ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

কাকের জন্য ছোট্ট আলো’র ভালোবাসা

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২১ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাকের জন্য ছোট্ট আলো’র ভালোবাসা

কাক ভালবাসার মতো পাখি নয়, সেই কাকই খুলনা মহানগরের এক ছোট্ট মেয়ের ভালবাসার পাখি। কাকের সাথে তার সখ্যতা মুগ্ধ হওয়ারই মতো।

ছোট্ট মেয়েটির নাম জান্নাতি আলো। বয়স সবেমাত্র তিন বছর। কিন্তু এই শিশু বয়সেই কাকের জন্য তার মনে জন্ম নিয়েছে বিশেষ ‘ভালোবাসা’। আর এ ভালোবাসা থেকে প্রতিদিনই শিশুটি তার প্রিয় কাকদের খেতে দেয় মুড়ি ও খই । সঙ্গে বিশুদ্ধ পানিও। এ যেন তার দৈনিক রুটিন। অবশ্য ফাঁকে ফাঁকে অবচেতন মনে সে নিজেও কাকদের সঙ্গে মুড়ি-খই খায়।

শিশু আলো’র এই কাকপ্রীতিতে মুগ্ধ তার পরিবারও। তাই মেয়ের ইচ্ছেপূরণে তারাও পাশে দাঁড়ায়। যোগাড় করে দেয় ওর কাকের খাবার। কাকের প্রতি আলো’র এমন মুগ্ধতাকে নিজেরাও উপভোগ করে।

বুধবার বিকেলে এ প্রতিবেদকের ক্যামেরায় ধরা পড়ে ছোট্ট শিশু আলো’র এ বিশেষ ভালোবাসার দৃশ্য। এ যেণ কাকের সঙ্গে জান্নাতি আলো’র এক বিশেষ বন্ধুত্ব। চোখ জুড়ানো এ দৃশ্য দেখলে যে কেউই মুগ্ধ হতে বাধ্য। অবশ্য, কাকের প্রতি ছোট্ট আলো’র এ ‘ভালোবাসা’র পিছনে রয়েছে তার সাংবাদিক বাবার প্রেরণা।

খুলনা মহানগরের প্রাণকেন্দ্র পিকচার প্যালেস মোড় সংলগ্ন ‘গোল্ডেন কিং’ নামক ছয়তলা বিশিষ্ট একটি বাণিজ্যিক ভবন। ভবনটির পঞ্চম তলায় আঞ্চলিক পত্রিকা ‘দৈনিক আমার একুশ’ ও ‘বাংলাভিশন টিভি’র খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়। সাংবাদিক আতিয়ার পারভেজ প্রতিষ্ঠান দু’টি পরিচালনা করেন। পুত্র আপন পারভেজ ও কন্যা জান্নাতি আলো এ দু’ সন্তানের জনক তিনি।

প্রতিদিন বিকেলে বাবা আতিয়ার পারভেজ তার ছোট্ট কন্যা জান্নাতি আলোকে সঙ্গে নিয়ে ভবনটির ছাদে উঠেন। সঙ্গে থাকে খই, মুড়ি ও পানি। এসব ওই তার কন্যার কাককুলের জন্য। কিন্তু লোকজনের আনাগোনা থাকলে বিশেষ এ ‘মেহমানদের’ ডিস্টার্ব হবে- এ বিবেচনায় ছাদের গেটলক করেই চলে ‘আপ্যায়ন’। এ জন্য কিছু সময়ের জন্য ছাদে কাউকে উঠতে দেয়া হয় না।

বিষয়টি জানতে পেরে কৌতুহল বশত: এ প্রতিবেদক দৃশ্যটি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে রাজি হন আতিয়ার পারভেজ। সঙ্গে থাকার সুযোগও মেলে। সে মোতাবেক বাবা-কন্যার সঙ্গে বুধবার বিকেলে এ প্রতিবেদক ছাদে উঠে দেখতে পান পাখি প্রেমের বিরল এক দৃশ্য।

