ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কলকাতায় গরুর মগজ দিয়ে গরম ভাত

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫২, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কলকাতায় গরুর মগজ দিয়ে গরম ভাত

ফেরদৌস জামান : কর্নাটক থেকে তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশ, উড়িশ্যা, সব শেষে বিহার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা; কিছু কম-বেশি চল্লিশ ঘণ্টা ট্রেন জার্নির পর পা রাখলাম মাটিতে। এতটা সুদীর্ঘ পথে দেখলাম অঞ্চল ভেদে আবহাওয়ার ব্যাপক বৈচিত্র। কত দিন পর দেখলাম এক সঙ্গে অনেকগুলো বাংলা ভাষাভাষী মানুষ, মন চাইছিল কারও সাথে প্রাণ ভরে গল্প করি! কিন্তু কার সাথে? চেনা-জানা তো কেউ নেই, তবে এক জন মিলতে পারে, তাও আজ নয় কাল বা পরশু।

হাওড়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছুটলাম হোটেলের দিকে। বিশাল হাওড়া ব্রিজ, পারাপার করছে শত শত যান। কত বছর আগে তৈরি, অথচ ঠিকভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় ব্রিটিশ কারিগরী দক্ষতা কতটা সুনিপুণ ছিল! একই প্রমাণ মেলে আমাদের দেশে পদ্মা নদীর উপর নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখলে। এত বড় হাওড়া ব্রিজ, অথচ দুই সংযোগ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো খুঁটি বা পিলার নেই। প্রতিটি নাট-বল্টু বা সংযোগগুলো স্পষ্ট। টিভিতে এই জিনিস দেখে কে না বিস্মিত হতো! বিস্ময়ের সেই ব্রিজ আমাকে এপাড় থেকে ওপাড় নিয়ে যাচ্ছে। ছিটেফোঁটা বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পেতে আবেগের লাগাম টেনে জানালা থেকে মাথা সরিয়ে কাঁচটা উঠিয়ে দিতে হলো। সময় মতো উপস্থিত হলাম জাকারিয়া স্ট্রীটের হোটেল প্যারামাউন্টে।

একটা ঝরঝরে গোসল দিয়ে সংক্ষিপ্ত বিশ্রাম, তারপর বেরিয়ে পরলাম মহানগর কলকাতা দেখতে। ধর্মতলা হয়ে নিউমার্কেট এলাকায় পায়ে হাঁটা ভ্রমণের পর ইচ্ছা জাগল ট্রামে আরোহণের স্বাদ নিতে। সড়কের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বহু পুরনো ট্রাম। সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা বইয়ে ‘আবার অসিব ফিরে’ নামক একটি কবিতা ছিল। বাংলার শিক্ষক কবিতার আগে শুরু করলেন কবির জীবনী দিয়ে। জীবনী পড়ানোর সময় শিক্ষকের মুখে জেনেছিলাম, কলকাতায়  ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় কবি জীবনানন্দ দাশের। তখন থেকেই মনের মধ্যে সংকল্প ছিল, কলকাতা গেলে যে জিনিসগুলো দেখব বা উপভোগ করব তার মধ্যে অন্যতম হবে এই বাহণে চেপে শহরটা ঘুরে দেখা।

 



কলকাতায় আমার সংক্ষিপ্ত ট্রানজিট দুই কি তিন দিনের। সুতরাং চাইলেও ব্রিটিশ ভারতের এক সময়ের রাজধানী এই মহানগরী ঘুরে দেখে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। দু-এক জনের সাথে কথা বলে জেনে নিলাম বিরলা তারামন্ডলের দিকে যাওয়ার পথ কোন দিকে। জায়গা মতো দাঁড়িয়ে থাকতেই চলে এলো রংচটা শরীরের একটি ট্রাম। আসনে বসে খেয়াল করি মাথার উপর খাঁচায় বন্ধ প্রকাণ্ড এক ফ্যান বন বন করে ঘুরছে আর তাতে যে সুললিত সুরের উৎপাদন হচ্ছে তার কারণে আপাতত দুই কান অচল। এরই মধ্যে সন্ধ্যা নেমে গেছে। কিছু লোক ফ্যানের কারণে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে কথা বলছে, কিছু লোক ঝিমুচ্ছে আর অনেক আসন ফাঁকাই পড়ে রয়েছে। কোনো আসনের নরম তুলা উঠে গেছে অনেক আগেই, যেন বড় বড় পিড়ি পেতে রাখা। এবার নিচ থেকে ভেসে আসছে ক্যাচর-ম্যাচর, ঘটর-মটর শব্দ। কয়েক মুহূর্তে এসব অবলোকনের পর ভাবলাম, জিনিসটি লর্ড ক্লাইভের আমলের না হলেও ডালহৌসির আমলের যে হবে তাতে সন্দেহ নেই।

