ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

গ্যাং কালচার: সমাজ কোথায় যাচ্ছে

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১০, ১৩ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গ্যাং কালচার: সমাজ কোথায় যাচ্ছে

মাছুম বিল্লাহ: পাড়ায়-মহল্লায় শুরু হয়েছে গ্যাং কালচার। ভয়াবহ এদের দৌরাত্ম্য। প্রায়ই এদের অপকর্মের খবর পত্রিকার পাতায় পড়তে হয়। এদের নেতৃত্বের শিকল বেশ বড়। পাড়ায় পড়ায় এখন বড় ভাই, তাদের ওপর আছেন আরেক বড় ভাই, তার উপর আরেকজন। যত উপরে ওঠা যাবে তার ক্ষমতা তত বাড়বে। আবার সব বড় ভাইয়েরাই রাজনৈতিক আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে থাকে। থাকে অইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় যাতে তাদের দিকে কেউ চোখ তুলতে না পারে, উচ্চস্বরে কথা বলতে না পারে। তারা ক্ষমতা, টাকার জন্য যখন যাকে প্রয়োজন হুমকি দিবে, আঘাত করবে, গুম করবে এবং মেরে ফেলবে। কেউ যাতে বাধা দিতে না পারে তাই রাজনৈতিক আশ্রয় ও প্রশ্রয় এদের ভীষণ দরকার। সেই ছায়া তারা পায়ও। এ কি কালচার আমরা সমাজে লালন করছি? কিসের জন্য? কার জন্য? নিশ্চয়ই ক্ষমতার বলয়ে থাকার জন্য, নিজের প্রভার বিস্তার করার জন্য, টিকে থাকার জন্য কিন্তু এই পাওয়ার, এই প্রভাব কত দিনের? এদের প্রশ্রয় দিয়ে সমাজকে যে একেবারে বাস অযোগ্য করে ফেলছি, পচিয়ে ফেলছি, ভবিষ্যত বংশধরদের বিপদে ফেলছি- সেদিকে কি সমাজপতিরা খেয়াল করেছেন?

সমাজের শান্তি বিনষ্টকারী এই গ্যাংস্টাররা অলি-গলিতে ঘুরে বেড়াবে আর তাদের সহায়তা করবে রাজনৈতিক ক্ষমতাধর কতিপয় গোষ্ঠী- কেন? জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লালন করা হয় যাতে সমাজে এ ধরনের কাজ  কেউ না করতে পারে। সমাজের মানুষ নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিও মানুষ যে অনেক সময় আস্থা রাখতে পারে না; তাহলে সেই মানুষগুলো কোথায় যাবে? তারপরও আমরা আশা করি, অনেক সৎ কর্মকর্তা ও সদস্য এই বাহিনীতে আছেন যারা সমাজের এই পচন দেখতে পান, তারা যথাসাধ্য হয়তো ব্যবস্থা নেন। কিন্তু তারপরও গ্যাংস্টারদের দৌরাত্ম্য কমছে না। ফলে জনমনে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে- কী হচ্ছে এসব? এভাবেই কি চলতেই থাকবে?

দেশজুড়ে নগরকেন্দ্রিক গ্যাং কালচার ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। মাদক নেশায় জড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিং, মাদক ব্যবসা,  নিজেদের আভ্যন্তরীণ বা অন্য গ্যাংয়ের সঙ্গে তুচ্ছ বিরোধকে কেন্দ্র করে খুন এখন নিত্যদিনের ঘটনা। আরো ভয়ঙ্কর তথ্য হলো এসবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে স্কুলের শিক্ষার্থীরা।  উদ্বেগের বিষয় হলো- মাদকের টাকা জোগাড়ে ছোটখাট অপরাধে জড়ানো উঠতি বয়সি ছেলেরা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর অপরাধী, এলাকার ত্রাস। এর পেছনের অন্যতম কারণ রাজনৈতিক ‘বড় ভাইদের প্রশ্রয়’। এক সময় এই কালচার ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় শহরকেন্দ্রিক থাকলেও বর্তমানে তা ছড়িয়ে পড়েছে ছিমছাম, নীরব জেলা-উপজেলা শহরগুলোতেও। কুমিল্লার মতো শান্তশিষ্ট শহরে এ ধরনের গ্যাং আছে অন্তত বিশটি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঈগল স্টার গ্যাংয়ের সদস্য নাকি ছাড়িয়েছে হাজার- পত্রিকার পাতাতেই পড়েছি।

