চা বিক্রেতা থেকে রেডিও ধারাভাষ্যকার
চৌধুরী জাফরউল্লাহ সারাফতের সঙ্গে আনোয়ার কবির
ছাইফুল ইসলাম মাছুম : কিশোর চা বিক্রেতা কবির দোকানে বেচা-বিক্রি নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু প্রথম দর্শনে ঠিক বোঝা যায় না তার মনোযোগ কোন দিকে? পাশেই রেডিওতে শোনা যাচ্ছে জাতীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ধারাভাষ্য। যখন রেডিওতে ধারাভাষ্যকার খোদা বকস মৃধা কিংবা জাফরউল্লাহ সারাফতের কণ্ঠ ভেসে আসে তখনই সজাগ হয়ে ওঠে কবির। রেডিওর শব্দ বাড়িয়ে দেয় সে। ধারাভাষ্য শুনতে তার যেন কোনো ক্লান্তি নেই। কবিরের খেলা-পাগল মনের কথা কারো অজানা নয়। কিন্তু এ কথা কেউ জানতো না যে, এই কবিরই একদিন হবে বাংলাদেশ বেতারের ধারাভাষ্যকার।
মনপুরা উপজেলার ফকির হাট বাজারের কিশোর চা বিক্রেতা আনোয়ার কবিরের স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। তিনি এখন সত্যি সত্যি তরুণ এক ধারাভাষ্যকার। আনোয়ার কবির রাইজিংবিডিকে বলেন, যে দিন প্রথম বাংলাদেশ বেতারের কমেন্ট্রি বক্সে বসে জাতীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ধারাভাষ্য দিচ্ছিলাম, আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার কথা দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা আগ্রহ নিয়ে শুনছেন। আমি নিজের গায়ে চিমটি কেটেছি- কল্পনা নয় তো?
২০১২ সালে বাংলাদেশ বেতারে যোগ দেয়া এই ধারাভাষ্যকার ইতিমধ্যে কাজ করেছেন দুটি বিশ্বকাপে। সুযোগ হয়েছে সর্বশেষ ভারতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টিতে ধারাভাষ্য দেওয়ার। তবে কবিরের আজকের পর্যায়ে উঠে আসার গল্প শুধু সংগ্রামেরই নয়, আত্মপ্রত্যয়েরও। কবিরের জন্ম ১৯৮৩ সালে মনপুরা উপজেলার চর ফয়েজউদ্দিন গ্রামে। ১৯৯৫ সালে ক্লাস ফোরে পড়ার সময় হঠাৎ তার পরিবারে দুর্গতি নেমে আসে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পর অভাবের তাড়নায় ছাড়তে হয় পড়াশোনা। বাবা পরিবার ছেড়ে চলে যান। একটা সময় চলে যান বড় ভাইও। সব দায়িত্ব তখন এসে পড়ে কবিরের ছোট্ট কাঁধে।
দায়িত্ব এড়িয়ে যাননি কবির। ছোট কাঁধে বড় দায়িত্ব নিয়ে পরিবারকে এগিয়ে নিতে থাকেন তিনি। কখনও কৃষিকাজ করে, কখনও নদীতে মাছ ধরে, কখনও মাটি কাটার কাজ নেন তিনি। এভাবেই চলে যায় পরবর্তী ৫ বছর। তারপর জীবনে কিছু একটা করতে হবে এমন ভাবনা থেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন কবির। পকেটে মাত্র ৪,৭০০ টাকা। সেই টাকায় মনপুরা ফকির হাট বাজারে দেন চায়ের দোকান। যখন দেখলেন বন্ধুরা সবাই পড়াশোনা করছে, তখন নিজেকে খুব ছোট মনে হতো তার। পুনরায় পড়াশোনায় মনোযোগী হবেন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না। যার কাছেই পরামর্শ চান তিনিই হেসে উড়িয়ে দেন। ফৈজুউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলে হেডমাস্টার সাহেবও তাকে ভর্তি করাতে চাননি। তার যুক্তি ছিল কবিরের পড়ালেখার বয়স নেই।
