ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ধরিত্রী দিবস

করোনাকালে রাজত্ব এখন শুধুই প্রকৃতির

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৯, ২২ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনাকালে রাজত্ব এখন শুধুই প্রকৃতির

প্রকৃতি হাসছে। মুক্ত হাওয়ায় ভাসছে। বৃক্ষরাজির নব পত্রপল্লব ছড়িয়েছে শাখায় শাখায়। নদী-সমুদ্র আর বন্যপ্রাণীদের দল যেন মুক্তির আনন্দে আত্মহারা। তারা যেন এমন সময়েরই অপেক্ষায় ছিল। বহুকালের অবহেলা-অবজ্ঞায় ক্ষত-বিক্ষত পোশাক বদলে নতুন রূপে আজ প্রকৃতি। বদলে গেছে প্রকৃতির নৈসর্গিক চেহারা। চাপা কষ্ট থেকে বেরিয়ে মুক্তির স্বাদ নিচ্ছে যেন সমুদ্র সৈকত। লাল কাঁকড়ার মুক্ত চলাফেরার এমন দৃশ্য আগে খুব কমই চোখে পড়েছে। নির্ভয়া কাছিম, ডলফিন আর গঙ্গা কৈতরের দল। ডলফিনের দল এবার চলে এসেছে সৈকতের খুব কাছাকাছি। অবস্থা দেখে মনে হয়, সুন্দরবনসহ উপকূলের সব বনরাজি আর প্রাণীকুলের প্রার্থনা যেন বিধাতা মঞ্জুর করেছেন।

বিশ্বব্যাপী করোনার থাবায় মানবজাতির যখন চরম দুঃসময়; ঠিক তখনই প্রকৃতি মেতে উঠেছে আনন্দে। প্রকৃতির এই আনন্দ দিনে আজ ২২ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ধরিত্রী দিবস বা ওয়ার্ল্ড আর্থ ডে। ধরিত্রীকে বাঁচাতে নেওয়া হয়েছে নানান ধরনের কর্মসূচি।         

করোনাকালের একাকিত্ব! একা মানুষ, একা প্রকৃতি। বিপুল জনারণ্যের দাপটে যখন অরণ্যের মাঝে নেমে এসেছিল চরম সংকটকাল; ঠিক তখনই এলো একাকিত্বের এই আদেশ। যে মানুষ প্রকৃতির শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল পদে পদে, সে মানুষ এবার ঘরবন্দি। আর চিরকালীন বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে প্রকৃতি। মানুষ কিংবা অন্য কোনো প্রাণী বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর যেসব আচরণ করে, প্রকৃতি যেন তাই করছে এখন। এ যেন মুক্তিরই আনন্দ। সমুদ্র তীরের উপকূলের দৃশ্যপট তাই মনে করিয়ে দেয়। পূর্ব থেকে পশ্চিম, নাফ থেকে কালিন্দি, বহুকাল পরে এবার যেন মুক্তির মিছিলে সামিল। পাঁচ নদীর মোহনা, শ্যালা নদীর পাড়, চর কুকরিমুকরি, নিঝুম দ্বীপ, সোনাদিয়া, সেন্টমার্টিন- সবখানেই অন্যরকম এক আবহ। করোনার ধাক্কায় মানুষ ঘরবন্দি হওয়ার মাত্র সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে প্রকৃতি রং বদলাতে শুরু করে। উপকূলের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসতে থাকে একের পর এক পরিবর্তনের খবর। যেসব বিষয় মানুষ কখনো কল্পনাই করেনি; তেমন ঘটনাই ঘটতে থাকে।

সমুদ্র উপকূলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে যা পর্যবেক্ষণ করছি, তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, উপকূলের প্রকৃতি ধ্বংসের জন্য মানুষ নানান ভাবে দায়ী। মানুষের প্রয়োজনে কাটা হচ্ছে বনের গাছ। মানুষের অধিক লোভ প্রকৃতির সব সম্পদ ধ্বংস করে দিচ্ছে। মানুষের ভয়ে পাখি বাসা বাঁধতে প্রায় ভুলে গেছে। লাল কাঁকড়ারা সৈকত থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। মা কচ্ছপ ডিম ছাড়তে কিনারে আসতে ভয় পেত। চুপি চুপি এসে সৈকতে ডিম পেড়ে গেলেও চোরেরা নিয়ে যেত সেই ডিম। মানুষের থাবায় বহু প্রজাতির মাছ, গাছ, পাখি এখন আর নেই। সুন্দরবন এলাকায় যে ডলফিন রক্ষার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে; কক্সবাজারে সেই ডলফিন নিজে নিজে জেগে উঠেছে। সৈকতের বালুরাশি আঁকড়ে ধরে বাঁচতো যে সাগর লতা; তা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কেননা, সৈকতজুড়ে মানুষের আধিপত্য। সুন্দরবনের ভেতরে নির্বিচারে যে কাঁকড়া ধরা হতো, নদীতে চিংড়ির পোনা ধরা হতো, তারা এবার মুক্ত। তারা হয়তো ভাবছে, মানুষগুলো গেল কোথায়! আমাদের তো আর ধরতে আসছে না! ওদের প্রার্থনা শুনে মানুষদের যে ঘরবন্দি করে রেখেছে বিধাতা; সে খবর হয়তো ওদের কানে পৌঁছেনি!

