ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে ড্রামে বন্দি ছিলাম’

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৮, ১২ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে ড্রামে বন্দি ছিলাম’

প্রতীকী ছবি

জুনাইদ আল হাবিব : ‘বৃহস্পতিবার দিনভর বৃষ্টি ছিল। রাত একটার দিকে তুফান শুরু হয়। আচমকা দেখি মাথার ওপর পানি উঠে গেছে। আমার বোন দুইটা মারা গেছে সেই ঘূর্ণিঝড়ে। রাত তিনটার দিকে তারা স্রোতের তোড়ে ভেসে যায়। গাছপালার কারণে ঝাঁপ দিয়ে তাদের উদ্ধার করতে পারিনি। সাফিয়ার লাশ খুঁজে পেয়েছি চার দিন পর। রাবিয়াকে এখনো পাইনি। সাফিয়ার বয়স তখন ১২ বছর ছিল। আর রাবিয়ার বয়স ৭ বছর হবে। আমরা ঘরের চালে ছিলাম। প্রবল ঢেউয়ে তারা ভেসে গেছে। টঙের ঘরে মা-বাবাসহ আমরা ভাই ৩ জন ছিলাম।’

কথাগুলো বলছিলেন উপকূলীয় মেঘনা তীরবর্তী জনপদ লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চর কালকিনি ইউনিয়ন মতিরহাটের বাসিন্দা আমির হোসেন। বয়স তার ৬০ গড়িয়েছে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘ভোলা সাইক্লোন’র কথা আজও ভোলেননি উপকূলের মানুষ। সেদিনের স্মৃতির দিকে চোখ ফেরালে আজও আমির হোসেনদের চোখ থেকে পানি ঝরে। এ এক হৃদয়বিদারক গল্প। অকালে স্বজন হারানোর গল্প।

‘৭০-এর এ ঘূর্ণিঝড়কে ২০১৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের আবহাওয়া সংস্থা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় বলে ঘোষণা করেছে। সরকারি হিসেবে ওই দিনে প্রাণ হারিয়েছেন ৫ লাখের বেশি মানুষ। আর বেসরকারি তথ্যমতে এ সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। উইকিপিডিয়ায় রেকর্ডকৃত এ যাবত ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটিকে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বলা হচ্ছে। ওই দিনে নিহত মানুষদের স্মরণ, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাণঘাতী দুর্যোগে সচেতনতা, উপকূলের সমস্যা, সম্ভাবনার কথা তুলতে ধরতে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে উপকূল সুরক্ষার জন্য দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছে। ‘উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটি’র উদ্যোগে গত বছর উপকূলের ৩৪ স্থানে একযোগে দিবসটি পালন করা হয়েছে। এবার তা পালন করা হচ্ছে উপকূলের ৫০ স্থানে।

 



দিনটি সম্পর্কে কথা হয় ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধা ফাতেমা বেগমের সঙ্গে। এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের কতা হুনি আঁর আঁঙ্গো ৬-৭ জনকে ড্রামের ভেতর ভর্তি করে রেখে দিয়েছে। যার কারণে আঁঙ্গো কোনো সমস্যা হয় নাই। কিন্তু এক্কারে আঁতঙ্কে আছিলাম। কী থেকে যেন কী হয়? চাইরপাশে অনেক মানুষের লাশ ভাইসতে ভাইসতে গেছে। মানুষের গরু গেছে, ছাগল গেছে, জাগা গেছে, জমি গেছে। ধান-চাল, খড়-কুটা সব গাঁঙ্গের হোতে নিয়া গেছে। রাস্তা-ঘাট বলতে কিচ্ছু আছিলো না।’

লক্ষ্মীপুর জেলা জর্জকোটের আইনজীবী সহকারী মো. শামছুদ্দিন রতন। বয়স ৬৫ ছুঁয়েছে। ভয়াল এ ঘূর্ণিঝড়ের গল্প জানতে চাইলে তিনি আঁতকে ওঠেন। আফসোস করে ওই দিন নিহতদের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘ওই দিন এই নোয়াখালী অঞ্চলে ১ লাখ লোক মারা গেছে। সব ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার ধারণা যেভাবে মানুষ মারা গেছে, ১১ লাখের মানুষের কম হবে না। মৃত্যুর এ ঘটনাকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ধামাচাপা দিয়েছে। তখন জোরালো ভূমিকা রাখলে এতলোক মারা যেত না। ত্রাণ আসছে কিছু, তা আবার কিছু লোকের পেট ভরেছে।’

‘উপকূল দিবস’ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দিবসটা খুব দরকার। কারণ বর্তমান প্রজন্মকে ৭০-এর ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে জানানো দরকার। অতীতের এ ধরনের ইতিহাস তুলে ধরা আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন। অবশ্যই সরকারের কাছে দিবসটির যৌক্তিকতা দাবি করে এর রাষ্ট্রীয় স্বাকৃতি দাবি করছি।’

 



‘উপকূল দিবস’ এর প্রবর্তক ও বাংলাদেশে উপকূল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ রফিকুল ইসলাম মন্টু এ সম্পর্কে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় এলেই কেবল গণমাধ্যমের চোখটা উপকূলে ফেরে। সরকারের দৃষ্টিতে কিছু উপকূল থাকে। কিন্তু উপকূলের সুরক্ষার জন্য, উপকূলে নিরাপদ আবাস স্থল গড়ে তোলার জন্য কোনো দিবস নেই। কত অপ্রয়োজনীয় দিবস আমরা পালন করি। উপকূলের মানুষের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে উপকূল দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রয়োজন। যে দিন একযোগে সবাই উপকূলের কথা বলবে।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ নভেম্বর ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়