ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চার্লি চ্যাপলিন : এখনো জনপ্রিয়

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ১৬ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চার্লি চ্যাপলিন : এখনো জনপ্রিয়

রুহুল আমিন : “রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে শরৎচন্দ্র একদা বলেছিলেন, ‘তোমার দিকে চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নেই।’ সেই রবীন্দ্রনাথ সিন্ধুপাড়ের হিস্পানি বিদেশিনীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন-

সুনীল সাগরে, শ্যামল কিনারে
দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে।

চার্লির দিকে তাকিয়ে সর্বক্ষণ এই দোহাটি মনে পড়ে।”- সৈয়দ মুজতবা আলী (চার্লি চ্যাপলিন প্রবন্ধ)।

জাঁ লুক গদার চ্যাপলিনকে তুলনা করেছিলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সঙ্গে, আর সত্যজিৎ রায়কে চলচ্চিত্রের একটি মাত্র নামকে বেছে নিতে বললে তিনি বেছে নিয়েছিলেন চ্যাপলিনকে।

১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল কিংবদন্তি ব্রিটিশ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব চার্লি চ্যাপলিন জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম স্যার চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন। আমরা তাকে চার্লি চ্যাপলিন নামেই চিনি। তিনি একাধারে পরিচালক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, শিল্পনির্দেশক ও সঙ্গীত পরিচালক। হলিউড সিনেমার প্রথম থেকে মধ্যকালের বিখ্যাততম শিল্পীদের একজন চ্যাপলিন। চ্যাপলিনকে চলচ্চি্ত্রের পর্দায় শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতাদের একজন বলেও মনে করা হয়।

নাকের নিচে ছোট্ট গোঁফ, মাথায় টুপি, হাতে ছড়ি, ঢোলা প্যান্ট, চাপা কোট, বিশাল জুতা পরা ভবঘুরে চরিত্রটি তো দর্শকদের মাঝে এখনো তুমুল জনপ্রিয়। নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের কিংবদন্তি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী চ্যাপলিন পৃথিবীর মানুষকে হাসাতে হাসাতে লুটোপুটি খাইয়ে ছাড়েন। স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাস্থ্যকর প্রবল হাসির ভেতরেই আবার যেন কোথায় তিনি গেঁথে রেখেছেন বেদনার মালা। সহসা হতভম্ব করে মন খারাপও করে দিতে পারঙ্গম ছিলেন চ্যাপলিন। নিজে ছিলেন তো লন্ডনের দারিদ্রক্লিষ্ট বস্তির এক খুচরো ছোকরা। তাই কি হাসাতে হাসাতে বিষাদে ভরা প্রশ্ন রাখেন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। কারণ নিজেই তো লিখতেন, অভিনয় করতেন। পরিচালনাসহ সবই তো নিজে করতেন।

অথচ চার্লি চ্যাপলিন হয়ে উঠতে গিয়ে কত বেদনা আর দুঃখকে তিনি পেরিয়ে্ এসেছেন। ফুটপাতে রাত কাটানো, এমনকি পঁচা খাবার কুড়িয়েও খেতে হয়েছে চ্যাপলিনকে। চ্যাপলিনের জন্মের পর বাবা-মার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। চ্যাপলিন মার সঙ্গেই থেকে যান এবং বলা যায় তার হাতেই চ্যাপলিনের হাতেখড়ি হয় অভিনয়ের। প্রথম জীবনে পেটের দায়ে, বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন। মুদির দোকান থেকে শুরু করে, ডাক্তারখানা, লোকের বাড়ির বাসন মাজা। কাচের কারখানা, রঙের দোকান, লোহার দোকান, ছাপাখানা, খেলনা কারখানা, কাঠচেরাই কল, কাগজ বিক্রিসহ বিচিত্র কাজ করেছেন। কিন্তু তিনি তো চার্লি চ্যাপলিন হবেন। তাই তো সব কিছুকে ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি পুরুষ।

১৮৯৮ সালে ৯ বছর বয়সে চ্যাপলিন একটি নাচের দলে যোগ দেন। ওই দলটি নাচ দেখিয়ে কিছু অর্থ-কড়ি রোজগার করত। চ্যাপলিনও কিছু পেতেন। তাই দিয়েই তার ও তার মায়ের দিন কাটত। কিন্তু এক সময় মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পুষ্টির অভাবে মা এক সময় মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। তারপর চ্যাপলিন তার মাকে একটি আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখানেই তার মা দীর্ঘ ১৭ বছর থেকে মৃত্যুবরণ করেন।

