ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

করোনাভাইরাস: বিশ্ব রাজনীতির নতুন ঢেউ

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২০, ২১ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনাভাইরাস: বিশ্ব রাজনীতির নতুন ঢেউ

করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত বিশ্ব। ভাইরাস মোকাবিলায় পৃথিবী হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। ইতোমধ্যেই বিশ্বে দেড় লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আইইডিসিআর-এর সবশেষ (২১ এপ্রিল) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশেও ১১০ জন মারা গেছে। কেউ জানে না, এর শেষ কোথায়।

এরই মধ্যে করোনা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক। চলছে নানা বিশ্লেষণ।  কেউ কেউ বলছেন বিশ্ব রাজনীতে করোনার প্রভাবে বদলে যাবে পৃথিবী।

করোনার সংক্রমণ চীন থেকে শুরু গত বছরের নভেম্বরের দিকে।  এরপর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ মহামারির জন্য চীনকে দায়ী করে আসছে আমেরিকা। ১৮ এপ্রিল হোয়াইট হাউজে ব্রিফিংয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘চীনে এটা (মহামারি) শুরু হওয়ার আগেই থেমে যেতে পারতো, কিন্তু হয়নি। এখন পুরো বিশ্ব ভুগছে।’

করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় যেখানে সবার সহযোগিতার দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা, তখন বিশ্বের দুই পরাশক্তি কথার যুদ্ধে নেমেছে। কয়েকদিন আগে আমেরিকা অভিযোগ করে চীনের উহানের ল্যাবে করোনার উৎপত্তি হয়েছে। এ নিয়ে তদন্তও শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা ও জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা। যদিও চীন এ দাবি নাকচ করে দেয়। এছাড়া চীনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে তহবিল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। সব মিলিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘এটা যদি ভুল হয়, ভুল তো ভুলই। কিন্তু তারা (চীন) যদি দায়ী থাকে, তাহলে নিশ্চয় তাদের পরিণতি ভোগ করতে হবে।’ তবে যুক্তরাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নেবে তা বলেননি ট্রাম্প।

এদিকে করোনাভাইরাস গবেষণাগারে মানুষের তৈরি নয় বলে দাবি করেছে চীন। করোনা নিয়ে গবেষণা পরিচালনাকারী উহান ইনিস্টিটিউট অব ভাইরোলোজির পি-ফোর গবেষণাগারের প্রধান ইউয়ান ঝিমিং এ দাবি করেছেন। ১৯ এপ্রিল চীনা সরকারি সংবাদমাধ্যম সিজিটিএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘কোনোভাবেই এই ভাইরাস আমাদের তৈরি নয়। ইনস্টিটিউটে কী ধরনের গবেষণা চলছে এবং কীভাবে ইনস্টিটিউটে ভাইরাস ও নমুনা নিয়ে কাজ করে তা আমরা জানি। আমাদের কাছ থেকে ভাইরাসের উৎপত্তির কোনো উপায়ই নেই।

করোনাভাইরাস চীন তৈরি করে থাকতে পারে বলে ট্রাম্প যে দাবি করেছেন তা প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, ‘এটা পুরোপুরি কল্পনার ওপর নির্ভরশীল। এর কিছু উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণকে বিভ্রান্ত করা এবং আমাদের মহামারি প্রতিরোধ ও বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করা। তারা হয়তো কোনোভাবে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করেছে। তবে একজন বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবস্থাপক হিসেবে আমি জানি এটা অসম্ভব। ঝিমিং বলেন, ‘কোভিড-১৯ মানুষের তৈরি হতে পারে না।’ এটি যে কৃত্রিমতার পক্ষেও কোনো প্রমাণ নেই বলে দাবি করেন তিনি।

ওদিকে ইরানের অধিকাংশ জনগণ মনে করেন এই জীবাণু যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডার মেজর জেনারেল হুসেইন সালামি বলেছেন, করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি জীবাণু অস্ত্র।  ৫ মার্চ সালামি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে চীনে এবং পরে ইরানের বিরুদ্ধে ‘জীবাণু-অস্ত্রের সন্ত্রাসী হামলা’ চালিয়েছে। ৬ মার্চ দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির প্রভাবশালী সদস্য হেশমাতোল্লাহ ফাতাল হাতপিশে মন্তব্য করেন, ‘ট্রাম্প এবং পম্পেও করোনা নিয়ে মিথ্যা কথা বলছেন। এটা কোনো সাধারণ রোগ নয়, এটা ইরান এবং চীনের বিরুদ্ধে জীবাণু অস্ত্রের হামলা।’

