ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

গিরিখাদে বিপদ

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১২, ৪ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গিরিখাদে বিপদ

(ভিয়েতনামের পথে: ১৫ তম পর্ব)
ফেরদৌস জামান : পাই ক্যানিয়ন থাইল্যান্ডের অন্যতম এক গিরিখাত। এখানে এসে এই গিরিখাত না দেখে ফিরে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা একেবারেই শূন্য। অর্থাৎ দেখার আছে বিস্তর বিষয়, তার মধ্যে পাই ক্যানিয়নের অবস্থান অন্যতম। মানচিত্র বলছে দুই থেকে আড়াই কি তিন ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। তাতে সমম্যা নেই। উল্লাস, উচ্ছ্বাস আর বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পেমবক ওয়াটার ফল দেখার সফলতার আনন্দে পথ আর পথ-ই মনে হচ্ছে না, যেন গা ছেড়ে দিলে ভেসে যাব যত দূর খুশি! তাছাড়া, সময়ও আছে বিস্তর। বেলা থাকতে ক্যানিয়নে পৌঁছতে পারলেই হলো। ফেরার বিষয়টা পরে দেখা যাবে। ফাঁকা রাস্তা, যানবাহনের সংখ্যা নিতান্ত কম। এমন নিরালা পাহাড়ি পরিবেশে জানা সংগীতের মাঝ থেকে দু’একটা সুর না ভাজলে তো জমছে না!

গানে গানে পথ অনেকটাই এগিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে চা-কফি কিছু একটা পান করা দরকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে যাই তিন রাস্তার মোড়। একটা চলে গেছে সোজা নিচের দিকে, অন্যটা বাঁয়ে। একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম- আমাদের পথ কোনটা? ওদিকে বামের রাস্তাটা ধরে দূরে একটা রেস্টুরেন্ট দেখা যায়। এমন তো না কফি পান করে আবার এতখানি পেছনে এসে সোজা পথটা ধরে এগিয়ে যাব। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সোজা পথটা থেকে উঠে এলো এক ট্যাক্সি। ট্যাক্সি থেকেই জানিয়ে দেয়া হল বামেরটাই ক্যানিয়নের পথ। সোনায় সোহাগা! রেস্টুরেন্ট আর পথ দুই মিলে গেল। একাকি রেস্টুরেন্ট, তার সাথে বাড়ি। মানুষ বলতে তারাই কয়জন। বড় এক উঠান। ঠিক তার পেছন থেকে উপত্যকার সবুজ শ্যামল প্রকৃতি। বাতাসে ধানক্ষেত দুলে ওঠা সেই উপত্যকা যেন সকাল থেকে প্রদক্ষিণ করে চলেছি। ফ্রিজে রাখা এক ক্যান ঠান্ডা কফি নিয়ে ভেতরে গিয়ে বসে পরলাম। সাজশয্যায় শিল্পের ছোঁয়া। চেয়ার বলতে শুধমাত্র গাছের গুড়ি কেটে বসিয়ে রাখা। আরাম করে কফি পান শেষে আবারও পথে পা বাড়ালাম।



ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম পাই ক্যানিয়নে। এখান থেকে উঠে গেছে সিঁড়ি। মাঝখান দিয়ে কাঠের তৈরি বিভাজন রেলিং। এক পাশ দিয়ে উঠা অপর পাশ দিয়ে নেমে আসা। পর্যটক সমাগম এখনও তেমন জমে ওঠেনি। সীমিত ঘনত্বের অনুচ্চ গাছের ছায়া ঢাকা সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠতেই দৃশ্যমান হলো গিরিখাতের আঁকাবাঁকা প্রাচীর শ্রেণী। ডানে-বামে এগিয়ে গেছে গিরিখাতের শাখা-প্রশাখা। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের আলোয় লাল রঙের গিরি প্রাচীর যেন আরও জ্বলে উঠেছে। সামান্য ব্যবধানে দুটি বসার জায়গা। এর মধ্যে একটাকে আশ্রয় করে খাওয়ার কাজটা আগে সেরে নিলাম। ব্যাগে মজুদ কলা আর মাখন সহযোগে পাউরুটির কয়েকটা চাকা খেয়ে ভালোমতে গিরিখাত ঘুরে দেখার শক্তি সঞ্চয় করা গেল! এক পর্ব ছবি তোলার কাজ শেষ করতে করতেই দু’চারজন করে পর্যটক আসতে শুরু করল। প্রত্যেকের চোখেমুখে বিস্ময়ের ছবি- প্রকৃতির কি চমৎকার সৃষ্টি! চার দিকে পাহাড়-পর্বত শ্রেণীর মাঝ থেকে কত কত চূড়া মাথা তুলে শান্ত সৌম্য ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ-কুয়াশার মিহি পড়তে অনেক পর্বতই ঝাপসা হয়ে দিগন্তে বিলিন হয়ে গেছে। কিছু কিছু গিরি প্রাচীর এগিয়ে যেতে যেতে সুরু হয়ে থেমে গেছে। এমন দু’একটা প্রাচীর থাকা পর্যটকদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ হয়ে ধরা দিয়েছে। অতি সাবধানে বসে অথবা উপুর হয়ে কেউ কেউ এগিয়ে যাচ্ছে শেষ প্রান্তের দিকে।

