে দিয়েছিলেন। ‘‘কবিতা’য় ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ নিয়ে ‘প্রকৃতির কবি’’ শিরোনামে লেখক-নামহীন একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। এ প্রবন্ধে তিনি কাব্যগ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কেবল প্রশংসা করেই বুদ্ধদেব ক্ষান্ত হননি। তিনি সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন: ‘জীবনানন্দ দাশকে আমি আধুনিক যুগের একজন প্রধান কবি বলে বিবেচনা করি।’

ধূসর পাণ্ডুলিপি পড়ে রবীন্দ্রনাথও প্রশংসা করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দকে লিখেছেন: ‘তোমার কবিতাগুলি পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।’ এর আগে ‘কবিতা’য় প্রকাশিত জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি পড়ে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করেছিলেন। জীবনানন্দের ‘চিত্ররূপময়’ এ কবিতাটি কবিগুরুকে আনন্দিত করেছিলো। রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করলেও জীবনানন্দের কবিতার সমালোচনা থেমে থাকেনি। শনিবারের চিঠির সজনীকান্ত দাস এক্ষেত্রে বরাবরই এগিয়ে ছিলেন। তিনি জীবনানন্দ দাশকে ‘জীবনান্দ’, ‘জিহ্বানন্দ’, ‘কবি-গণ্ডার’ বলে অবহিত করতেন। কবিতার যে সমালোচনা করতেন তা সজনীকান্তের অন্ধত্ব বললে ভুল হবে না। সজনীকান্তের সমালোচনার একটি উদাহরণ এ প্রসঙ্গে টানা যেতে পারে।

‘কার্তিক মাঠের চাঁদ’ কবিতার ‘মৃত সে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিলো যারে’ লাইনকে কটাক্ষ করে সজনীকান্ত শনিবারের চিঠিতে লিখলেন: ‘এই প্রাণঘাতি কবিতা লিখিয়া বেচারা পৃথিবীর যেটুকু প্রাণ ছিল এই কবিতা লেখা হওয়ার পর তাহাও আর নাই।’ অথচ সে সময়ে জীবনানন্দের বিরুদ্ধে এমন অকথ্য, রূঢ় সমালোচনার বিরুদ্ধে একাই প্রতিরোধের পাহাড় তুলে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেবের ভাষ্যে: ‘প্রগতির জন্যে এটুকু অন্তত দাবি করা যায় যে সেই দূর সময়ে, যখন ‘গণ্ডার-কবি’কে নিয়ে রোল উঠেছিলো অট্টহাসির; অন্য কোথাও সমর্থনসূচক প্রয়াস ছিলো না, তখন সেই ক্ষুদ্র মঞ্চটিতেই প্রথম সংবর্ধিত হন জীবনানন্দ-প্রকাশ্যে, একক কণ্ঠে, সোচ্চার ঘোষণায়’।

সবাই জীবনানন্দের সমালোচনা করলেও বুদ্ধদেব প্রথম থেকেই তাঁর কবিত্ব শক্তি বুঝতে পেরেছিলেন এবং তিনি কখনোই জীবনানন্দকে মূল্যায়ন করতে কার্পণ্যবোধ করেননি। বুদ্ধদেব বসু তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা ‘আমার যৌবন’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘আমার প্রিয় লেখকদের প্রশংসায় আমি নিষ্কুণ্ঠ।’ কেবল জীবনানন্দ নয়, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের কবিতারও ভূয়সী প্রশংসা তিনি করেছেন। তবে তাঁদের সাথে জীবনানন্দের প্রার্থক্য হলো- জীবনানন্দের মতো গঞ্জনার ভেতর দিয়ে তাঁদের যেতে হয়নি। সে কারণেই বুদ্ধদেব বসু বিশেষভাবে জীবনানন্দের কবিতা সমর্থন, আলোচনা ও প্রচার করে গেছেন আজীবন। ‘বুদ্ধদেব বসুর জীবন’ গ্রন্থে সমীর সেনগুপ্ত মন্তব্য করেছেন: ‘যার জন্যে তাঁকে (বুদ্ধদেবকে) তীব্রতম ও দীর্ঘ লড়াই চালাতে হয়েছিল তাঁর নাম জীবনানন্দ দাশ। অজস্র লিখেছেন তিনি... তর্ক করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, পঙ্‌ক্তি ধরে ধরে বিশ্লেষণ করেছেন, ভাঁজে ভাঁজে উন্মোচন করে দেখিয়েছেন জীবনানন্দের রহস্য।...বুদ্ধদেব বসু না থাকলে জীবনানন্দের কবিতা আদৌ প্রকাশিতই হতো কিনা সন্দেহ। অন্তত আর কেউ যে এভাবে তাঁর কবিতা ছাপেনি, সে তথ্য তো স্বপ্রকাশ।’

