ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চমক জাগা‌নিয়া প‌রিবর্তন আসছে আওয়ামী লীগে

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৩, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চমক জাগা‌নিয়া প‌রিবর্তন আসছে আওয়ামী লীগে

দেশের উন্নয়নে আওয়ামী লীগের ঘোষিত ভিশনগুলো বাস্তবায়নে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ২১তম জাতীয় সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে চমক জাগানিয়া বেশকিছু পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে দলটি। এ প্রক্রিয়ায় আগামী প্রজন্মের কাছে আওয়ামী লীগকে আরো জনপ্রিয় সংগঠন হিসেবে উপস্থাপন করতে চায় দলটির হাইকমান্ড।

নেতৃত্ব বাছাইয়ের এই ঘূর্ণিতে বর্তমান কমিটিতে আছেন এমন অনেক নেতা পদ হারাবেন। আবার প্রথমবারের মতো নতুন করে কমিটিতে জায়গা পাচ্ছেন কেউ কেউ। দলের শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্বশীল পদগুলোতেও দায়িত্বের পদবণ্টন হবে। এতে গত তিন বছরে এসব নেতাদের খতিয়ানের হিসাব-নিকাশের মূল্যায়নে ঘটবে উত্থান-পতন। আর এই পুরো প্রক্রিয়া নজরদারি করবেন একজন, তিনি নেতা-কর্মীদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল এবং দলের একমাত্র অপরিহার্য নেতা শেখ হাসিনা।

আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই সম্মেলনের পুরো প্রক্রিয়া এখন পুরোদমে চলছে। ত্রিবার্ষিক এ সম্মেলনে কাউন্সিলর, ডেলিগেটসহ প্রায় ৪৫ হাজার নেতা-কর্মীকে একটি করে খাবারের ব্যাগ ও ২৫ হাজার জনকে পাটের ব্যাগ উপহার দেবে আওয়ামী লীগ।

‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে গড়তে সোনার দেশ, এগিয়ে চলেছি দুর্বার, আমরাই তো বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন স্থানে পোস্টার টাঙানো হয়েছে। প্রস্তুতি নিতে নিয়মিত কাজ করছে ১১টি উপ-কমিটি।

দলীয় সূত্র বলছে, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারের সম্মেলনের আবহ অন্যরকম। দলের মধ্যে ‘অপরাধের’ বিরুদ্ধে চলমান শুদ্ধি অভিযানের ঢেউ লাগবে এই সম্মেলনেও। বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এমন নেতা কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ছিটকে পরবেন। পদ হারাবেন সাংগঠনিকভাবে নিস্ক্রিয় এমন নেতাও। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সম্মেলনেই নেতা-কর্মীদের চমকে দেওয়ার মতো কিছু না কিছু ঘটে থাকে। এবারও আরো বড় চমক উপহার দেবেন দলের হাইকমান্ড।

নেতৃত্বের বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে জননেত্রী শেখ হাসিনা সব সময় দুরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এবারের কমিটিতেও সৎ, যোগ্য এবং পরীক্ষিতদেরই আনবেন তিনি।’

নতুন নেতৃত্ব বেছে নেয়ার এই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন হতে পারে সভাপতিমণ্ডলী, সম্পাদকমণ্ডলী ও কেন্দ্রীয় বেশকিছু সদস্য পদে। সংযোজন-বিয়োজনের এই প্রক্রিয়া বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ নেতা বাদ পড়তে পারেন। বিভিন্ন জেলার ক‌্যারিশমেটিক অনেক নেতা ঠাঁই পাবেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে। হঠাৎ করে দলের দায়িত্বশীল পদে কমিটি বাইরে থেকে এসে পদ পেতে পারেন। সেটি হলে তা নেতা-কর্মীদের জন্য বড় চমক হয়ে দেখা দেবে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দলের জন্য একমাত্র অপরিহার্য হচ্ছে শেখ হাসিনা। আজকে দলকে আরো শক্তিশালী করতে হলে তার নেতৃত্বের বিকল্প নেই।’

সম্মেলন নিয়ে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা গুণগত একট পরিবর্তন আনা। আদর্শ থাকতে হবে। আদর্শ না থাকলে তা হবে বেলুনের মতো, অর্থাৎ ফু দিয়ে অনেক বড় করা যাবে কিন্তু তা ফানুস বেলুন হবে। কিন্তু যথাযথ অর্থে যদি দল সাজাতে হয় তাহলে ছেকে যাচাই-বাছাই করে তৃণমূলের শেকড়ে যাদের ভালো অবস্থান রয়েছে তাদের দায়িত্বে আনতে হবে। তাহলে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক সংকটই আসুক না কেন মোকাবিলা করতে পারবে দল। শুধু কমিটিতে নাম লেখানো যদি রাজনীতি হয় সেই রাজনীতি দল ও দেশের জন্য ক্ষতিকর।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সম্মেলনে নেতৃত্বের যে পরিবর্তন হয়েছে সেই ধারাবাহিকতা থাকবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলেও। যারা সাংগঠনিক কাজে ব্যর্থ হয়েছেন, দলীয় পদকে ব্যবহার করে নানা ধরনের সুবিধা নিয়ে নিজের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছেন, সেসব রিপোর্ট এখন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার কাছে। নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে কমিটি হওয়ার বেশ জোড়ার আলোচনা রয়েছে দলের মধ্যে। বর্তমান কমিটির নেতাদের এবং সম্ভাব্য কারা আসছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এর একটি তালিকা এখন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে।

