ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘কেঁদে ফেললেন হুমায়ূন আহমেদ’

আমিনুল ইসলাম শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ১৩ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘কেঁদে ফেললেন হুমায়ূন আহমেদ’

সাহিত্যিক, গীতিকার, নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ কেমন মানুষ সবাই জানেন। কিন্তু ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ কেমন? আমি ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়েই কথা বলব। তিনি মানবিক হৃদয়ের ছিলেন। হিপোক্রেসি পছন্দ করতেন না। কাউকে কিছু বলতে চাইলে সরাসরি মুখের উপর বলতেন। মানুষকে প্রচুর সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। ‘অন্যের জন্য ভাবেন’—এমন মানুষ সচরাচর খুব কম পাওয়া যায়। ধরুন, একজন মানুষ অসুস্থ হয়েছে কিংবা নাট্যাঙ্গনের কেউ বিপদে পড়লে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন তিনি।

আমি ‘আজ রবিবার’ নাটকের শুটিং করছিলাম। সেট ছিল বিআরটিএ-তে। এই নাটকে আমি ও আমার স্ত্রী নাসরিন অভিনয় করেছিলাম। শুটিং শিডিউল ছিল ৩০ দিনের। কিন্তু আমরা কাজ করেছি মাত্র সাতদিন। আরো ২০ দিনের শুটিং বাকি ছিল। এ সময় আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে ছিল। বিষয়টি হুমায়ূন ভাইকে আমি বলিনি। কিন্তু তিনি কোথা থেকে যেন শুনেছেন আমার ভাইয়ের বিয়ে। হঠাৎ পুরো মাসের টাকা খামে ভরে নাসরিনের হাতে দিয়ে দিলেন। আমি বললাম, এটা কী? দুষ্টুমি করে হুমায়ূন ভাই বললেন, ‘আমি শুনলাম তোমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে। কিন্তু তুমি তো কিছু বলবা না, যদি দাওয়াত দেয়া লাগে!’ আমি বললাম, এখনো তো শুটিং শেষ হয়নি। টাকা দিচ্ছেন কেন? জবাবে বললেন, ‘না, এখন এটা রাখো তোমার কাজে লাগবে। তাছাড়া টাকা তোমাকে দিতেই হবে। তারচেয়ে এখনি দিয়ে দিলাম।’ এই হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ। এমন ঘটনা শুধু আমার সঙ্গে ঘটেনি, বহু মানুষের সঙ্গে তিনি এমন মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। 

সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের এমন কোনো ঘর নাই যেখানে তিনি নেই। বৃক্ষপ্রেমী হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি দিক রয়েছে। নুহাশ পল্লীতে ঔষধী গাছের বাগান রয়েছে। পাশাপাশি ফুল ও ফলের বাগানও গড়ে তুলেছেন তিনি। নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন আহমেদ যা গড়েছেন তা আমাদের মতো মানুষের করতে এক জনম লেগে যাবে!

হুমায়ূন আহমেদ খুব মজার মানুষ ছিলেন। তার সঙ্গে বসলে কখন সময় কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না। সবসময় মজা করতেন। একটি ঘটনা বলি, হুমায়ূন ভাই নাটকের এডিটিং করতেন চ্যানেল আইয়ে। তখন কার্যালয় সিদ্ধেশ্বরীতে ছিল। একদিন দুপুর ১টার দিকে আমাকে ফোন করে চ্যানেল আইয়ে যাওয়ার জন্য বললেন। গেলাম। হুমায়ূন ভাই বললেন, ‘বসো, এডিটিং দেখো। আর আমার সাথে দুপুরের খাবার খাও।’ আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, আমি খেয়ে এসেছি। দ্বিতীয়বার বলায় তার সঙ্গে বসতেই হলো। দু’জন খাচ্ছি, হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হায় হায় তুমি নাকি খেয়ে আসছো! খেয়ে এসে এত ভাত-তরকারি খাচ্ছো? না খেয়ে আসলে তো আমরা খাবারই পেতাম না, তুমি সব খেয়ে ফেলতা!’ এমন অনেক মজা করতেন।

হুমায়ূন ভাই বলতেন, ‘জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ মিথ্যা বলা, হিপোক্রেসি করা বা কথা দিয়ে কথা না রাখা, মানুষ ঠকানো।’ এসব কাজ নিজে কখনো করতেন না এবং সহ্যও করতেন না। তিনি বলতেন, ‘শখের তোলা আশি টাকা। তোমার যদি কোনো শখ থাকে তবে সাধ্য অনুযায়ী তা পূরণ করো। আমি সেন্টমার্টিনে বাড়ি করেছি। সেখানে বাড়ি করার মতো অনেক ধনী লোক আছে। কিন্তু তারা বাড়ি করেনি, আমি করেছি। কারণ আমার শখ ছিল— নিজের বাড়িতে বসে সমুদ্র দেখব।’   

হুমায়ূন ভাই তার লেখা ‘লিলুয়া বাতাসে’ উপন্যাসটি আমাকে উৎসর্গ করেছেন। তার মতো একজন সাহিত্যিক আমাকে বই উৎসর্গ করেছেন। এ খবর যখন জানতে পারি তখন খুব ভালো লেগেছিল। এটা আমার কাছে অনেক আনন্দের মুহূর্ত ছিল। তার সঙ্গে এমন অনেক আনন্দের ঘটনা আছে। তার মধ্যে এটা অন্যতম। আর তার মৃত্যু খবর যখন শুনি সেটা ছিল সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত।

হুমায়ূন ভাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৫ দিনের জন্য যখন দেশে ফেরেন, তখন নুহাশ পল্লীতে দেখা করতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি মিডিয়ার অনেক লোকজন সেখানে উপস্থিত। এ সময় সবার সামনে একটি ঘটনা বলেন তিনি। ঘটনাটি হলো— একবার হুমায়ূন ভাইয়ের ছেলের জন্মদিনে আমাকে দাওয়াত দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। তারপর অন্য জায়গায় শুনে গিফট নিয়ে আমি হুমায়ূন ভাইয়ের বাসায় হাজির হই। আমাকে দেখে খুব অবাক হন তিনি। তারপর ঘুরে ঘুরে অনান্য অতিথিদের কাছে নিয়ে যান। তাদেরকে বলেন, ‘দেখো, ফারুককে দাওয়াত দেয়া হয়নি, তারপরও ফারুক আসছে। এটাই সত্যিকারের ভালোবাসা। ফারুক কিন্তু চিন্তা করেনি হুমায়ূন আহমেদ দাওয়াত দেয়নি, তাই যাওয়া ঠিক হবে না।’ কথাগুলো বলেই কেঁদে ফেললেন হুমায়ূন আহমেদ। এরপর তিনি বলেন, ‘গুডবাই ফারুক।’ এ সময় আমিও নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। তারপর বাসা থেকে বের হয়ে চলে আসি।

শ্রুতিলিখন: আমিনুল ইসলাম শান্ত

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়