জীবনানন্দের কবিতা প্রকাশের প্রসঙ্গসূত্রে একটি পরিসংখ্যান এখানে উপস্থাপন না করলেই নয়। জীবিতাবস্থায় জীবনানন্দের প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা ছিলো ১৬২টি। এর মধ্যে বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পাদিত ‘প্রগতি’তে ১৪টি, ‘কবিতা’য় ৯৭টি ও ‘বৈশাখী’তে ৩টি- মোট ১১৪টি কবিতা প্রকাশ করেছিলেন!

জীবনানন্দের বনলতা সেন, সমারূঢ়, আদিম দেবতারা, অন্ধকারসহ অনেক বিখ্যাত কবিতাই বুদ্ধদেব সযত্নে কবিতায় ছেপেছেন। শুধু তাই নয়, কবিতায় তিনি জীবনানন্দের লেখা নিয়ে আলোচনা ছাপিয়েছেন। করেছেন ‘জীবনানন্দ দাশ’ সংখ্যাও। কেবলমাত্র এ পরিসংখ্যান দেখলে সহজেই অনুমিত হয় জীবনানন্দকে যিনি সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করেছেন তিনি বুদ্ধদেব বসু। এ মূল্যায়নের মাধ্যম যেমন বুদ্ধদেবের লেখনী, তেমনি সাহিত্যপত্র ‘কবিতা’ও। আবদুল মান্নান সৈয়দ মনে করতেন, বুদ্ধদেব বসু কেবল জীবনানন্দ দাশকে প্রতিষ্ঠাই দেননি-‘অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সমর সেন, বিষ্ণু দে−পুরো আধুনিক কবিগোষ্ঠীকে তিনি সংহত করে এনেছিলেন একটি বৃত্তে।’ জীবনানন্দ দাশ বুদ্ধদেব বসুর অবদান ও তাঁর প্রতিভার কথা স্বীকার করতে ভোলেননি। ১৯৪৬ সালের ২ জুলাই লেখা এক পত্রে কবিকে বলতে দেখি: ‘‘ব্যক্তিগতভাবে ‘প্রগতি’ ও বুদ্ধদেব বসুর কাছে আমার কবিতা ঢের বেশি আশা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। সে কবিতাগুলো হয়তো বুদ্ধদেবের মতে আমার নিজের জগতের এবং তাঁরও পরিচিত পৃথিবীর বাইরের কোথাও নয়; স্পষ্টতাসম্ভবা তারা; অতএব সাহস ও সততার দেখাবার সুযোগ লাভ করে চরিতার্থ হলাম-বুদ্ধদেব বসুর বিচারশক্তির ও হৃদয়বুদ্ধির; আমার কবিতার জন্যে বেশ বড় স্থান দিয়েছেন তিনি ‘প্রগতি’তে এবং পরে ‘কবিতা’য় প্রথম দিক দিয়ে।’’

