ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

করোনা সংকট পরবর্তী বিশ্ব কেমন হবে?

খালেদ সাইফুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ১৫ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনা সংকট পরবর্তী বিশ্ব কেমন হবে?

করোনাভাইরাসের মহামারিতে বিশ্ব এক সংকটকাল অতিক্রম করছে। মৃত্যুর পাশাপাশি জীবনের নানা হিসাব-নিকাশও আবার নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে। সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর যখন নাজেহাল অবস্থা তখন এর ছাপ পড়ছে উৎপাদন ব্যবস্থা, বাজারব্যবস্থা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির উপরেও। ফলে বার্লিন দেয়াল পতনের পরবর্তী সময়ের মতো করোনাসংকট পরবর্তী বিশ্বের চিত্রপট আমাদের সামনে বেশ কিছুটা পরিবর্তিত রূপেই হাজির হবে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন চিন্তাবিদ করোনা পরবর্তী বিশ্বের রাষ্ট্র, সরকার, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনীতি, বিশ্ব-রাজনীতি প্রভৃতির ভবিষ্যৎ তুলে ধরেছেন।

বিশ্ব হবে কম মুক্ত ও কম উন্নত

করোনাসংকট রাষ্ট্রকে আরো শক্তিশালী করবে এবং জাতীয়বাদ নতুন মাত্রায় বিকশিত হবে। সব ধরনের সরকার সংকট মোকাবিলায় নানা ধরনের কাজ করতে বাধ্য হবে এবং এর মধ্য দিয়ে তারা শক্তিশালী হবে। অনেকেই সংকট পরবর্তী সময়ে তাদের এই ক্ষমতা ছাড়তে চাইবে না, বলেন হার্ভার্ডের আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপক স্টিফেন এম ওয়াল্ট। তার মতে, করোনা বৈশ্বিক শক্তি পশ্চিম থেকে পূর্বে স্থানান্তর করবে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর সবচাইতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পেরেছে। চীন প্রথম দিকে ভুল করলেও পরবর্তীতে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তুলনামূলকভাবে ইউরোপ-আমেরিকার মহামারি মোকাবিলার কম সাফল্যের কারণে এমনটি ঘটবে। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির যে সাংঘর্ষিক চরিত্র তার পরিবর্তন হবে না। পূর্বের মহামারিগুলোও এই চরিত্র পরিবর্তন করতে পারেনি, করোনাও পারবে না। একটি হাইপার গ্লোবালাইজেশন পরিস্থিতি তৈরি হবে। করোনা পরবর্তী দুনিয়া হবে কম উন্মুক্ত, স্বল্পোন্নত এবং অল্প স্বাধীন।

বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র চলে যাবে চীনে

এনইউএস-এর ফেলো এবং ‘হ্যাজ চায়না ওন’ বইয়ের লেখক কিশোর মাহবুবানি মনে করেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিপথের মৌলিক পরিবর্তন আসবে না। শুধু বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র আমেরিকা থেকে সরে চীনে স্থানান্তরিত হবে, যা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। কারণ আমেরিকার জনগণ গ্লোবালাইজেশনের উপর যখন আস্থা হারাচ্ছে তখন চীন তাদের জনগণকে গ্লোবালাইজেশনের নতুন নতুন মাত্রার দিশা দিচ্ছে। এই শিক্ষা তারা পেয়েছে তাদের নিজেদের ইতিহাস থেকে। ১৮৪২-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত চায়নার মন্দভাগ্য ছিলো দুনিয়া থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতার ফল। এছাড়া চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে সেখানকার জনগণ বিশ্বাস করে তারা যে কোনো জায়গায় প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম।

আমেরিকার সামনে এখন দুটি রাস্তা খোলা। যদি তারা বিশ্ব মোড়লের আসন ধরে রাখতে চায়, তবে তাদের আপসহীনভাবে চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চালিয়ে যেতে হবে। অন্যদিকে আমেরিকা যদি তার জনগণের কল্যাণ চায়, তবে চীনের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে।

গণতন্ত্র ছদ্মবেশ ছেড়ে বেরিয়ে আসবে

এই সংকটের ফলে পশ্চিমা গ্রান্ড স্ট্রাটেজির বিরোধী শিবিরগুলো খুব শক্তিশালী হয়ে উঠবে। জাতিবাদী, বিশ্বায়নবিরোধী, চায়না শিবির, এমনকি লিবারেল আন্তর্জাতিকতাবাদীরাও তাদের মতাদর্শের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে নতুন করে প্রমাণ করবে। এমনটাই মনে করেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক জন ইকেন বেরি। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ধসের আড়ালে জাতীয়তাবাদ, পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে বিচ্ছিন্নতাকে গ্রহণ করে নেওয়া হবে। তবে ১৯৩০ এবং ৪০-এর দশকে যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধকালীন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং ইউরোপের অন্যান্য নেতারা যেমন শক্ত আন্তর্জাতিকতাবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, বিপরীত দিক থেকে তেমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। ৩০-এর দশকের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পতন দেখিয়েছিল যে, আধুনিক দুনিয়া কীভাবে পরস্পর নির্ভরশীল এবং সংক্রামক রোগের কাছে কীভাবে সকলেই অসহায়। ফলে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট যুদ্ধোত্তর এমন একটি উন্মুক্ত ব্যবস্থা দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন যেখানে নিরাপত্তা এবং পরস্পরনির্ভরশীলতা নিশ্চিত হবে। আমেরিকা তার বর্ডারের মধ্যেই আবদ্ধ থাকতে পারে না, তাই তাদের যুদ্ধোত্তর সময়ে বহুমাত্রিক সহযোগিতার বৈশ্বিক অবকাঠামে গড়ে তুলতে হয়েছে। তাই আবারও চাপের মুখে আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বকে একই পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারে। শুরুতে তাদের কার্যক্রম একটু বেশি জাতীয়তাবাদী হবে, তবে পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক দেশগুলো তাদের খোলসের বাইরে আসবে এবং বাস্তববাদী ও প্রতিরক্ষামূলক আন্তর্জাতিকতাবাদের আশ্রয় নেবে।