এদিকে দলটির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার মোটা দাগে গঠনতন্ত্র সংশোধনের তেমন কোনো প্রস্তাব থাকছে না। তবে ছোট-খাটো কিছু বিষয় থাকতে পারে। আর কেন্দ্রীয় কমিটির আকার ৮১ সদস্য বিশিষ্টই থাকছে।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, যেসব সি‌টি করপোরেশন হয়েছে সেগুলো মহানগর হবে। আমাদের ইতিমধ্যে একটা সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে যে, বিভাগীয় শহরগু‌লোই মহানগর হবে। এটা চলমান একটা প্রক্রিয়া, সরকারের কাঠামো পরিবর্তনের সাথে সাথে সংগঠনেরও পরিবর্তন হবে।

 

আওয়ামী লীগের সম্মেলন উপলক্ষে প্রস্তুত হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

 

‘আমাদের যে খসড়া গঠনতন্ত্র করা হয়েছে, সেখানে পদ বাড়ার   প্রস্তাবনা দেয়া হয়নি। তবে প্রশিক্ষণ বিষয়ক একটি সম্পাদকের কথা বলা হয়েছে। এটা গতবারও দেয়া হয়েছে। তবে গ্রহণ করা হয়নি। এবার আবারও দেয়া হয়েছে।’

আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলটির বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনাই আবারো দায়িত্বে থাকছেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি দায়িত্ব থেকে অবসর চাইলেও নেতা-কর্মীদের অগাধ আস্থা আর ভালোবাসায় আপাতত সেই সুযোগ নেই তার। এ সম্পর্কে দলটির নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনার বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি এবং দলের তিনি একমাত্র অপরিহার্য।

এদিকে গত সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে এবং তার তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ও বোন শেখ রেহানা কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসতে পারেন বলে আলোচনা ছিল। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এবারও সেই আলোচনা আছে। এরই মধ্যে সজীব ওয়াজেদ জয়কে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রথম সদস‌্য করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সবচেয়ে বেশি আগ্রহদের পদ সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী সূত্র বলছে, সম্মেলনের আগে এ বিষয়ে ঘনিষ্ঠজনদের ধারণা দিয়ে থাকেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। তবে এবার এখনো এ ধরনের ইঙ্গিত বা ধারণা দেননি। এ পদের জন‌্য একাধিক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ পাঁচ-ছয়জনের নাম এখন পর্যন্ত আলোচনায় আছে। এই তালিকায় আছেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, কেন্দ্রীয় সদস্য আজমত উল্লাহ খান। তরুণদের মধ্যে আলোচনায় আছেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, বি এম মোজাম্মেল হক, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ।

সাধারণ সম্পাদক পদে কোনো পরিবর্তন না আসলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, দীপু মনিকে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করা হতে পারে। এক্ষেত্রে সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, বিএম মোজাম্মেল, খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কার হবে বলে আলোচনা রয়েছে। অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সী কয়েকজন নেতার সভাপতিমণ্ডলী থেকে ঠাঁই হবে উপদেষ্টা পরিষদে।

তরুণ নেতাদের মধ্যে উপরের দিকে উঠে আসতে পারেন বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, উপ-দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, কেন্দ্রীয় সদস্য থেকে এস এম কামাল হোসেন, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজীত রায় নন্দী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আব্দুস সবুর, ইকবাল হোসেন অপু, কেন্দ্রীয় সদস্য মারুফা আক্তার পপি।

কমিটিতে নতুন কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে আসতে পারেন বাগেরহাট-২ আসনের সাংসদ শেখ সারহান নাসের তন্ময়, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ও নড়াইল-২ আসনের সাংসদ মাশরাফি বিন মর্তুজা, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এপিএস সাইফুজ্জামান শিখর, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন, সাবেক সাংসদ ফজিলাতুন নেছা বাপ্পি, সাবেক সংরক্ষিত আসনের সাংসদ সানজিদা খানমকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে দেখা যেতে পারে। আসতে পারেন বিভিন্ন পেশায় আইকন হিসেকে নিজেকে মেলে ধরা কেউ কেউ।

এছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পদে থাকা নেতাদের পদের উন্নতি-অবনতি হবে। বর্তমানে মন্ত্রিসভায় রয়েছেন তাদের কেউ কেউ বাদ পড়তে পারেন কমিটি থেকে। আবার কাউকে কাউকে শুধু সদস্য করা হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দল ও সরকারকে আলাদা করার কথা বলে আসছেন। এবারের সম্মেলনে এই ট্রেন্ড চালু করা হবে কি না-তা দেখতে উন্মুখ হয়ে আছেন নেতা-কর্মীরা।

২১তম জাতীয় সম্মেলনের সার্বিক বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ রাইজিংবিডিকে বলেন, আওয়ামী লীগের এই সম্মেলন ঘিরে মানুষের আগ্রহ অনেক। বিশেষ করে আমরা যখন শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছি তখন মানুষ তাকিয়ে আছে আওয়ামী লীগে সৎ, যোগ্য ও শিক্ষিত নেতারা দায়িত্বে বেশি বেশি আসুক। আমরা জনগণের সেই চাওয়ার প্রতিদান দেবো। আগে থেকেই আমরা বিষয়টি সব সময় বিবেচনায় রেখেছি। এবার আরো সুক্ষ্মভাবে সেগুলো দেখা হবে।

‘তৃণমূলেও আমরা সৎ-শিক্ষিত নেতা করার এই বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়েছি। যারা দলেল কথা দেশের কথা চিন্তা না করে শুধু নিজের অর্থনেতিক পরিস্থিতি উন্নত করতে চায় তাদের আমরা চাই না। আমরা সেই নেতা চাই যারা তৃণমূলের নেতাকর্মী ও মানুষের সুখে-দুখে পাশে থাকবে’, বলেন আওয়ামী লীগের এই নেতা।

পড়ুন :


ঢাকা/পারভেজ/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়