ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চর থেকে চিরসবুজের ডাকে || ৪র্থ কিস্তি

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ১২ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চর থেকে চিরসবুজের ডাকে || ৪র্থ কিস্তি

ফেরদৌস জামান: দুপুরের খাবার প্রস্তুত- ভাতের সঙ্গে কাঁকড়া ভুনা। আগের রাতে ঘুরতে ঘুরতে মিলে যায় বাজারের একমাত্র কাঁকড়ার আড়ৎ। কীভাবে কাঁকড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বাজারজাত করা হয়, কিনছেই বা কারা- এমন সব প্রশ্নের উত্তর জানতে বেশ কৌতূহল নিয়ে আড়ৎ-এ প্রবেশ করি। অচেনা মানুষ দেখে দুই-তিনজন শ্রমিকসহ চেয়ারে বসা আড়ৎদার নড়েচড়ে উঠলেন। উপরের জিজ্ঞাসাগুলো থেকে এক-দুটি জানতে চাইতেই বসতে দিলেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা-ও চলে এলো। কথোপকথন এগিয়ে চললো আমাদের।

কথার মাঝে আড়ৎ-এর এক শ্রমিক বারবার ঢুকে পড়ে। আমাদের চেয়ে তার কৌতূহলই যেন বেশি। বাগেরহাটের মানুষ, সুন্দরবনের কাঁকড়া শিকার করেই বড় হয়েছে। সুতরাং তার কথা বলার আকুতি দেখে অনুমান করা যায় উক্ত বিষয়ে বিস্তর অভিজ্ঞ সে। কিন্তু কথার মাঝে অনুপ্রবেশ আড়ৎদারের পছন্দ নয়। তিনি নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখালেন কাঁকড়া কেনার পর বাছাই করে কীভাবে রাখা হয়েছে। প্রথমত আকার ভেদে একাধিক বাক্সে রাখা, দ্বিতীয়ত আহতগুলো আলাদা করে রাখা। এরইমধ্যে একজন বিক্রির জন্য হাতে করে একজোড়া কাঁকড়া নিয়ে উপস্থিত। শ্রমিকটি সুক্ষ্মভাবে পরখ করে দেখল অক্ষত আছে কি না। একেকটির ওজন আড়াইশ গ্রামের কাছাকাছি। কৌশলে জানতে পারলাম স্থানীয়দের নিকট থেকে যে দামে কেনা হয়, ঢাকায় তা চালান হয় দশ থেকে পনের গুন বেশি দামে। বাংলাদেশের কাঁকড়া রপ্তানী হয় প্রধানত চীনে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে হাত বদল হয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছে যায় কাঁকড়া। সেখান থেকে সরাসরি যত দ্রুত সম্ভব বিমানে তুলে দেওয়া হয়। কারণ জীবিত অবস্থায় সেগুলোর চালান নিশ্চিত করতে হবে। চীনে পৌঁছার পরও যদি বাক্স থেকে মৃত কাঁকড়া বের হয় তাহলে তা মূল্যহীন।

আগ্রহ দেখে আড়ৎদার জানতে চান আমরা কাঁকড়া খাই কি না? হ্যাঁ সূচক উত্তর পেয়ে বললেন, আগামীকাল অমুকের খাবার দোকানে পাঠিয়ে দেব। তার রান্নার হাত বেজায় ভালো। নারিকেল বাগান ঘুরে এসে খাবেন। পরদিন সময় মতো সেই দোকানে গিয়ে ডাক দিতেই একজন জানতে চাইলেন, আমরা ঢাকার মেহমান কি না? হ্যাঁ বলতেই ভেতরে নিয়ে বসালেন। তারপর আমাদের সামনে পরিবেশিত হলো কাঁকড়া। দেখেই বোঝা গেল যা শুনেছিলাম তা যথার্থ বটে- খোসা ভেঙ্গে এক টুকরো মুখে দিলে যে অনুভূতি হলো তা বর্ণনার অতীত! শুধু এতটুকু বলতে পারি, সামনে যা দিয়েছিল তার সমস্তটা শেষ করে তবেই থেমেছিলাম।