বাগানের পাশ দিয়ে, পার্কের পাশ দিয়ে আবার কখনও সড়কের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চললো। প্রায় এক ঘণ্টা পর জানতে পারি ভুল পথে এসেছি, অথবা ভুল ট্রামে উঠেছি অথবা কাঙ্ক্ষিত স্টপেজ ছেড়ে চলে এসেছি-এমন কিছু একটা। সামনেই নেমে কিছু দূর হেঁটে পূনরায় ট্রাম ধরে ফিরে এলাম আগের জায়গায় এবং তারামন্ডল পরের দিন দেখব বলে ঠিক করে রাখলাম। তারামন্ডল কি জিনিস ভেতরে প্রবেশের আগে জানতামই না। শুধু সকলেই বলে এই জিনিস দেখ তাই দেখার আগ্রহ। হিন্দী-বাংলা-ইংরেজি এভাবে একের পর এক তিন ভাষার আলাদা শো পরিবেশিত হয়। আমরা বাংলার জন্য অপেক্ষা করলেও টিকিট না পেয়ে ইংরেজিই বেছে নিতে হলো। আমাদের ঢাকাস্থ নভো থিয়েটারে যা দেখানো হয়, মনে আছে আজ থেকে ১৩-১৪ বছর আগে বিরলা তারামন্ডলে তার চেয়ে উন্নত পরিবেশনা উপোভোগ করে এসেছি। বিশাল কলকাতা ময়দান যার দক্ষিণ কোণে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম স্থাপনা নিদর্শন এই মেমোরিয়াল হাউস। ১৯০১ সালে রানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন রানীর স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মারক প্রাসাদ ও উদ্যান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯০৬ সাল থকে শুরু করে ১৫ বছরে নির্মাণ করা হয় এই ভবন। সাদা মার্বেলে মোড়ানো দৈর্ঘ ও প্রস্থে ৩৩৮ ফুট এবং ২২৮ ফুট। উচ্চতা ১৮৪ ফুট এবং ৬৪ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বাগান।

 



বাগানের পর প্রধান ফটক পেরিয়ে আলগা পাথর বিছানো চওড়া পথের পর মূল ভবন। তার আগে টিকিট কেটে নিতে হলো। এক্ষেত্রে রয়েছে স্থানীয় এবং বিদেশী দর্শনার্থী ভেদে আলাদা মূল্য। বিষয়টি আমার জানাই ছিল না, লাইনে দাঁড়ানো বাকিদের সাথে পাঁচ কি দশ রুপির টিকিট কেটে ঢুকে পরেছি। বের হওয়ার পর জানতে পাই, বাংলাদেশ থেকে এসেছি জানতে পারলে গুনে গুনে দেড়শ কি দুইশ রুপি মূল্য পরিশোধ করতে হতো। যা হোক, ভবনের মাঝে একাধিক গ্যালারী। প্রতিটি গ্যালারীতে প্রদর্শিত হয়েছে নানান নিদর্শন। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় নেতাদের ছবি, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রাণ উৎসর্গকারী বিপ্লবীদের ছবি নিয়ে গ্যালারী। রানী ভিক্টোরিয়া ও প্রিন্স এ্যালবার্টের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার উপর আঁকা অনেক ছবি এবং পাথর ও ব্রোঞ্জ নির্মিত রানীর একাধিক মূর্তি প্রদর্শিত রয়েছে। আরও বহু মূল্যবান জিনিসের মধ্যে প্রদর্শিত রয়েছে ১৯৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের নকশা সংবলিত টেবিল। কাঁচের বাক্সে বন্ধ করা নকশাটি আজও অটুট রয়েছে। বঙ্কিম বা ঈশ্বরচন্দ্রের পড়ার টেবিলও প্রদর্শিত রয়েছে।