ঝুঁকি নিয়ে হলেও কোনো ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সেই প্রবৃত্তির কারণে ঐ প্রান্ত পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া আর বীরত্ব প্রকাশের মত করে দুই একটা ছবি তোলার ঝুঁকি নিতে অনেকেই পরোয়া করছে না। দেখে মনে হবে প্রাচীরের ঠোঁটটা ভেঙে পরবে অথবা অভিযাত্রী নিজেই পা পিছলে পরে যাবে শত মিটার গভীরে। এক পর্যটক তো এমন অবস্থায় পতিত হলো, নিজের শরীরটাকে ঘুরিয়ে আর পেছনে ফিরে আনতে পারছিল না সহজে। আতঙ্ক আর অর্জন উভয়ের সংমিশ্রণে তার মুখে এক অবর্ণনীয় অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। এদিকে তার সহপাঠীরা পারে তো হেলিকপ্টার বা ক্রেন ডেকে তাকে উদ্ধার করার উদ্যোগ নেয়। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর নিজের মানসিক শক্তিকে জাগ্রত করে ভদ্রমাহিলা নিজেকে কোনোমতে ঘুরিয়ে নিয়ে অনেক সময় নিয়ে তীরে ফিরতে সক্ষম হলো। চারপাশ থেকে করতালি শোনা গেল তার জন্য।



আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি তার চেয়েও একটু বেশি অভিযাত্রী হয়ে উঠলাম। ঝুকিপূর্ণ অন্য এক গন্তব্যে নিজেদের চালিত করতে কুণ্ঠিত হলাম না। এঁকেবেঁকে এবং ওঠানামার পর সরু পৃষ্ঠদেশের পর প্রাচীরটা শেষ হয়েছে পিরামিড আকৃতির ছোট্ট চূড়ায় গিয়ে। পা মাত্র বাড়িয়েছি, দেখি খরখরে বালির উপর জার্মান এক যুবক দাঁড়িয়ে। তার প্রেমিকাকে অধিক সাহসী মনে হলেও যুবক নিজে আগে জায়গাটি ঘুরে আসতে চায়। কিন্তু চরম সীদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। হয়তো নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও পরীক্ষা করে আসতে চায় প্রেমিকার জন্য নিরাপদ হবে কি না জায়গাটি। নিজেও ভাবলাম একজন সঙ্গী হলে মন্দ হয় না। ওপাশ থেকে তার প্রেমিকা আর এপাশ থেকে আমি। উভয়ের উৎসাহে এবার সাহেব পা তুললেন। হেলে, বসে বা চার হাত-পায়ে কিছুটা নেমে পেছনে তাকিয়ে দেখি সে একরূপ ছেঁচড়ে নেমে আসছে। গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নির্ঘাৎ নিচে পরে ভর্তা হয়ে যাবে। খানিকটা পেছনে ফিরে গিয়ে বলদটাকে উদ্ধার করতে গিয়ে দেখলাম, সে ছোট্ট পাথরে পা ঠেকিয়ে আধবসা হয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। ওর পরিস্থিতি দেখে ভয় পেলাম।