১৯ এপ্রিল করোনা মোকাবিলায় চীনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একইসঙ্গে ভাইরাসটির উৎস সম্পর্কে জানতে এবং কীভাবে ছড়িয়ে সেটা বের করতে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেরি সপেইন জানান, চীনের স্বচ্ছতা সম্পর্কে তার ‘উচ্চ মাত্রার’ উদ্বেগ রয়েছে। তিনি এবিসি টেলিভিশনকে বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ে চারপাশে যে বিষয়ে বিতর্ক হচ্ছে, সেগুলো স্বাধীন পর্যালোচনার বিষয়। আমি মনে করি, এটা করা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আসলে অস্ট্রেলিয়া এ ব্যাপারে জোর দেবে।’

মহামারি নিয়ে পেইনের তদন্তের ডাক এমন সময়ে এলো যখন অস্ট্রেলিয়া ও তার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক অংশীদারের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক চলছে। পেইন বলছেন, ‘চীনের প্রতি আমার আস্থা দীর্ঘদিনের। কিন্তু আমার উদ্বেগ স্বচ্ছতা নিয়ে।’

করোনা পরবর্তী নতুন বিশ্বে কে হারবে কে জিতবে—এ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাইরাস বিস্তারে অপরাধী না হয়ে বিশ্বের ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে চীন। বিজয়ীর দৌড়ে এটি তাদের কিছুটা এগিয়ে রেখেছে। নতুন প্রজন্মের তরুণ চীনা কূটনীতিকরা তাদের দেশের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেমে পড়েছেন। অবশ্য তাদের এ আত্মপ্রচারকে ‘নির্লজ্জ’ বলে সমালোচনা করা হচ্ছে। সাবেক ফরাসি রাষ্ট্রদূত মিশেল ডুকলস বলেছেন, ‘চীন তার রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রচারের জন্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়কে নির্লজ্জভাবে পুঁজি করছে।’

হার্ভার্ডের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক তাত্ত্বিক স্টিফেন ওয়াল্ট মনে করছেন, চীন বিজয়ী হতে পারে। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে তিনি বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে শক্তি ও প্রভাবকে পরিবর্তিত করবে। দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর সেরা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং চীন তার প্রাথমিক ভুলগুলো শুধরে ভালোভাবে সামাল দিয়েছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত সংশয়যুক্ত এবং সম্ভবতা পশ্চিমা ব্র্যান্ডের শক্তি দুর্বল করেছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বনেতা, কূটনীতিক এবং ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা জানেন যে তারা নবযুগ সৃষ্টিকারী একটি সময়ে জীবনযাপন করছেন। প্রতিদিনের লড়াইয়ের দিকে তাদের একচোখ রাখতে হচ্ছে আর আরেক চোখ রাখতে হচ্ছে বিশ্ব সংকট মোকাবিলায় দায়িত্বের দিকে। কিন্তু বিশ্ব জনমতের আদালতে প্রতিদ্বন্দ্বী মতাদর্শ, শক্তিশালী জোট, নেতা এবং সামাজিক সংহতির ব্যবস্থাকে চাপের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে বৈশ্বিকভাবে প্রত্যেকে নিজস্ব পাঠ নিতে শুরু করেছে।

তবে যতই পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থার কথা বলা হোক না কেন, বৈশ্বিক চিন্তাবিদদের আলোচনার সূত্রপাত সহযোগিতা নিয়ে নয়, বরং চীন বা আমেরিকায় করোনা–উত্তর কে নেতা হিসেবে আসবেন, তা নিয়ে।

করোনাভাইরাস নিয়ে রাজনীতি এখন টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড। বিশ্বজুড়ে চলছে নানা বিতর্ক।  করোনা চীনের জৈবাস্ত্র নাকি যুক্তরাষ্ট্রের—এ নিয়ে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো একে অপরকে নানা রাজনীতি, বিতর্ক উসকে দিচ্ছে। বলা যায়, এসব কথার লড়াই বিশ্ব রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে।

তথ্যসূত্র: গার্ডিয়ান, বিবিসি, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি বাংলা, তেহরান টাইমস

পড়ুন:



ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়