সংকট মোকাবিলায় আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে

মনমোহন সিং-এর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন বলেন, যদিও এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, তবে নিশ্চিতভাবে তিনটি ঘটনা ঘটবে। প্রথমত রাষ্ট্রসমূহের ভেতরের এবং বাইরের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে। সমাজকে এবং মুক্ত চিন্তার অধিকারীদেরকেও সরকারের ক্ষমতার কাছে যেতে হবে। সংকট মোকাবিলায় সরকারের সাফল্য এবং তার অর্থনৈতিক প্রভাবে নিরাপত্তা ইস্যু এবং সরকারের সাম্প্রতিক মেরুকরণ লোপ পাবে কিংবা শেষ হয়ে যাবে। অভিজ্ঞতা বলছে, কর্তৃত্ববাদী কিংবা জনপ্রিয় সরকার এই মহামারি মোকাবিলা করতে পারছে না। তাইওয়ান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো যেসব দেশ শুরুতে এবং সফলভাবে লড়াই করেছে, তাদেরও কর্তৃত্ববাদী কিংবা পপুলিস্ট নয়, বরং গণতান্ত্রিক সরকার।

দ্বিতীয়ত, পারস্পরিক সম্পর্কের যে বিশ্ব এখনই তার শেষ নয়। বরং মহামারি পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকেই প্রমাণ করে। তবে সব রাষ্ট্রের মধ্যেই নিজের দিকে ফেরার, অটোনমি এবং নিজেই নিজের ভাগ্য গড়ার প্রবনতা তৈরি হয়েছে। আমরা একটি গরিব ও সংকীর্ণ দুনিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছি।

শেষতক আশা জাগানোর মতো কিছুু ভালো দিকও রয়েছে। মহামারির ফলে যদি আমরা বুঝতে পারি যে, বৈশ্বিক ইস্যুগুলো মোকাবিলায় রাষ্ট্রসমূহ পরস্পর সহযোগিতার প্রয়োজন, তবে তা এক মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করবে।

অবাধ উৎপাদন ও পরিবহন কমবে

কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন-এর গ্লোবাল হেলথ বিষয়ক ফেলো এবং পুলিৎজারজয়ী বিজ্ঞান লেখক লরাঁ গ্যারেট মনে করেন, বৈশ্বিক পুঁজিবাদ এক নতুন নাটকীয়তার সূচনা হবে। বৈশ্বিক বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য মৌলিক ধাক্কা হলো, গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন এবং ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়াক ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে করোনাভাইরাস যে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনবে তা নয়, বরং কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটাবে। বিশ্বায়নের ফলে কোম্পানিগুলো বিশ্বব্যাপী পণ্য উৎপাদন করতে পারছে এবং সেগুলোর সংরক্ষণ ব্যয় ছাড়াই জাস্ট-ইন-টাইমভিত্তিতে বাজারে সরবরাহ করতে পারছে। করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে রোগজীবাণু শুধু মানুষকেই আক্রান্ত করে না, পুরো জাস্ট-ইন-টাইম ব্যবস্থাকেও গুঁড়িয়ে দেয়।

গত ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্ব বাজারে যে ধস নেমেছে, তার মাত্রা হিসাবে নিয়ে কোম্পানিগুলো এই মহামারির প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য জাস্ট-ইন-টাইম ব্যবস্থা এবং বিশ্বব্যাপী অবাধ উৎপাদন সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বসবে। ফলাফল হতে পারে পুঁজিবাদের নয়া স্টেজ এ প্রবেশ, যেখানে ভবিষ্যৎ বিপদের কথা মাথায় রেখে সাপ্লাই চেইন নিজ দেশের কাছাকাছি থাকবে এবং অবাধ উৎপাদন কমিয়ে আনা হবে। এতে কোম্পানিগুলোর মুনাফা কম হলেও স্থায়িত্ব বাড়বে।

ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসবে

হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের অধ্যাপক এবং আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স-এর সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি নিকোলাস বার্নস বলেন, করোনা এই শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা। দুনিয়ার ৭.৮ বিলিয়ন মানুষ ঝুঁকিতে আছে। এই ঘটনার অর্থনৈতিক প্রভাব ২০০৭-০৮ এর চাইতেও বেশি হতে পারে। প্রত্যেক সংকটই এমন ধাক্কা দিতে পারে, যার ফলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং ক্ষমতার ভারসাম্য স্থায়ীভাবে পরিবর্তন হতে পারে। আন্তর্জাতিক ঐক্য এখনো শোচনীয় পর্যায়ে আছে। যদি বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন তাদের কথার যুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে সংকট মোকাবিলার পথে না হাঁটে তবে দুই দেশের গ্রহণযোগ্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি ঠিকঠাক তার ৫০০ মিলিয়ন জনগণকে সাহায্য করতে না পারে, তবে ভবিষ্যতে দেশগুলোর সরকার ব্রাসেলস-এর চাইতে বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠবে।

দেশে দেশে আমরা মানুষের মধ্যে বিপুল প্রাণশক্তি লক্ষ্য করছি। ডাক্তার, নার্স, রাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ মানুষ সকলে মিলে একসাথে কাজ করছে সংকট মোকাবিলায়। ফলে নারী-পুরষ সকলে মিলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরো শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে বলে আশার সঞ্চার হয়।

তথ্যসূত্র: ফরেন পলিসি

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়