খাবার পর শরীরটা নিয়ে কোনমতে ঘরটায় গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে হলো। এরই মধ্যে খোঁজ পেয়েছি আরেক নতুন চরের। যার জন্য আরও একটি দিন থাকতে হচ্ছে। বেলা গড়িয়ে এখন বিকেল। বাজার জমে উঠেছে। মানুষের কোলাহল শোনা যাচ্ছে বিছানা থেকেই। শরিফ চাচার দোকান আমাদের ঠিকানায় পরিণত হয়ে গেল। তিনিই নতুন চরে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিলেন। বললেন, আশপাশটা ঘুরতে থাকেন, ফোন দিয়েছি মাঝি চলে আসবে। তখন পরিচয় করিয়ে দেব।

বাজারে রস থেকে চুবিয়ে তোলা জিলাপি দেখে গতকালই লোভ হয়েছিল, আজ আর না খেয়ে ছাড়ছি না। তাছাড়া দুপুরে যা খাওয়া হয়েছে; জিলাপির মতো মিষ্টান্ন একেবারে সোনায় সোহাগা! বাজারের মাছ পট্টি বিশেষ করে আড়ৎগুলিতে এক ধরণের চিংড়ি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। যেন তাওয়ায় আঁচ দিয়ে তোলা, খানিকটা লালচে। কৌতূহলের বসে জানতে চাইলে সবাই কেন জানি না আমাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে তারপর সরে যায়! বুঝতে পারলাম না তারা ভয় পাচ্ছে কী কারণে? কাঁকড়ার আড়ৎ-এ গিয়ে জানতে পারলাম আসল কথা। দুপুরে খাবার আয়োজনের জন্য এমনিতেই তাকে ধন্যবাদ দিতে যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে গেলে আড়ৎদার ভয়ানক তথ্য দিলেন। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, এই কাঁঠালী চিংড়ি শিকারের কারণে খাল-খাড়ির বিভিন্ন প্রজাতীর মাছ শুধু নয়, বরং জলজ সমস্ত প্রাণী বিনাশ হয়ে যাচ্ছে! এই চরসহ আশপাশের তিনটি চর মিলে দুই থেকে আড়াইশ খাল রয়েছে। খালগুলো কাঁঠালী চিংড়ির স্থানীয় উৎস। বাজারের দোকানগুলোতে অনায়াসে মেলে এক ধরনের বিষ। পানি মেশানো বিষ ছিটিয়ে দিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে খালের সেই নির্দিষ্ট অংশের চিংড়ি লাফিয়ে শুকনো ডাঙ্গায় এসে পরে। ওদিকে বিষের কারণে স্বাভাবিকভাবেই মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা যায়। অথচ দেখার কেউ নেই। সমাজের ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় এলাকার দরিদ্র জেলেরা সনাতন পদ্ধতি ত্যাগ করে বিষ প্রয়োগ করে কাঁঠালী চিংড়ি শিকার করছে। বিষাক্ত চিংড়ি দেদারছে চালান হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে।

ব্যক্তিগত ও সামাজিক কাজ কারবার নিয়ে খুব ব্যস্ত আমরা যেখানে উঠেছি সেই বাড়ির মালিক। রাতে  আমরা তার নিমন্ত্রিত অতিথি। মাছ, মুরগির মাংস সাথে চিংড়ির দুই পদ। একসাথে বসে খাবার পর বসলাম পাশের খোলা জায়গায়। সুজিতের ঠকাস ঠকাস টক টক চার মাত্রা কাহারবা তালে চলছে দু’একটি লোকগীতি। চারিদিকে শুনশান নীরবতা, সমস্ত চর ঘুমিয়ে পড়েছে, ডেকে যাচ্ছে ঝি ঝি পোকার দল। তিনি আর একলা ঘরে বন্ধ থাকতে পারলেন না। যুক্ত হলেন আমাদের সঙ্গীতের আসরে। পঞ্চাশোর্ধ কর্তা ভীষণ রাশভারি। যাহোক, এতক্ষণে তাকে দেখে বোঝা গেল আমাদের মতো অতিথি পেয়ে তিনি খুশি। এতটাই খুশি হলেন যে, গানের সাথে তাল ধরতে গিয়ে নড়বড়ে চেয়ার ভেঙ্গে মড়াৎ করে উল্টে পড়লেন। ধরাধরি করে অন্য চেয়ারে বসানো হলো। জানতে চাইলাম তাদের চরাঞ্চলের মানুষের প্রধান সমস্যা কী? অন্ধকারে তার মৃদু ফাঁক হয়ে যাওয়া মুখ, সাথে সাদা দাঁতপাটি দেখে অনুমান করা গেল তিনি হাসলেন। সে হাসি আনন্দ, বেদনা নাকি অভিশাপের তা ঠিক বোঝা গেল না। এক কথায় উত্তর- বাল্যবিবাহ। দারিদ্র্যজনিত নানান সমস্যার মধ্যে বাল্যবিবাহ পরবর্তী দাম্পত্য ঝগড়া অন্যতম। বোধহয় রাত বারোটা বেজে গেছে, সকাল সকাল নতুন চরের উদ্দেশ্যে রওনা করতে হবে। কিন্তু কর্তা তো ছাড়বার পাত্র নন!