উৎসাহ দিয়ে তো নিয়ে এলাম কিন্তু একে ফেরৎ নিয়ে যাব কীভাবে? ওদিকে উপর থেকে ওর প্রেমিকা উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনায় মাতৃভাষায় যা বলছে তা না বুঝলেও অন্তত এতটুকু অনুমান করতে পারলাম- সাহস রাখো আর আশাবাদী হও, তুমি আবশ্যই পারবে!  এগিয়ে গিয়ে হাতটা ধরে সাহায্য করতে চাইলে বলল, লাগবে না। লাগবে না বললে চলবে না, আমার হাতটা ধরো! হাত সামান্য বাড়িয়ে তা আবারও ফিরিয়ে নিল। একে নিয়ে তো ভারি বিপদ! একটু অপমানিত বোধ হলেও এই বলে এগিয়ে চললাম- প্রয়োজনে আমাকে ডেকো। ওদিকে প্রেমিকা বারবার ওকে আমার সাহায্য নিতে বলছে এবং চিৎকার করে তা আমাকেও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আমি এখন ফিরতি পথ ধরব। যদিও মনে মনে ভাবছি, এক রকম জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তো পিরামিডে আরোহণ করলাম ফিরে যাব কীভাবে? নিচে শাল গাছের শক্ত ডালগুলো উন্মুখ হয়ে আছে। একবার পিছলে পরার মানে শরীর তাতে সুন্দর করে গেঁথে গিয়ে লীলা সাঙ্গ হওয়া। অতি সাবধানে নেমে এলাম। ওদিকে বীরপুরুষ এক পাথর জড়িয়ে ধরে যেন ঝুলে আছে। পাছায় একটা সজোরে ধাক্কা দিতে গিয়ে রীতিমত ব্যর্থ হতে হলো। খরখরে বালিতে পা আটকে রাখা সহজ নয়। তাছাড়াও ওই সাড়ে ছয় ফুটের দেহ ঠেলে তোলা কি সহজ কথা! বহু চেষ্টা করেও শেষে ওকে বরং নামিয়েই নিলাম। ফিরে এসে নাকে খত দিয়েছি, জীবনে আর কোনো দিন এমন ঝুঁকি নেব না। অন্তত যার সম্বন্ধে পূর্বে ধারণা নেই তেমন মানুষের ক্ষেত্রে।



ইতিমধ্যে অনেক দর্শনার্থীর আগমন ঘটেছে। ঘুরে আবারও পূর্বের জায়গায় সেই ছাউনির কাছে এসে ডান দিকের প্রাচীরটা ধরলাম। দেখা যাচ্ছে দুই ধারে গভীর খাদ নিয়ে ওটা অনেক দূর এগিয়েছে। খয়েরি, সাদা আবার উভয় রঙের সংমিশ্রণে অজস্র পাথর খণ্ড ছড়িয়ে আছে পথজুড়ে। যেতে যেতে প্রাচীরের একাধিক শাখা-প্রশাখার মাঝ থেকে প্রধানটা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। পথ খানিকটা ঝুকে নিচের দিকে নেমে গেছে। ওটা ধরে আমরাও নেমে যেতে থাকলাম। গাছের ছায়ার তল দিয়ে ক্রমেই নেমে গেলাম খাদে। পাথর খণ্ড ছড়ানো। পথ মাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া বড় কঠিন। এদিক-সেদিক যেকোন দিক এগিয়ে যাওয়া সম্ভব কিন্তু জটিলতা না বাড়িয়ে ঠিক যে পথে আছি তাকে অবলম্বন করেই অগ্রসর হতে থাকলাম। পাথর, প্রাচীর আর গাছের ওপারে ঢাকা পড়ল উপরের সমস্ত মানুষ। খাদের তলদেশের বালির বিন্যাস দেখে বোঝা যায় বর্ষণে এদিক দিয়ে স্রোত বয়ে যায়। দুঃখ হলো সমবেত অন্যান্য দর্শনার্থীদের জন্য, শুধু উপর থেকে দু’চারটা ছবি তুলে সূর্যাস্ত দখে মুগ্ধ হয়ে বিদায় হবে। পরক্ষণেই মনে হলো, আসলে এই খেদ আমার অর্থহীন। কারণ এখানে আসা প্রায় প্রত্যেকেই সৌখিন প্রজাতীর পর্যটক। আমাদের মত স্বল্প অর্থের অভিযাত্রী অথচ সঠিক প্রস্তুতি নিয়ে কেউ আসে না। খাদের এই অংশ থেকে উপরে আরোহণের পর আরও একাধিক প্রাচীর ধরে পরিভ্রমণের এক পর্যায়ে সূর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে এলো। তাই তো এই প্রাচীরটা ধরে ঐ দূরে উঁচু জায়গাটায় যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারলাম না। কারণ অন্ধকার নেমে এলে ফিরে আসা সত্যিই কষ্ট হবে। শেষে সারাটা রাত আবার এই গিরি প্রান্তরে কাটিয়ে দিতে না হয়!  



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়