সূত্রগুলো বলেছে, এই গরমের মৌসুমে সমুদ্র থেকে একাধিক প্রজাতির কাছিম ডিম পাড়তে আসে পূর্ব উপকূলের কক্সবাজারের কয়েকটি এলাকায়। সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার, সোনাদিয়া, ধলঘাটা অন্যতম। কিন্তু কয়েক বছরে কাছিম আসার মাত্রা অস্বাভাবিক কমে গিয়েছিল। বেড়ে গিয়েছিল কাছিমের ডিম চুরির ঘটনা। এমনকি কাছিমের ডিম এক সময় স্থানীয় হাটে বাজারেও বিক্রি হওয়ার খবরও ছিল। বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে নানান তথ্য পেয়েছি। ডিম ছাড়তে আসা কাছিম মারা পড়েছে কুকুরের আক্রমনে, এমন দৃশ্য নিচের চোখে দেখেছি। কিন্তু করোনা সে অবস্থা বদলে দিয়েছে; জানালেন স্থানীয়রা। সেন্টমার্টিনে খবর নিয়ে জানা গেছে, এক সময় প্রতি রাতে কাছিমের ৫-৬শ’ ডিম সংগ্রহ করা যেতো। কিন্তু মাঝখানে সে সংখ্যা একেবারেই কমে গিয়েছিল। করোনার কারণে মানুষের আনাগোনা কমে যাওয়ায় কাছিম নির্ভয়ে সৈকতে আসছে। এখন প্রতিরাতেই অনেক ডিম পাওয়া যায়। 

সমুদ্রের সুনীল সম্মোহনী কাছে টানে মানুষকে। সে কারণেই হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে সর্বক্ষণ মানুষের ঢল লেগে থাকতো। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ নেই নিরীহ সমুদ্র সৈকতের। মানুষের পদপিষ্টে সেসব তো সেই কবে হারিয়ে গিয়েছিল! কক্সবাজারের সৈকতজুড়ে ছিল দোকানপাট আর মানুষের ভিড়। নৈসর্গিক শোভা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। করোনাকালের এই সময়ে সৈকত থেকে মানুষজন মাত্র কয়েকদিন দূরে থাকায় গোটা সৈকতের চেহারাই বদলে গেছে। প্রকৃতির চিরন্তন নিয়মে সমুদ্রপাড়ের এই বালুকারাশির মাঝেই গড়াচ্ছে সাগর লতা। দূর থেকে সমুদ্রে দেখা গেছে ডলফিনের নৃত্য। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে কাছেই দরিয়ানগরে পাহাড় আর সাগরের মিতালী, নিবিড় বন্ধুত্ব এখন যেন আরও গাঢ় হয়েছে। সোনাদিয়া সমুদ্র সৈকতের অবস্থাও একই। সাগরপাড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যাচ্ছে গঙ্গা কবুতর। এখন রাজত্বটা শুধুই প্রকৃতির।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিম জানাচ্ছিলেন, এক সময় কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্রের তীর ধরে ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু পাহাড়ের মতোই বড় বড় বালির ঢিবি ছিল। এসব বালিয়াড়ির প্রধান উদ্ভিদ ছিল সাগরলতা। সাগরলতার গোলাপি গাঢ় বেগুনী রঙের ফুল সৈকতের শোভা বাড়িয়ে তুলতো। সময়ের ধারায় সাগরলতা ও বালিয়াড়ি হারিয়ে যাওয়ায় গত ২৮ বছরে কক্সবাজার সৈকতের ৫শ মিটারেরও বেশি ভূমি সাগরে বিলীন হয়ে সাগর এগিয়ে এসেছে। এই বালিয়াড়ির কারণেই ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময়েও সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টের বালিয়াড়ির পাশে থাকা মসজিদসহ আশপাশের বাড়িঘর ছিল নিরাপদ। সেখানে সামুদ্রিক জোয়ারের পানি যেমন ওঠেনি, তেমনি বাতাসের তোড়ও ছিল কম। পাখিদের আনাগোনা প্রসঙ্গে দরিয়ানগর বার্ড ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আহমদ বলেন, একসময় যেখানে জেলে সেখানেই গঙ্গা কৈতর দেখা যেত। এদের একেকটি দল ছিল অনেক বড়। তবে এদের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল। এখন আবার দেখছি। মানুষের আনাগোনা নেই বলেই হয়তো ওরা নির্ভয়া।