নাচের ওই দলে চ্যাপলিন কমেডিয়ানের ভূমিকা পালন করতেন। চ্যাপলিন নিজের মেধার প্রমাণ রাখতে শুরু করেন এই দলে থাকার সময় থেকেই। তখন চ্যাপলিনের ওপর তার সহকর্মীরা ঈর্ষান্বিত হতে থাকেন। কিন্তু অদম্য চ্যাপলিন শেষ পর্যন্ত নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। ১৯ বছর বয়সে ‘ফ্রেড কার্নো’থিয়েটার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ইংল্যান্ড থেকে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে৷ সেখানেই ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র জগতে রাজ্য বিস্তার শুরু৷ চ্যাপলিনের সিনেমায় হাসি-তামাশার অতল গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের জীবনের হাহাকার, রূঢ় বাস্তবতা আর এর বিরুদ্ধে মানুষের অবিরাম যুদ্ধ।

১৯১৪ সালে মানে চার্লি যখন ২৫ বছর বয়সী তখন প্রথম সিনেমাতে অভিনয় করেন। ‘মেকিং এ লিভিং’ ও ‘কট ইন দ্য রেইন’ নামে দুটি ছবি তিনি একই বছর করেছিলেন। তবে এর আরো অনেক পরে ৩২ বছর বয়সে ‘দ্য কিড’ ছবিতে অভিনয় তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়। ‘দ্য কিড’ ছবির গল্পটিও চ্যাপলিনেরই লেখা ছিল।

চ্যাপলিনের একাডেমিক শিক্ষা বলতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ গ্রহণ করেছেন। চেলো, বেহালা ও পিয়ানো বাজাতে পারতেন। তবে এসব শিখেছিলেন নিজে নিজে। প্রতিটি ছবির সঙ্গীত রচনা করেছেন নিজে৷

১৯১৮ সালে মিলড্রেড হ্যারিসকে প্রথম বিয়ে করেন চ্যাপলিন। ১৯২০ সালে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। পরে ১৯২৪ সালে আবার বিয়ে করেন ১৬ বছর বয়সী উঠতি অভিনেত্রী লিটা গ্রে’কে। কিন্তু এই বিয়েটাও শেষ পর্যন্ত টিকলো না। বিয়ের প্রায় তিন বছর পর দশ লাখ ডলারের সমঝোতায় চ্যাপলিন ও লিটা গ্রে’র মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। এরপর ১৯৩৬ সালে বিয়ে করেন পোলেট গোদা কে। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত টেকে তাদের সংসার। পরে ১৯৪৩ সালে উনা ও-নিলের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন চ্যাপলিন।

চার্লি  চ্যাপলিন  চলচ্চিত্রের জন্য দেশ-বিদেশে নানা সম্মানে সম্মানিত হযেছেন। রানী এলিজাবেথ কর্তৃক নাইট উপাধি পেয়েছেন। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে গোল্ডেন গ্লোব ও একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক পুরস্কার জিতেছেন তিনি। এ ছাড়া তার ছয়টি চলচ্চিত্র যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস বিশেষভাবে সংগ্রহ করেছে। ১৯৬৪ সালে চার্লির আত্মজীবনী প্রকাশিত হয় ( My Autobiography ) । বইটি সর্বকালের বেস্ট সেলার হিসেবে বিক্রি হয় । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার তৈরি ‘মূর্তি’ রয়েছে । চ্যাপলিনের সুইডিশ জীবনীকার লেনার্ট এরিকসন জানিয়েছেন, ১৯৮০ সাল পর্যন্ত চ্যাপলিনকে নিয়ে ৩৭টি ভাষায় ৫০০টি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। ২০১৭ সালে এসে নিশ্চয় সেই সংখ্যা আরো বিশাল হয়েছে। এমনকি তার ওপর বই রচিত হয়েছে ইদ্দিস, জাভানিজ, আজারবাইজানির মতো উপভাষাতেও।

১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বরে চার্লি চ্যাপলিন ৮৮ বছর বয়সে প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান সুইজারল্যান্ডের কার্সিয়ারে। তার বিখ্যাত সিনেমাগুলোর মধ্যে রযেছে Modern Times, City Lights, The Great Dictator, The Gold Rush, The Kid, Limelight, The Circus, Monsieur Verdoux ইত্যাদি।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ এপ্রিল ২০১৭/রুহুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়