দেখা যায়, বাবা-কন্যার হাতে দু’টি বড় পাত্র, যার একটিতে মুড়ি আর অন্যটিতে খই ভর্তি। ছাদে ওই সময় একটিও কাক না থাকলেও ক্ষণিকের মধ্যেই একটি/দু’টি করে আনাগোনা শুরু হয়। আর ফাঁকে ফাঁকে বাবা-কন্যার খই, মুড়ি ছড়িয়ে দেওয়ার মুহূর্তেই ছাদ ভরে যায় কাক আর কাক-এ। শত শত কাক ভিড় করে আর খাওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। যেন বিভিন্ন সাইজের দাঁড় কাক ও পাতি কাকের মেলা। খই-মুড়ি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কাককুলকে পানিও পান করতে দেখা যায়।

এ সময় একটি খুঁটির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা ও ঠোঁট বাঁকা একটি কাক দেখিয়ে ছোট্ট আলো তার বাবাকে বলতে শোনা যায়, ‘বাবা ওইযে তোমার কাক এসেছে, ওই একটিই তোমার আর সবগুলো কাক আমার, ওই কাকটি অসুস্থ, ওইটিকে খেতে দিচ্ছে না, ওরা মারামারি করছে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ছোট্ট মুখে এসব কথা শুনে এবং কাকদের মধ্যেই ছোট্ট শিশুর বিচরণে মনে হয় কাককুল আরো অনুপ্রাণিত হয়। মানুষ দেখলেই যেখানে কাক উড়ে যায়, সেখানে ছোট্ট আলোকে দেখে উড়ে যায়না- ভয় পায়না।

কাককুলের প্রতি এ ধরণের ভালোবাসা তৈরির পিছনের খবর জানালেন ছোট্ট আলো’র বাবা। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, কয়েক মাস আগে বর্ষা মৌসুমে খুলনা নগরীর অধিকাংশ স্থান পানিতে তলিয়ে যায়। ওই সময় তিনি লক্ষ করেন কাকেরা খাদ্য এবং বিশুদ্ধ পানি সংকটে ভূগছে। মনের এই ভাবনা থেকে কাকদের খেতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। যথারীতি মুড়ি দিয়েই শুরু করেন যাত্রা। প্রতিদিন আছরের নামাজের পর ছাদে উঠে এভাবে কাকদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়। মাঝে-মধ্যে খইও থাকে খাদ্য তালিকায়। এ সময় তিনি একটি পাত্রে বিশুদ্ধ পানিও দেন। খই-মুড়ি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কাকরা পানিও পান করে।

তিনি লক্ষ্য করেছেন, অন্য কোথাও নিজেদের মধ্যে বিবাদ বা দ্বন্দ্ব হলে কাকরা এই ছাদে খেতে এক জায়গায় হওয়ার সুবাদে গোল হয়ে বিবাদ মিমাংসা করে, দোষি হলে সবাই মিলে তাকে শাস্তি দেয় আবার কেউ অসুস্থ হয়ে খাবার খেতে না পারলে ঠোঁটে করে নিয়ে তার মুখে খাবারও তুলে দেয়। এসব দৃশ্য দেখে তিনি খুবই আনন্দ পান এবং আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। যে কারণে তার মেয়েকেও এখন সঙ্গে নিয়ে এ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ইতিমধ্যেই ছোট্ট আলোর মনেও পাখির প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। এখন বিকেল হলে আলোই কাকদের খাবার দেয়ার জন্য তাকে ডাকাডাকি করে।

আতিয়ার পারভেজ বলেন, ‘বিষয়টি বড় ধরণের কিছুই না, তারপরও এভাবে প্রাণির প্রতি ছোট্ট ছোট্ট ভালোবাসা আমাদের মধ্যে সৃস্টির প্রতি আরো মানবিক এবং ভালোবাসা তৈরিতে অনুপ্রাণিত করতে পারে।’


খুলনা/মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়