হাল ছাড়েননি কবির। অনেক প্রচেষ্টার পর ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান ক্লাস সেভেনে। বয়স তখন ১৭। ক্লাসের সবাই হাসাহাসি করে। পড়াশোনা থেকে অনেক দূরে থাকায় বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল অনেক কিছু। যে কারণে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় সব বিষয়ে ফেল করলেন। হেডমাস্টার তাকে স্কুল থেকে বের করে দিতে চাইলে আরেকটা সুযোগ চান তিনি। এরপরই কবিরের ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় হলেন তৃতীয়। আর বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি।
এরপর ২০০৫ সালে হাজিরহাট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উপজেলায় তৃতীয় হন এবং ২০০৭ সালে মনপুরা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসিতে উপজেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
এরপর কবিরের স্বপ্নের পরিধি আরো বেড়ে যায। তিনি ঢাকা আসতে চান। এবারও সবাই অনুৎসাহিত করলেও প্রিয় বাইসাইকেল বিক্রি করে পাড়ি জমালেন রাজধানীতে। কবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। তবে শেষ পর্যন্ত ভর্তি হন তিতুমীর কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে। সেখান থেকেই সাফল্যের সাথে শেষ করেন অনার্স ও মাস্টার্স।
বেতারে ধারাভাষ্যকার হওয়ার লালিত স্বপ্ন কবির ভুলে যাননি। অনার্সে পড়াকালীন চলতে থাকে প্রচেষ্টা ও প্রস্তুতি পর্ব। অবশেষে ২০১২ সালে সুযোগ হয় বাংলাদেশ বেতারে ধারাভাষ্যকার হিসাবে যোগ দেওয়ার। আগেই বলেছি, কবিরের রেডিও প্রীতি ছিল শৈশব থেকেই। কৃষিকাজসহ যেকোন কাজের সময়ও তিনি রেডিও শুনতেন। যেখানে যেতেন রেডিও তার সঙ্গেই থাকতো। ১৯৯৭ সালে প্রথম রেডিওতে শোনেন খোদা বকস মৃধা ও জাফরউল্লাহ সারাফতের কণ্ঠ।
তখন থেকেই তার স্বপ্ন ধারভাষ্যকার হবেন। এলাকার টুর্নামেন্টে ধারাভাষ্য দিতেন তিনি। বাড়ির পাশে ছিল হাওলাদার মাঠ, সেখানে প্রায়ই খেলা হতো। আনোয়ার কবির স্বেচ্ছায় গিয়ে কখনো টিনের চোঙায়, কখনো হ্যান্ড মাইকে ধারাভাষ্য দিতেন। এভাবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। মনপুরার কোথাও খেলা হলে ধারাভাষ্য দেয়ার জন্য ডাক পড়তো তার। সুতরাং ঢাকা এলেও সে কথা ভুলে যাননি তিনি। এই স্বপ্নপূরণ করতেই কোর্স করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগে, আঞ্চলিকতা মুছে প্রমিত বাংলা উচ্চারণ শেখার জন্য।
ধারাভাষ্যকার হওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়া শেষে আবেদন করলেন। তার সাক্ষাতকার নিলেন স্বয়ং খোদা বকস মৃধা। পছন্দও হলো। কিন্তু এ ঘটনার এক সপ্তাহ পরেই চিরবিদায় নিলেন খোদা বকস। কবির এবার কথা বললেন, চৌধুরী জাফরউল্লাহ সারাফতের সঙ্গে। তিনিই প্রথম দিন কবিরকে ফোন দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি চৌধুরী জাফরউল্লাহ সারাফত বলছি। ওয়েলকাম টু বাংলাদেশ বেতার।’
এরপর এগিয়ে চলার গল্প, সামনের গল্প শুধু সাফল্যের। ২০১২ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার খেলায় প্রথম ধারাভাষ্য দেন আনোয়ার কবির। দিয়েছেন ইডেন গার্ডেনে ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি ফাইনালের ধারাভাষ্য, সঙ্গে ছিলেন তার আদর্শ চৌধুরী জাফরউল্লাহ সারাফত। এরপর থেকেই বাংলাদেশ বেতারের চেনা কণ্ঠ তিনি। যতদিন বেঁচে থাকবেন রেডিও ধরাভাষ্যকার হিসেবেই মানুষের মাঝে থাকতে চান আনোয়ার কবির।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ মে ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন