ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

কয়েদখানা থেকে স্মৃতি জাদুঘর

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪১, ৯ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কয়েদখানা থেকে স্মৃতি জাদুঘর

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : কেউ আসামিদের দেখতে আসত, কেউ জামিনে আসামিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসত। আসামিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতো কেউ কেউ। ফলে আত্মীয়-স্বজনদের ভিড় জমতো কারা ফটকে। কারো দেখা হতো, কারো দেখা হতো না। অপরাধীরা কারাগারে প্রবেশের সময় কাঁদতেন, মুক্তিতে হাসতেন। রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তিতে প্রতিদিনই ফুলের মালা বদল হতো। কারা ফটক থেকেই বের হতো আনন্দ মিছিল। ছিল কারারক্ষীদের নিরাপত্তা বলয়।

 

গত ২৯ জুলাই পর্যন্ত এমন দৃশ্য চোখে পড়তো পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে। দেশের সবচেয়ে পুরনো এ জেলখানার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক দুঃখগাথা। অপরাধীরা তো বটেই বিভিন্ন সময়ের শাসক, বিদ্রোহী প্রজা কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহী ব্যক্তিবর্গ, রাজনীতিবিদ এমনকি এই তো কয়েক বছর হলো বিচার শুরু হওয়া স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদেরও অন্যতম সাক্ষী দেশের প্রথম এই জেলখানা।

 

১৭৮৮ সালে মাত্র একটি অপরাধ ওয়ার্ডের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের আমলে এই জেলখানার যাত্রা শুরু হয়। ২২৮ বছরের ইতিহাসে অনেক ঘটনা প্রবাহ আবর্তিত হয়েছে এখানে। ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বহু অপরাধীর। শুধুমাত্র স্বাধীন বাংলায় ৪৩৩ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ১৯৭৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে দিয়ে এই জেলখানায় ফাঁসির সূচনা। যার শেষ হয় যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির মধ্য দিয়ে।  

পুরনো ঢাকার এই জেলখানাজুড়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার সংগ্রামী জীবনের বহু স্মৃতিচিহ্ন। কারাগার সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দফায় দফায় দীর্ঘদিন কারাবন্দি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর যে দীর্ঘ কারাভোগের ইতিহাস, তা অন্য কোনো রাজবন্দির ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি। তিনি স্কুলজীবন থেকে শুরু করে ৫৫ বছর পর্যন্ত অন্তত ২৩ দফায় ৮ বছর ২ দিন কারাগারে থেকেছেন।

 

তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ২০১০ সালের ৮ মে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দেওয়ানি সেলটি ‘বঙ্গবন্ধু কারা স্মৃতি জাদুঘর’-এ রূপান্তর করা হয়। জাদুঘরটিতে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহার্য জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: নামাজের চৌকি, জায়নামাজ, অজু করার ঘটি, ময়না পাখির খাঁচা, বিছানাপত্র, খাবারের টিনের থালা, হাঁড়ি-পাতিল, কাপ-পিরিচ, পড়াশোনার ছোট্ট কাঠের টেবিল, কাঠের চেয়ার, কিছু পুরনো কাপড়-চোপড় এবং চুলা। এসব জিনিসের গায়ে ব্যবহার করার সময় উল্লেখ আছে। বঙ্গবন্ধুর জেল জীবনের ইতিহাস জানতে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি গ্রন্থাগার। সেলের সামনে খোলা জায়গাটিতে বসানো হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তি। জাদুঘর প্রাঙ্গণে ৬টি স্তম্ভে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ছয় দফা তুলে ধরা হয়েছে। আছে বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লাগানো একটি কামিনী ফুল গাছ ও একটি সফেদা গাছ। বঙ্গবন্ধুর গোসল করার ঘর ও রান্নাঘরটিও সংরক্ষণ করে এই জাদুঘরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

 

জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মনসুর আলী ও আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামানকে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যে সেলে তাদের হত্যা করা হয়েছিল, সেই সেলে তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে মৃত্যঞ্জয়ী শহীদ স্মৃতি জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। গত ২৯ জুলাই কারাগারের সকল আসামিকে কেরাণীগঞ্জের নতুন কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এবং দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী পুরনো ঢাকার কেন্দ্রীয় এই কারাগার রূপান্তর করা হয় স্মৃতি জাদুঘরে। গত ১ নভেম্বর উদ্বোধন শেষে ২ নভেম্বর থেকে একশ টাকা টিকিটের বিনিময়ে কারাগারটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

ঐতিহাসিক কারাগারটি এক নজর দেখার জন্য দর্শনার্থীদের ছিল উপচে পড়া ভিড়। এ সময় অনেককে ফাঁসির আসামিদের কনডেম সেলে ঢুকে কারারুদ্ধ অবস্থার অভিনয় করে সেলফিও তুলতে দেখা যায়। শুধু যে কৌতূহলী দর্শক এসেছেন তা নয়, দীর্ঘদিন সেখানে কারাভোগ করেছেন এমন অনেকেও কারাগারটি আবার দেখতে গিয়েছেন। তেমনি একজন রাসেল(৪০)। তিনি জানান, তিনি রাজনৈতিক কারণে ১৬ বার গ্রেফতার হয়েছেন। জেল খেটেছেন বেশ কয়েক বছর। তিনি বলেন, এটা ছিল অভিশপ্ত নরক। তার অভিযোগ, কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণ মানুষদের কষ্টের জায়গাগুলো দেখতে দিচ্ছে না। কেরানীগঞ্জের মোর্শেদুল মোমিন শিপু হত্যা মামলার আসামী হয়ে এ কারাগারের যমুনা সেলে দুই মাস আটক ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা একটি কক্ষে ২৮৪ জন মানুষ গাদাগাদি করে থাকতাম। ঈদের সময় কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে যেত। ঢাকা কলেজে পড়েন আমিনুল ইসলাম জুয়েল। তিনি ২০১৫ সালে কারাগারে এসেছিলেন ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি বলেন, ভাই ভিতরে ছিল, আমি বাহিরে ছিলাম। মাঝখানে মনে হয়েছিল কাঁটাতারের বেড়া। সেই কারাগারে এতো সহজে দর্শনার্থী হিসেবে ঢুকতে পারবো কখনো কল্পনা করিনি।

 

কারা প্রদর্শনী দেখতে ছেলেমেয়েসহ পিলখানা থেকে এসেছেন বিডিআর সদস্য সোলাইমান। তিনি বলেন, এমন বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হতে পারবো কখনো ভাবিনি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছি যাতে তারা ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে। কারা স্মৃতি জাদুঘর দেখতে দল বেঁধে এসেছেন বুয়েটের চার শিক্ষার্থী স্নিগ্ধা, তিথি, নাফিস ও আরাফাত। তারা বলেন, সিনেমায় দেখেছি, সরাসরি কখনো কারাগার দেখিনি, সেই কৌতূহল থেকে কারাগার দেখতে এসেছি।

 

কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় দুই বছর ধরে ঝালমুরি বিক্রি করেন সাগর মাতব্বর। তিনি জানান, কারাগার চালু থাকাকালীন তার বেচাবিক্রি ভালো হতো। এখন কারাগার জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করায়, তার বিক্রি আবার বেড়েছে। তবে ফাঁসির মঞ্চ এবং বিডিআর বিদ্রোহীদের রাখা রূপসা ভবনসহ কারাগারের প্রায় অর্ধেক এলাকা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল না।

 

জেলখানার ইতিহাস মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য নানা প্রয়াস নিচ্ছে কারা অধিদফতর। আগামীতে সপ্তাহে দু’দিন টিকিটের মাধ্যমে কারাগারে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে বলে জানান কারা কর্তৃপক্ষ।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ নভেম্বর ২০১৬/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়