২০১৮ সালের ১১ জুলাই প্রেম-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে ধর্মসাগরপাড়ের নগর উদ্যানে ছুরি দিয়ে খুন করা হয় কুমিল্লা অজিত গুহ মহাবিদ্যালয়ের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শিহাবউদ্দিনকে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সবাই কিশোর। তারা কোনো না কোনো গ্যাংয়ের সদস্য। এরা নিজেদের ‘গ্যাং’ বলেই ভাবতে চায়। এসব গ্রুপের সদস্যরা জড়িয়ে পড়ছে ছিনাতইসহ নানা অপরাধে, মাদকের ব্যবসায় ও নেশায়। নগরীতে নানা নামে এরা বেপরোয়া। ঈগল, ব্ল্যাক ড্রাগন, ডি-ডি-ডব্লিউ, নাইট ডেভিলস, বিডি সিজেএম-২, কেডি, ব্যাক রেঞ্জারস, ব্লাক সেডো, কেএনএক্সটি, আরজিএস, এলআরএন, সিএমইচ, ডিস্কো বয়েজ, বসসহ বিশটিরও অধিক গ্যাং রয়েছে এ নগরীতে। এসব গ্রুপের সদস্যরা তুচ্ছ ঘটনায় বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। আর এতেই ঘটছে একের পর এক প্রাণহানীর মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা। এরা বয়সে সবাই কিশোর-তরুণ। একই স্কুলে লেখাপড়া, একই পাড়া-মহল্লায় বসবাস। কার চেয়ে কে বেশি শক্তিশালী বা প্রভাবশালী তা প্রমাণ করতে মুহূর্তেই জড়িয়ে পড়ে বিরোধে। আর প্রতিযোগিতা চলে সদস্য বাড়ানোর। নগরীর মোগলটুলি এলাকায় ঈগল গ্যাং সদস্য দুইশরও অধিক। উগ্র প্রকৃতির এদের আচরণ। হাইস্কুল ও জিলা স্কুলের অষ্টম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাই এর বেশি সদস্য। নগরীতে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা কিশোর গ্যাং ঈগল বাহিনীর হাতে প্রাণ গেছে মডার্ণ স্কুল থেকে এ বছরই এসএসসি পাস করা আহমাইন আদিলের। গত ১ মে রাতে নগরীর মোগলটুলি এলাকায় মোটরসাইকেলে ধক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে ওই গ্যাংয়ের সদস্যদের ছুরিকাঘাত ও দায়ের কোপে খুন হয় সে। এ ঘটনার ২২ দিন আগে শবেবরাতের রাতে মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে নগরীর ঠাকুরপাড় এলাকায় স্কুলের সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জেরে ছুরিকাঘাতে খুন হয় একই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির মুমতাহিন হাসান মিরন।

পিতামাতার দায়িত্ব এখানে বিশাল। পরিবার সমাজের একটি অংশ, একটি ইউনিট। সমাজ যখন কলুষিত হয় তখন পরিবার ভূমিকা পালন করলেও তার প্রভাব খুব একটা পড়ে না। ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ এখানে আর একটি বড় বিষয়।

বরিশালে রয়েছে ‘আব্বা গ্রুপ’। তাদের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত বরিশালবাসী। তারা এক কলেজের অধ্যক্ষকে কুপিয়ে জখম করেছে, অধ্যক্ষকে পাঠানো হয়েছে হাসপাতালে। কাগজের পাতায় এতটুকুই। তারপরের যে করুণ ও বিষাদময় ইতিহাস তার খবর কেউ রাখে না, রাখার সময়ও নেই, প্রয়োজনও নেই। তারপর ঘটে আরেক ঘটনা। চাপা পড়ে যায় পূর্ববর্তী ঘটনা। সিলেটেই নাকি অন্তত অর্ধশত গ্যাং গড়ে উঠেছে। এরা নগরী ও নগরীর বাইরে নির্দিষ্ট এলাকায় সক্রিয়। এদের মধ্যে যারা ‘বড় ভাইদের’ আনুকুল্য পাচ্ছে তারাই হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর। বিভাগীয়, জেলা এমনকি উপজেলা শহরেও নাকি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গ্রুপ। অদ্ভুত এসব গ্রুপের নাম। বছর দুয়েক আগে ঢাকার উত্তরায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে সমবয়সী এক কিশোর নিহত হওয়ার মধ্যে দিয়ে আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং কালচার ও তাদের এলাকাকেন্দ্রিক আধিপত্য বিস্তার এবং অপরাধ সংঘটনের বিষয়টি।  বিভিন্ন পত্রিকায় তখন উত্তরা ও মোহাম্মদপুরসহ এলাকাকেন্দ্রিক গ্যাং বিষয়ে অনেক রিপোর্ট হয়। বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের পর বর্তমানে দেশজুড়ে গ্যাং কালচার ইস্যুতেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে মিডিয়াগুলোতে। কিন্তু ভয়ানক এ সংস্কৃতি প্রতিরোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। বিষয়টি অনেক সময় রাজনৈতিক।  রাজনৈতিক নেতাদের তো আর আমাদের কিছু বলার নেই। তারা তাদের সুবিধার জন্য, পার্টির সুবিধার জন্য যা ইচ্ছে করবেন- সেখানে আমরা অসহায়। সুতরাং এখন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। রাষ্ট্র এটিকে ধামাচাপা দিলে গোটা সমাজ অন্ধকারে ডুবে যাবে।

লেখক: শিক্ষা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়