ভোরে ঘুম ভাঙলেও প্রস্তুত হতে হতে ছয়টা বেজে গেল। শরিফ চাচার ঠিক করে দেয়া মাঝি বাবুল মিয়া এরই মধ্যে আমাদের দুই দুইবার ফোন দিয়েছে- আহেন বেলা তো উইট্টা গেল! ঘাটে আমাদের প্রতীক্ষায় বসে আছেন। আকাশের গতিবিধি সুবিধার নয়, দক্ষিণে হালকা মেঘের আনাগোনা! বাবুল মাঝি নৌকা ছেড়ে দিলেন। খাল ছেড়ে নৌকা প্রবেশ করল লকলকে সুবজ ঘাসে ঢাকা ফাঁকা প্রান্তরে। মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে সরু সরু খাল, সেটিই নৌকা চলার পথ। দূরে বনের পেছন থেকে মাথা উঁচিয়ে বেড়িয়ে পরল লাল সূর্য। বকপাখি নামল সবুজ ঘাসের প্রান্তরে। নৌকার সাড়া পেতেই গলা সোজা করে সতর্ক হলো প্রথমে তারপর ঝাঁক বেধে উড়াল দিল অন্যত্র। সুঠামদেহী মাঝি বাবুল চাচার বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে কিন্তু গঠন এখনও বেশ মজবুত। ঘুম থেকে ওঠার পর এরইমধ্যে কতগুলি পান খেয়েছেন কে জানে? কুচকানো ত্বক আর থুতনির নিচে এক গোছা দাড়ির মাঝে ঠোঁট দুটি টকটকে লাল হয়ে রয়েছে। জর্দার সুগন্ধ আশপাশ মাতিয়ে রেখেছে। খাল ছেড়ে নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে জলরাশির মাঝ দিয়ে। দুই দিকে কেওড়া গাছে ভরা দুটি চর। আকাশে মেঘ জমাট বাঁধছে, বাতাস বইছে সাথে ঢেউয়ের নড়াচড়াও বেড়ে যেতে লাগল। মেঘলা আকাশের নিচে চোখ যতদূর যায় সেখানে একটি দরজার মতো  দেখা গেল। দু’পাশ থেকে দুটি দ্বীপ কালো রেখার মতো এসে মিলিত হয়ে যেন জলরাশির মুখ বন্ধ করে দিতে চায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেই দরজা পেরিয়ে প্রবেশ করেছি সমুদ্রে। দূর থেকে দেখা মাত্র কয়েক ফুট প্রশস্ত দরজাটি এখন কয়েক মাইল চওড়া, এক সাথে একশ জাহাজ পেরিয়ে যেতে পারবে। অথচ, খানিক আগেই মনে হচ্ছিল আমাদের ছোট্ট নৌকাটিই বুঝি পার হবে না।



নৌকার মেশিনের শব্দে বাবুল চাচার কথা কানে আসছে না। ক্ষুধা লেগেছে, ভাতিজারা খাবার কিছু আনছেন নি? না আনলেও সমস্যা নাই, আহেন আমার লগে খাওন আছে, মিলেঝিলে খাই।

গলুইয়ের নিচ থেকে এক বোতল পানি বের করে এগিয়ে ধরে হাত ধুতে বললেন। আপনার চাচি ভাত চাইড্ডা ধইরাই দিছে। কইছে, ডাহাত্থন মেহমান আইছে এত্ত সহাল সহাল সুমুদ্দুরের মইদ্দে খাওন পাইব কই?

