ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

খেয়া ঘাটের মাঝি

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২১ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খেয়া ঘাটের মাঝি

ছাইফুল ইসলাম মাছুম: আব্দুল আলী (৬৫), ঢাকার কামরাঙ্গীরচর খোলামোড়া ঘাটের মাঝি। ছোট্ট ডিঙি নৌকাতে যাত্রী পারাপার করে চলে তার জীবিকা। শুধু আব্দুল আলী নন, বুড়িগঙ্গার এই খোলামোড়া ঘাটে খেয়া পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করেন প্রায় ১৩০ জন মাঝি।

খেয়া ঘাটের একপাশে কামরাঙ্গীরচর, অন্যপাশে কেরানীগঞ্জ। দুই পাশের কোয়াটার মাইল দূরত্বের এই রুটে ১২৪টি নৌকায় দিন রাত ২৪ ঘণ্টা মানুষ খেয়া পার হয়। যাত্রী প্রতি ভাড়া ৫ টাকা হলেও, পুরো নৌকা রিজার্ভ নেওয়া যায় মাত্র ২০ টাকায়।

সাহাব উদ্দিন আহমেদের বাসা কামরাঙ্গীরচরে। চাকরি করেন কেরানীগঞ্জের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। প্রতিদিন খোলামোড়া ঘাট দিয়ে খেয়া পার হয়ে অফিসে যেতে হয় তাকে। তিনি বলেন, দশ মিনিট সময়ে মাত্র ৫ টাকা দিয়ে নদীর ওপারে সহজে যেতে পারি। অন্য পথে নদীর ওপারে যেতে হলে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। খেয়া থাকায় আমরা কম টাকায় কম সময়ে গন্তব্যে যেতে পারি। বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের ছাত্রী সাবরিনা মৌ। তার বাসা কেরানীগঞ্জ হওয়ায় প্রতিদিন তাকে ক্যাম্পাসে যেতে হয় খেয়া পার হয়ে। তিনি বলেন, খেয়ার কারণে সহজে যেতে পারছি। রাস্তায় গেলে জ্যামে পুরো দিন লেগে যায়।

বুড়িগঙ্গায় দশ বছর ধরে ডিঙি চালান খেয়া মাঝি আব্দুল আলী। প্রথম দিকে ভাড়ায় নৌকা চালালেও বছর দুয়েক আগে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে একটি নৌকা বানিয়েছেন। এখন ডিঙি নৌকায় খেয়া পার করে চলে তার পাঁচ সদস্যের পরিবার। তিনি জানান, ফজরের নামাজের সময় থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খেয়া পারাপার করেন তিনি। খেয়া পার করে দৈনিক তার আয় হয় ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। খেয়া ঘাটের আরেক মাঝি আব্দুর রহিম। তিনি জানান, ২৫ বছর ধরে খেয়ায় যাত্রী পারাপার করেন তিনি। তিনি যখন খেয়াপার শুরু করেন, তখন যাত্রী প্রতি ভাড়া ছিল মাত্র ৫০ পয়সা।
 


অনেক মাঝির নিজস্ব ডিঙি নৌকা থাকলেও, কেউ কেউ নৌকা ভাড়া নিয়ে যাত্রী পারাপার করেন। এমনই এক মাঝি মাইন উদ্দিন (৩৫)। তিনি জানান, নৌকার ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে মালিককে দিতে হয় ২,২০০ টাকা। ঘাট খাজনা দিতে হয় ১২০ টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে তা দিয়ে টেনেটুনে পরিবার চলে। মাইন উদ্দিন বলেন, ‘নৌকা চালাতে ভালো লাগে না, পেটের অভাবে চালাই। অনেক পরিশ্রমের কাজ। ১৭-১৮ ঘণ্টা নৌকা চালিয়ে পাই মাত্র ২০০-৩০০ টাকা। সুযোগ থাকলে অন্য কাজ করুম মামা।’

রাজধানীর পাশ ঘেঁষা এই খেয়া ঘাটের বয়স খুব কম না। ব্রিটিশ আমল থেকে বুড়িগঙ্গার এপার-ওপারে খেয়ার মাধ্যমে যাত্রীরা যাতায়াত করে আসছেন। খেয়া ঘাট মাঝি কমিটির সভাপতি বারেক মিয়া (৬৭)। তিনি দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে খেয়া ঘাটে যাত্রী পারাপার করেন। তার বাবা হাসান আলীও এই খেয়া ঘাটের মাঝি ছিলেন। অনেকটা পারিবারিক কারণে খেয়ার সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এই খেয়া ঘাটের যাত্রা। মাত্র দুই পয়সায় যাত্রী পারাপার হতো তখন। পরে ভাড়া আস্তে বাড়তে থাকে। পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সা, এক টাকা, দুই টাকা করে এখন যাত্রী প্রতি ভাড়া পাঁচ টাকা।

বারেক মিয়া জানান, এই ঘাটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাতে খেয়া পারের সময় নৌকা ডুবে মারা গেছেন ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা। তখন স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে দাফন করেন। ১১ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে ঘাটে মুক্তিযোদ্ধা সৌধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন বারেক মিয়া।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ জানুয়ারি ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়