ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

গুহা ছেড়ে গরম পানির ঝরনায়

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৮ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গুহা ছেড়ে গরম পানির ঝরনায়

(ভিয়েতনামের পথে : ২৪তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান :
 গুহা ভ্রমণ শেষ হতে হতে বেলা গড়িয়ে দুপুরের কাছাকাছি। আবারও গাড়ি ছেড়ে দিল। প্যাকেজে দুপুরের খাবার এবং ফলাহার অন্তর্ভূক্ত। তাই আজ আমাদের ব্যাগ খাবার শূন্য। এখানে আসার পর থেকে দৈনিক যে পরিমাণ পরিশ্রম হয়েছে, সে তুলনায় আজ অনেক আরামে আছি। কিন্তু বুঝতে পারলাম না এত তাড়াতাড়ি ক্ষুধা পেয়েছে কেন? খাবার কখন দেবে তার তো কিছুই জানি না। পথে কোন কিছু পেলে কিনে নেব কি না তা নিয়ে দুজনের মাঝে ভাবনাচিন্তা চলছে। কিছুদূর পথ অতিক্রম করার পর গাড়ি থামল রাস্তার পাশের এক উঠানে।

হঠাৎ এক গাড়ির অনুপ্রবেশে মুহূর্তেই পাখিরা আরামের বিচরণ ছেড়ে পালালো। এখানেই রেস্টুরেন্ট। সকলের উদ্দেশ্যে বলা হলো, ভেতরে গিয়ে বসতে। কিন্তু কোন বেলার খাবার খেতে বসতে বলা হলো তা কারও কাছেই পরিষ্কার নয়। একে একে সকলেই এক টেবিলে বসলাম। পুরো টেবিলে এক ধরণের নীরবতা, কেউ কাউকে চেনে না। কোনো কথাবার্তা নেই। দুই দুইটা জায়গা ঘুরে দেখা শেষ। অথচ, পরস্পরের মাঝে আলাপ পারিচয়টা পর্যন্ত হয়নি। আমি তো ভেবেছিলাম আমরা গাড়িতে আলাদা বসলেও তারা চারজন এক জায়গায়, সুতরাং আলাপ পরিচয়ের মতো প্রাথমিক বিষয়টা ইতিমধ্যেই সম্পন্ন। কিন্তু না, লক্ষ করি খাবার টেবিল ঘিরে ছয়জন মানুষ কিন্তু কেউ কারও সাথে কথা বলা দূরে থাক পরস্পরের দিকে স্বাভাবিকভাবে তাকাতেও পারছে না। ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করার পর যারপর নেই অস্বস্তিকর ঠেকল। টেবিলে পাশাপাশি আমরা দুজন আর আমার ঠিক বাম পাশে সুদূর ব্রাজিল থেকে আগত এক তরুণী। টেবিলে অপর পাশে তিনজনের একজন অস্ট্রেলিয়ান তরুণী এবং বাকি দুজন ইসরাঈল থেকে উড়ে আসা পিতা-পুত্র।

পরিবেশিত হলো টুকরো করে কাটা আনারস এবং তরমুজ। নিজেদের মধ্যে সংক্ষিপ্ত চোখাচোখি হচ্ছে কিন্তু কেউ শুরু করছে না। এমনটা তো মেনে নেয়া যায় না! পৃথিবী দেখতে বেরিয়ে এমন পরিবেশ কি কারও কাম্য হতে পারে? টেবিলে এইমাত্র প্রাণের সঞ্চার ঘটানো কর্তব্য হয়ে দেখা দিল। বাঁশের সরু কাঠির খোঁচায় তরমুজ টুকরো তুলে নিতে নিতেই কথা শুরু পাশের তরুণীর সাথে। তারপর একে একে অন্যদের সাথে। টেবিলের উপর দিয়ে এবার যেন হাওয়া বইতে শুরু করল। এতক্ষণ এই হাওয়া টেবিলটাকে ঘিরে এক অস্বস্তির বলয় তৈরি করে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সব কিছু ভেঙে হাওয়ার পাখা গজাল সাথে আমাদের কথারও। স্বাভাবিকতা ফিরে এলো সকলের চেহারায়।
 