সন্ধ্যার পর ছুটতে হলো মেগনাম ওভারসিজের খোঁজে। এখানে গেলে বাবার বাংলাদেশী বংশদ্ভুত বন্ধু আসিফ আলী চাচাকে পাওয়া যাবে। কোন রোড ছিল, ঠিক মনে নেই। হোটেল থেকে বেশি দূর নয়। এই সুযোগে বাবার মুখে শোনা কলকাতার রিক্সায় চড়ার অভিজ্ঞতা নিতে চাইলাম, যা তিনি স্বয়ং আজও পর্যন্ত অর্জন করে উঠতে পারেননি। নিজের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটাতে পারিনি, প্রথম বারেই ব্যর্থ হতে হয়েছে। কুচকুচে কালো বৃদ্ধ, গায়ে কাপড় নেই, পায়ে স্যান্ডেল নেই। পরনে মালকোচা দেয়া ধুতি। যখন রিক্সা নিয়ে সামনে দাঁড়াল তাকে আর বলতে পারিনি যে অমুক জায়গায় যাবেন কি না। তারপরই বুঝতে পারি, বাবার কেন এই বিষয়ে আজও অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেনি। এমনিতেই রিক্সা চালানো পেশাটা পৃথিবীর অমানবিক পেশাগুলির মধ্যে একটি। তার উপর দিয়ে কলকাতার দৌড়ে টানা রিক্সা আরও বেশি অমানবিক মনে হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় এর-ওর কাছে জেনে নিয়ে হেঁটেই বাবার বন্ধুকে খোঁজা শুরু করলাম। খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার খোঁজ পেলাম না!

 



নিকটেই মসজিদের পাশে খোলা বাজারে মানি চেঞ্জের ব্যবস্থা। মাথায় টুপি দেয়া লোকটি রাস্তার ধারে টুল নিয়ে বসে থাকে, রেটও ভালো। অনেক দিনের বেশ কিছু বাংলাদেশি মুদ্রা ছিল। এদিকে রুপির সংকট দেখা দিয়েছে। সুতরাং, প্রয়োজনীয় পরিমাণ টাকা এখান থেকেই রুপিতে পরিবর্তন করে নিতে হলো। চাচাকে খোঁজাখুঁজি বাদ, রণে ভঙ্গ দিয়ে এবার রাতের খাবারের অনুসন্ধান করতে গিয়ে যে জায়গার খোঁজ পেয়ে গেলাম তা আজও ভুলতে পারিনি। আশপাশেই নাকি গরুর মগজ দিয়ে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। অনেক দিন এই জিনিস খাওয়া হয়নি, দেখা যাক না কলকাতার গরুর মগজের স্বাদ কেমন হয়! বাবার বন্ধুকে খুঁজে না পেলেও গরুর মগজের সন্ধান ঠিকই পেলাম। একেবারেই চিপা গলি, এক ফুটের মতো চওড়া হবে। দুই পাশে পুরনো দালানের উঁচু দেয়াল। যেন কবরের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। একটু পর বিপরীত দিক  থেকে ধোঁয়া আসতে শুরু করলো। এই গলিতে নাকি এমন ধোঁয়া ৩৬৫ দিনের ব্যাপার। অতঃপর ছোট্ট দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে ঘরজুড়ে কেবল ধোঁয়া  আর ধোঁয়া, তার উপর মে-জুন মাসের তীব্র গরম। স্কুলের মতো বেঞ্চ পাতা, তাতেই খাওয়ার কাজ সারতে হয়। বিশ রুপিতে এক পিরিচ মগজ ভাজি। মুখে এক গ্রাস দেয়ার পর বুঝতে পারলাম, তীব্র গরমের মাঝেও মানুষ এই ধোঁয়ার মধ্যে কেন হুমড়ি খেতে আসে। পরের দিন কলকাতার শেষ দিন। এই দিন পরিবারের ছোট্ট সদস্যদের জন্য সামান্য কিছু কেনাকাটা করে সন্ধ্যার বাসে দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জানুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়