এ কথা পুনরাবৃত্তি হলেও বলা প্রয়োজন ‘সাহিত্য সমালোচনা’কে বুদ্ধদেব বসু ভিন্নস্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মতো নির্মোহ থেকে খুব কম লেখকই সমালোচনা করতে সমর্থ হয়েছেন। জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর কবিতাকে প্রতিষ্ঠা করতে বুদ্ধদেব বসু প্রচুর লেখালেখি করেছেন এটি যেমন সত্য; তেমনি এও সত্য- জীবনানন্দের কবিতার শব্দ, বাক্যের পুনরাবৃত্তি, আত্ম-অনুকরণের গোলকধাঁধা নিয়েও নির্মোহভাবে লিখেছেন তিনি। জীবনানন্দ দাশ বলে তাঁকে ছাড় দেননি বুদ্ধদেব। ‘মহাপৃথিবী’ গ্রন্থ নিয়ে বুদ্ধদেব ‘কবিতা’য় অকপটে লিখেছেন: ‘সেই হিজল বন, হলুদ পাতা,  হেমন্তের কুয়াশা, মেঘের দুপুরে সোনালী চিল- পড়তে-পড়তে এ-সন্দেহ মনে উঁকি না দিয়েই পারে না যে কবি নিজের পুনরুক্তি করছেন।...একে পুনরুক্তি না বলে অনুকৃতি বলতে হয় এবং কোনো কবি যখন নিজের অনুকরণ করেন তখন দেবতারা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মনে হয় জীবনানন্দ স্বরচিত বৃত্তের মধ্যে বন্দী হয়েছেন।’ শুধু তাই নয় কিছুদিন পর জীবনানন্দের সাহিত্য চর্চা নিয়ে হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। কবিতার ১৩৫৩ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় তিনি প্রশ্ন তোলেন: ‘জীবনানন্দ দাশ কী লিখছেন আজকাল?’ এই যে সমালোচনা ও জীবনানন্দের ফিরে আসার জন্যে হাহাকার তা কোনোভাবেই বুদ্ধদেব-জীবনানন্দের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাতে পারেনি। ১৩৬১ বঙ্গাব্দের ৫ কার্তিক জীবনানন্দের মৃত্যু হলে বুদ্ধদেব বসু কবিতার ‘জীবনানন্দ সংখ্যা’ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ বছরের পৌষ মাসে কবিতার জীবনানন্দ দাশ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যায় জীবনানন্দের চিঠি, অগ্রন্থিত কবিতা, জীবনীপঞ্জি, কবিতায় প্রকাশিত লেখার তালিকা, জীবনানন্দের ছবি ও আটটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বুদ্ধদেব বসু তাঁর প্রবন্ধে জীবনানন্দের সার্বিক চর্চা নিয়ে অর্থবহ আলোচনা করেন। বলতে গেলে একজন বুদ্ধদেবই আমৃত্যু জীবনানন্দের সাথে ছিলেন।

জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে খড়গহস্তে অমূলক সমালোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া সজনীকান্ত দাসও শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দের প্রশংসা করে গেছেন। যদিও তার এই বাক্যগুলো কবি শুনে যেতে পারেননি। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর সজনীকান্ত দাস বলেছেন: ‘পুরাতন যাবতীয় অশোভন বিরূপতা সত্ত্বেও একথা আজ স্বীকার করা কর্তব্য মনে করিতেছি যে, রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যসাহিত্যের তিনি অন্যতম গৌরব ছিলেন। তিনি অকপটে সুদৃঢ়তম শ্রদ্ধার সহিত কাব্য-সরস্বতীর সেবা করিয়া গিয়াছেন। সহৃদয় ব্যক্তিরা তাঁহার বক্তব্যের চাবিকাঠি খুঁজিয়া পাইয়া আনন্দ লাভ করিতেন। যাহারা পাইতেন না তাঁহারাই বিমুখ হইতেন। আমরা এই শেষোক্তদের দলে ছিলাম’। শুধু সজনীকান্ত নন, জীবনানন্দ দাশের ঘোরতর বিরোধী প্রায় সকলেই তাঁকে মৃত্যু পরবর্তীতে ‘কবি’ স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। অনেকে পূর্বে অমূলক সমালোচনার জন্যে লজ্জিতও হয়েছেন। কিন্তু এদের সবার দেরিতে বোধোদয় হলেও একজন বুদ্ধদেব বসু ঠিকই সময়ের সাথে ছিলেন। স্বল্পবাক্, নির্জনতাপ্রিয় জীবনানন্দের সাহিত্য জীবনে তাঁর চেয়ে বড় সুহৃদ আর কেউ ছিলো না। 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়