ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ছেলেরা অন্তত বলতে পারবে ‘বাবা মুক্তিযোদ্ধা’

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ১৮ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছেলেরা অন্তত বলতে পারবে ‘বাবা মুক্তিযোদ্ধা’

ছবি : নিরব অরন্য

ছাইফুল ইসলাম মাছুম: ‘‘মুক্তিযুদ্ধের সময় রেড়িওতে একটি গান প্রায়ই বাজতো ‘হয়ত বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না, বড় বড় লোকেদের ভীড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে, তোমাদের কথা কেউ কবে না’- গানটির কথাগুলো এখন আমার জীবনের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গেছে।’’- কথাগুলো বলছিলেন নোয়াখালী হাতিয়া দ্বীপের মুক্তিযোদ্ধা জাফর বাঙালী।

মোহাম্মদ জাফর খান। সবার কাছে ‘জাফর বাঙালী’ নামেই পরিচিতি। বাবা মাস্টার মনিরুল হক। জাফর বাঙালী ১৯৭১-এ ছিলেন ১৮ বছরের টগবগে যুবক। সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা কিন্তু পড়াশোনায় মনোযোগ নেই রাজনীতি সচেতন তরুণটির। সব সময় ব্যস্ত মিছিল, মিটিং, শ্লোগানে শ্লোগানে। যুক্ত ছিলেন ছাত্রলীগ রাজনীতির সাথে। উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন পাঁচ বছর।

১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশকে হানাদার মু্ক্ত করার শপথ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন  মুক্তি সংগ্রামে। ভারতের পালাটানা ট্রেনিং সেন্টার থেকে ট্রেনিং নিয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টরের নোয়াখালী অঞ্চলে। মুক্তিযোদ্ধা জাফর বাঙালীর কমান্ডার ছিলেন অধ্যাপক ওয়ালী উল্যাহ ও ডেপুটি কমান্ডার রফিকুল আলম।

মুক্তিযুদ্ধকালীন নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে রণাঙ্গনের সম্মুখ যুদ্ধে জাফর বাঙালী ছিলেন সাহসী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। রামগতিতে মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহীনিকে প্রতিহত করা, হাতিয়া লঞ্চ ঘাটে পাকিস্তানি আর্মিদের পরাজিত করা ও হাতিয়া দ্বীপে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত হান্ড্রেড অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।

দেশ স্বাধীনের পরেও তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক অস্থিরতায় তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। প্রায় ৩২ বছর নিরুদ্দেশ থাকার পর ২০০৮ সালে দেশে ফেরেন। তত দিনে হাতিয়া দ্বীপের ভৌগলিক মানচিত্র আর সামাজিক প্রেক্ষাপট দুটোই অনেক বেশি পাল্টে গেছে। অনেক স্বাধীনতা বিরোধীরাও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে রাজনীতিতে সরব হয়েছেন। পাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সামাজিক মর্যাদা, যশ-খ্যাতি, পাচ্ছেন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাও। কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা জাফর বাঙালীর প্রাপ্য স্বীকৃতি মেলেনি ৪৬ বছরেরও।

শুধু রাষ্ট্র নয় প্রকৃতিও বিরুপ আচরণ করেছে জাফর বাঙালীর সাথে। রাক্ষসী মেঘনা কেড়ে নিয়েছে বাপ-দাদার ভিটে। ২০০৮ সালে ৫০-এরও অধিক বয়সে এসে তিনি বিয়ে করেছেন। বিবাহিত জীবনে তিনি দুই সন্তানের বাবা। গত দুই বছর স্ত্রী মানসিক রোগে আক্রান্ত। যে বীর যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছেন, তিনি এখন জীবনের শেষ সময়ে দারিদ্র্যের চরম কষাঘাতে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

জাফর বাঙালী বর্তমানে হাতিয়া জাহাজমারা ইউনিয়নের আমতলী বাজারসংলগ্ন একটি মৎস্য খামারে কেয়ার টেকারের কাজ করেন। প্রতি বছরই স্বাধীনতা দিবস আসে, বিজয় দিবস আসে, লাল সবুজের পতাকায় ছেয়ে যায় দেশ। টক-শো হয়, সেমিনার হয়, ইতিহাস নিয়ে টানাটানি হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে রাজনীতি হয়। কিন্তু কেউ খোঁজ রাখে না জাফর বাঙালীদের।

মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্তির জন্য জাফর বাঙালী একাধিকবার মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলেও অদৃশ্য কারণে আজও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্ত হয়নি তার। জাফর বাঙালী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘যদি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাই, তাহলে তৃপ্তি নিয়ে মরতে পারবো। আমার ছেলেরা অন্তত বলতে পারবে, বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিল।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ মার্চ ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়