মোটা চালের ভাত সাথে বেগুন এবং শুঁটকি ভর্তা। এমন আতিথেয়তাও যে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল তা ভাবতেই পারিনি। খাওয়া শেষ করে দেখি নৌকা যেখানে ছিল সেখানে নেই, ঢেউয়ের তোড়ে পেছনের দিকে অনেকখানি চলে এসেছে। বাবুল চাচা এবার পলিথিন ব্যাগ থেকে প্রথমে একটি কৌটা বের করে কয়েক দানা সুপারি মুখে দিলেন তারপর পান পাতা। গল্প তখনও চলমান। পলিথিনটির বয়স বোধহয় বেশ কয়েক বছর হবে, চুন আর খয়েরের দাগ লেগে বিবর্ণ হয়ে গেছে। পান-সুপারি চাবানোর সাথে সাথে আঙ্গুলের ডগা থেকে জিহ্বায় সামান্য চুনের স্পর্শ দিচ্ছেন। এরই মধ্যে মুখ লাল। সবশেষে কালো কৌটা থেকে দুই আঙুলের চিমটি দিয়ে জর্দা তুলে মুখটা হা করে তার মধ্যে ছেড়ে দিলেন। কয়েকবার চাবানোর পর বঙ্গোপসাগরের বাতাস যেন জর্দার সুগন্ধে ভরে গেল। এমন শৈল্পীক আয়োজনে পান খাওয়া দেখে মনের মধ্যে লোভ পেয়ে বসল। সুজিত বলে, চাচা আমরাও পান খাব।

 

কি কয় ভাতিজারা?

জি চাচা আমরাও খাব। বলতেই নিজ হাতে পান খিলি বানিয়ে দিয়ে নৌকা চালু করে দিলেন। হাল ধরে বসলেন তিনি।

মেঘ কালো বর্ণ ধারণ করেছে। ঢেউ বড় হতে লাগল। ভয় হলো, অনেক পুরনো নৌকা। বললেন, দুই হাত দিয়া ভালা কইরা ধইরা বহেন, পিটানী হইব। ভালা কইরা বসার বিষয়টি বুঝলাম কিন্তু পিটানী কি তা তো বুঝলাম না! হেসে বললেন, পিটানী মানে ঢেউয়ের আঘাত। নৌকা উল্টে যাবে না তো? পেছনে ফেলে আসা সবুজ বৃক্ষের বন-জঙ্গল দিগন্তে মিশে একাকার হয়ে গেছে। ঢেউ এতটাই প্রবল হতে থাকল যে নৌকার এক মাথা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে যায় তো অন্য মাথা যেন পানির মধ্যে ঢুকে যাবে! তলানী পানিতে ঠাস ঠাস শব্দে আছড়ে পড়তে শুরু করল। দ্রুত তীরে ফিরছে একটি মাছ ধরার ট্রলার। চিৎকার করে একজন কিছু একটা বললো। কথা না বুঝলেও এতটুকু বোঝা গেল, হাত নেড়ে আর এগুতে মানা করছে। একেকটি ঢেউ যেন এক মুহূর্তে আমাদের নৌকাকে লণ্ডভণ্ড করে দেবে। শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টি। হাত উঁচিয়ে বাবুল চাচা চিৎকার করে বললেন, ভাতিজা দেখছেন নি ঐ দেখা যায় কালোর মতন; হেইডাই নতুন চর। নৌকার মেশিন বন্ধ করে এদিক সেদিক দেখে কিছুক্ষণ চিন্তিত হলেন এবং গতিবিধি বোঝার চেষ্ট করলেন। আফসোস করে বললেন, আপনাগো কপাল খারাপ, দূর থাইক্কা শুধু দেখলেন কিন্তু চরে নিতে পারলাম না! অহনই ফিরতে হইব, নইলে এমন পিটানী শুরু হইব শেষে জান নিয়া যাওনের উপায় থাকবো না! চরে যেতে না পারার দুঃখে আমাদের মন যতটা না ভারাক্রান্ত তার চেয়ে অধিক ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লেন বাবুল চাচা, যেন সবই তার দোষ। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, প্রয়োজনে কাল আবার চেষ্টা করব। ঘাটে ফিরে আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিলাম। তাতে কেবল নিরাশই হতে হলো। কারণ পরবর্তী দুই-তিন দিন পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকবে, এমনকি অবস্থার অবনতিও ঘটতে পারে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ মে ২০১৭/তারা

 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়