মধ্য-উপকূলের আরেক সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা থেকেও পাওয়া গেছে একই ধরনের খবর। বদলে গেছে সেখানকার পরিবেশ। প্রকৃতি পুনরায় জেগে উঠতে শুরু করেছে। কুয়াকাটার স্থানীয় বাসিন্দা ও ইলিশ পার্কের স্বত্বাধিকারী রুমান ইমতিয়াজ তুষার এ প্রসঙ্গে বলেন, কুয়াকাটার এই দৃশ্য আমরা কখন দেখেছি মনে নেই। মুরব্বীদের কাছে শোনা গল্পের কুয়াকাটার পুরানো চেহারাটাই যেন আমাদের সামনে হাজির হয়েছে।

সুন্দরবনের ভেতরেই দাঁড়িয়ে আছে লীলাবতি ফরেস্ট অফিস। পাকা ভবন উঁকি দিয়ে আছে বনের ভেতর দিয়ে। এই ফরেস্ট অফিসের পাশ দিয়েই পশুর নদীর শাখা হয়ে বেরিয়ে গেছে শ্যালা নদী। তেলের ট্যাংকার ডুবিতে যে শ্যালা নদী মরণাপন্ন হয়েছিল; সে ফিরে পেয়েছে প্রাণ। মোংলা বন্দরের প্রাণকেন্দ্র থেকে শ্যালাপাড়ে যাওয়া যায় সড়ক পথে। চিলা ইউনিয়নের আওতাধীন এলাকা। মানুষজন বনে যায় বলে তাদের জন্য বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাতেও কী রক্ষা হয়! কে শোনে কার কথা! শুধু যে মানুষের অত্যাচার সহ্য করে সুন্দরবন তা নয়; ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানামূখী প্রাকৃতিক দুর্যোগ সয়ে টিকে আছে সুন্দরবন। করোনা সুন্দরবনের প্রাণীদের নির্বিঘ্নে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে। বনের জীববৈচিত্র্য ফিরে পেয়েছে প্রাণ।

সুন্দরবনের আশপাশের এলাকার মানুষেরা যেন বনের এক ভিন্ন রূপ দেখতে পাচ্ছেন। মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকায় বদলে গেছে বনের দৃশ্যপট। বনের প্রাণীদের ঘুম এখন আর কেউ ভাঙায় না। প্রাণীদের চলার পথে এখন আর কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। সুন্দরবন নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম সুন্দরবনের বর্তমান অবস্থা ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, সুন্দরবন জেগে উঠেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাঘসহ অন্যান্য প্রাণীর প্রজনন বৃদ্ধি পাবে। সুন্দরবন এবং এর জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা হবে। করমজল ইকো টুরিজম ও বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আজাদ কবির জানান, পর্যটক না আসায় সুন্দরবনের প্রাাণীকূল নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। এখন দুর্লভ প্রাণীদেরও দেখা মিলছে। খুলনার বিশিষ্ট পরিবেশ সাংবাদিক গৌরাঙ্গ নন্দী বলেন, করোনা সুন্দরবনের জন্য অন্যরকম পরিবেশ নিয়ে এসেছে। নির্বিচারে কাঁকড়া, মাছসহ অন্যান্য সম্পদ আহরণে সুন্দরবন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এখন সুন্দরবন নিঃশ্বাস ফেলছে! অন্তত মানুষের অত্যাচারটা আপাতত নেই।

বিশ্বজুড়ে করোনা আতঙ্ক দেখে, মানুষের বন্দিদশা দেখেই হয়তো হাসছে প্রকৃতি। গ্রীষ্মের এই মাতাল সমীরণে জেগে উঠেছে নিসর্গ। নির্ভয়া প্রাণীকুলের মাতোয়ারা মন বলে দিচ্ছে ক্রমেই জেগে উঠছে ধরণী। জেগে থাকুক নিসর্গ, জেগে থাকুক ধরিত্রী।   

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়