কথায় কাথায় পরিবেশিত সমস্ত ফল শেষ। সকলের চেহারায় এক গভীর প্রতীক্ষা এবং প্রশ্ন- ফল কি আবারও দেয়া হবে? ভেবেছিলাম ফলাহারে স্থানীয় আরও কিছু পদ থাকবে। প্যাজের ফলমূলের কথা সেভাবেই উল্লেখ ছিল। কিছুক্ষণ পর বোঝা গেল পুনর্বার ফল পরিবেশনের সম্ভাবনা নেই। যাহোক, আপাতত এতেই খুশি। একটু পরেই শুরু হলো দুপুরের খাবার পরিবেশনের আয়োজন, যা ঠিক এখনই প্রত্যাশিত ছিল না। ফলাহার আর দুপুরের খাবার; এই অন্তর্বর্তী সময়ে জানা হলো একেকজনের ভ্রমণ পরিকল্পনার কথা। আরও জানা হলো ব্যক্তিগত বিষয়ের প্রাথমিক কিছু বিষয়। পাশের পর্যটককে অনেকটাই  প্রাণবন্ত মনে হলো। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন এবং ইংরেজি ভাষার উপর উচ্চতর পড়াশোনারত। তিনি ব্রাজিলের নাগরিক। সুতরাং, কথায় কথায় যে প্রসঙ্গটি সর্বপ্রথম চলে আসার কথা তা হলো- ফুটবল। তার নিশ্চয়ই জানার কথা নয় যে, বাংলাদেশে তার দেশের ফুটবল দলের কি পরিমাণ সমর্থক আছে। বিশ্বকাপ ফুটবল বলতে বাংলাদেশের ভক্ত অনুরাগীরা প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। তার এক ভাগ যে ব্রাজিলের পক্ষে সে খবরও তার অজানা। শুধু কি তাই? অতি উৎসাহী সমর্থকরা যে, তার দেশের বৃহৎ আকারের একেকটি পতাকা উড়িয়ে প্রিয় দলের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে, এই বিশেষ খবরটিও নিশ্চই তার জানা নেই? বিস্তারিত জানার পর খুশি হলো সে। তবে চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হলো না তিনি এই বাড়াবাড়িকে সমর্থন করলেন। ইসরাইলি পিতা-পুত্র তুলনামূলক কম মিশুক প্রকৃতির। রক্ষণশীল বলা চলে। ছেলেটার মুখ থেকে দু’একটা কথা যা-ও বেরোলো তা যেন জোর চালিয়ে বের করে আনা। সর্বশেষ সদস্য সম্বন্ধে বলার একটি বাক্যও খুঁজে পাচ্ছি না। তবে ক্যাঙ্গারু বিষয়ক গুনে গুনে তিন কি চারটি কথার অধিক আর কিছু কি হয়েছে? তা মনে পড়ছে না। তিনি প্রকৃতপক্ষেই স্বল্পবাক, অল্প কথার মানুষ তবে অহংকারের লেশ মাত্রটি নেই। নির্লিপ্ত স্বভাব আর দীর্ঘ শরীরের ভারে সোজা হয়ে যেন দাঁড়াতেও পারছে না। এ বয়সেই শরীর ন্যুয়ে পড়ার উপক্রম।

এখানকার প্রায় সকল প্যাকেজ টুরের শেষ গন্তব্য হয়ে থাকে পাই গিরিখাত। সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করার মধ্য দিয়ে ভ্রমণের ইতি টানা হয়। আমাদের দলের ক্ষেত্রেও ঠিক একই জিনিস ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের তাতে কোনো আগ্রহ নেই। যেহেতু জায়গাটা আমাদের দেখা এবং তা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। তার চেয়ে বরং আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে চাইনিজ বসতি। এটা আবার প্যাকেজের মধ্যে নেই। চাইনিজ বসতি দেখতে পারলে পাই ঘুরে দেখার ব্যাপারে আমাদের আর কোনো আক্ষেপ থাকবে না। বিস্তারিত শোনার পর গাড়ির চালক বললো, গিরিখাত যাওয়ার পথে চাইনিজ বসতির পাশ দিয়ে যেতে হবে। চাইলে আমাদের কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে যাবে। তবে তা অবশ্যই পরবর্তী গন্তব্য হট স্প্রিং বা উষ্ণ পানির প্রস্রবণ হয়ে মোরা পাং ঝরনা দেখার পর। চীন দেশে যাওয়ার সুযোগ এখনও হয়ে ওঠেনি। এখানকার বসতিতে যেতে পারলে তাদের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির কিছুটা স্বাদ পাওয়া যেত! দিনগুলো ফুরে আসার সাথে সাথে মনের মধ্যে আক্ষেপ জমা হচ্ছিল, নিশ্চিতভাবেই চাইনিজ বসতি দেখার সুযোগ পাচ্ছি না।
 


