ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কূটনীতিতে অর্থনীতির গুরুত্ব, রোহিঙ্গা নিয়ে চ্যালেঞ্জে কেটেছে বছর

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কূটনীতিতে অর্থনীতির গুরুত্ব, রোহিঙ্গা নিয়ে চ্যালেঞ্জে কেটেছে বছর

চলতি বছরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য ছিল লক্ষনীয়। বছর জুড়েই রোহিঙ্গা ইস্যুতে দৃশ্যমান কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল বাংলাদেশের। তবে এক্ষেত্রে প্রাপ্তির চেয়ে চ্যালেঞ্জ ছিল বেশি।

চলতি বছর থেকে বৈদেশিক সর্ম্পকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্ট্যাটাস পরিবর্তনের কাজ শুরু করেছে সরকার। বাংলাদেশ এখন আর নিম্ন আয়ের দেশ নয়। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কূটনীতির বার্তা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে বাংলাদেশ অনেকটাই সক্ষম হয়েছে।

বছরের মাঝামাঝিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে প্রিয়া সাহার সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ কূটনৈতিক অঙ্গনে নাড়া দেয়। যদিও বাংলাদেশ সেই ধাক্কা সামলেছে ভালোভাবে। বছর জুড়ে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের কূটনৈতিক আয়োজনকে সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল তৃতীয় ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের (আইওআরএ) ব্লু ইকোনোমি মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্স। বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি-পররাষ্ট্র মন্ত্রীসহ দুই শতাধিক উচ্চপদস্থ বিদেশি কর্মকর্তা এতে অংশ নেন।

আগামী বছরকে সরকার ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপন করা হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে সম্পৃক্ত করতে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতাও সাধুবাদ পাচ্ছে। তবে বছরের শেষ সময়ে এসে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে কিছুটা বৈরিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার ‘গ্লোবাল মাইগ্রেশন রিপোর্ট-২০২০’ শিরোনামের প্রতিবেদন অনুসারে, এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্রবিহীন মানুষ বাংলাদেশে রয়েছে। কয়েক দফায় এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। এসব শরণার্থী কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার কারণে সৃষ্ট সংকট সমাধানের বিষয়ে এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের অসহযোগিতার কারণে চলতি বছরে দুই দফা উদ্যোগ নিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতায় গাম্বিয়া মিয়ারমানের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে। এরই মধ্যে এই মামলার শুনানি হয়েছে। বিষয়টিকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হলেও প্রত্যাবাসন এবং ভাষানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর ইস্যুতে সরকার এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।

চলতি বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো অগ্রগতি না হলেও ফেনী নদী থেকে ভারতকে পানি দিতে রাজি হয় বাংলাদেশ। যদিও এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সম্পূর্ণ মানবিক কারণেই প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এ সিদ্ধান্ত নেন।

সারা বছর ধরেই আলোচনায় ছিল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালুর তৎপরতা। কয়েক দফা দুই দেশের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হলেও বছরের শেষদিকেও সরকারের পক্ষ থেকে দেশটির শ্রমবাজার চালুর সুসংবাদ আসেনি। এর সঙ্গে শঙ্কা জাগিয়েছে বাংলাদেশের জন‌্য সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে শ্রমিকদের ফেরত আসা। দেশটিতে ধরপাকড়ের মুখে এ বছর ২১ হাজারের বেশি বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। সৌদি শ্রমবাজার নিয়ে আরেকটি শঙ্কার জাগায় হলো সেখানে নারী কর্মীদের ওপর নির্যাতন। দেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে কয়েকজন নারী কর্মীর ভিডিওবার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তাদের প্রত্যেককে সরকারের তৎপরতায় অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ফেরত আনা সম্ভব হলেও দেশটিতে নারী কর্মী না পাঠানোর দাবি ওঠে।

তবে শ্রমবাজারকেন্দ্রিক কিছু ভালো উদ্যোগও ছিল সরকারের। চলতি বছরে সংযুক্ত আবর আমিরাতের শ্রমবাজার আবারও চালু হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্র সিশেলসে পুরনায় জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়েছে। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজার বাংলাদেশি কর্মী কর্মরত রয়েছেন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতিতে প্রাধান্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। এখন রাজনৈতিক কূটনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে বছর জুড়ে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল লক্ষনীয়। চলতি বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দূতাবাস বাড়ানোর পাশাপাশি বিদ্যমান দূতাবাসগুলোকে নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।  একইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরো ১০০টি বৈদেশিক মিশন স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার।

জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের আয়োজনে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৪তম শাহাদাৎবার্ষিকী এবং জাতীয় শোক দিবস পালিত হয়। বিষয়টিকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। এছাড়া, জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু বা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া রোধে সচেতনতা সৃষ্টি’ বিষয়ে রেজুলেশন গ্রহণের ক্ষেত্রে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

চলতি বছরেও বেশকিছু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি যোগ হয়েছে বাংলাদেশের ঝুলিতে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিষদে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিষদের সহ-সভাপতি হিসেবে আগামী দুই বছর এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের ৪৪টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করাসহ সকল সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করবে।

জাতিসংঘের কমন ফান্ড ফর কমোডিটিজের (সিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, জার্মানি, ইতালি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ ১০১টি দেশ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আফ্রিকান ইউনিয়নসহ নয়টি সংস্থা এই সংগঠনের সদস্য।


ঢাকা/হাসান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়