এমন পরিস্থিতিতে গাড়ি চালকের এরূপ অশ্বাস আমাদেরকে অনেক আশাবাদী করে তুললো। গুহা ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা জীবনে অর্জিত বহু অভিজ্ঞতার মাঝে অন্যতম একটি, যার উদ্দেশ্যে আজ আমাদের এমন প্রক্রীয়ায় বের হওয়া। মজার ব্যাপার হলো এক সফলতার পর পরই আমরা এখন অন্য আর এক অভিজ্ঞতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে। এবং তা একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে। গাড়ি ছুটছে উষ্ণ পানির প্রস্রবণ অভিমুখে। ভ্রমণ আরও বেশি আনন্দময় হয়ে উঠল কিন্তু কোন কিছুই আর ভালো লাগছে না। মনের সমস্ত মনোযোগ গিয়ে পরে আছে অচেনা অদেখা চাইনিজ বসতিতে। ঘন অরণ্য ঘেরা পথের শেষে গিয়ে নামিয়ে দেয়া হলো উষ্ণ পানির প্রস্র্রবনের নিকটে। ঝুরি নাম বৃক্ষের নিচে এক জলাশয়। উজানের অন্ধকার জঙ্গল থেকে ধীর গতির পানির ধারা এসে জমা হয়েছে। লতাপাতার রং সবুজ হয়ে যাওয়া গরম পানিতে শরীর ডুবিয়ে বসে আছে পর্যটকের দল। জায়গায় জায়গায় পানি থেকে বাষ্পের ধোঁয়া উঠে আসছে। এমন সময সামনে দিয়ে থপথপ করে হেঁটে গেল প্রায় পোনে দুইশ কেজি দেহের বিকিনি পরা এক রমণী। জলাশয়ের পক্ষে এমন একটি দেহের ভার সহ্য করা দুস্কর হতে পারে। অন্যান্যদের তাকিয়ে থাকা দেখে মনে হচ্ছে,  প্রত্যেকের দুশ্চিন্তার কারণ স্বয়ং ওই রমণীটি- পানিতে নামার সাথে সাথে পাড় উপচে নির্ঘাৎ অর্ধেক পানি বেরিয়ে যাবে।
 


প্রশান্তির গরম স্নান শেষে কেউবা উঠে পড়ছে। এখানে গোসল করা আমাদের পরিকল্পনার বাইরে। অতএব, খানিকক্ষণ বসে আশপাশটা দেখে নেয়া যায়। দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে পারিপার্শ্বিকতা কেমন যেন অস্বস্তিকর হয়ে উঠল- সম্মুখে এত মানুষ গোসলরত অথচ, আমরা কিনা বসে আছি! বিষয়টাকে শোভন মনে হলো না। যদিও অনেকেই তার সঙ্গী-সাথীকে পানিতে নামিয়ে দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অথবা ছবি তুলছে। বেরিয়ে এসে দোকানের বেঞ্চে বসে থাকলাম। অপেক্ষা করছি কথন আমার ভ্রমণ সঙ্গীদের উষ্ণ স্নান শেষ হয়! কিছুক্ষণের মধ্যে এখানে বসে থাকাটাও বিরক্তিকর হয়ে উঠল। পেরিয়ে গেল আরও কিছু সময়। ভাবলাম একবার ভেতরে গিয়ে সহযাত্রীদের খোঁজখবর নিয়ে আসি- সাবান, শ্যাম্পু কিছু যদি লাগে। তার আগেই ভেজা শরীরেই রমণীদ্বয় গাড়িতে এসে বসে পড়লেন। এখন প্রতীক্ষা পিতাপুত্রের। কয়েক মিনিটের মধ্যে তারা যেমন ঢুকেছিলেন তেমনই বেরিয়ে এলেন। কেবল পিতার হাঁটু পর্যন্ত ভেজা। বোধহয় পাড়ে বসে ঠ্যাং দুটো গরম পানিতে চুবিয়ে রেখেছিলেন। অথচ, আনন্দের মাত্রা দেখে মনে হচ্ছে একশ মাইল সাঁতার কেটে এলেন। এতক্ষণ তো তার শুধু পা জোড়াই দেখছিলাম। পা থেকে দৃষ্টি যখন ক্রমেই মাথায় পৌঁছল তখন আবার সংশয়ে পরে গেলাম। পুত্রের মাথার চুল দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় সে পানিতে নামেনি কিন্তু পিতার মাথা কেশশূন্য, একটা চকচকে বস্তু! অতএব, পিতা শরীরের কোন পর্যন্ত পানিতে চুবিয়েছেন তা নিশ্চিত করে বলতে নতুন করে নিরিক্ষণের দরকার আছে। (চলবে)

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়