ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কথোপকথন

‘জনমানুষকে সাহিত্যে উঠিয়ে আনাটাই আমার বড় প্রবণতা’

সেলিনা হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৮, ৩০ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘জনমানুষকে সাহিত্যে উঠিয়ে আনাটাই আমার বড় প্রবণতা’

গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণা- বাংলা সাহিত্যের সব শাখাতেই সেলিনা হোসেনের সাবলীল বিচরণ। ছোটদের জন্যও লিখেছেন। এই কথাসাহিত্যিকের গল্প-উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সঙ্কটের সামগ্রিকতা। বাঙালির অহঙ্কার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তাঁর লেখায় যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা। দীর্ঘদিন তিনি কাজ করছেন নারী-পুরুষের সামাজিক অবস্থান নিয়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থান, বৈষম্য, নির্যাতন ইত্যাদি নিয়েও তিনি সরব। তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন বহুভাবে। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা। সেলিনা হোসেনের ছোটগল্পের প্রবণতা, পটভূমি নির্বাচন, চরিত্র তৈরি ও প্রকরণ ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে কথাসাহিত্যিক হারুন পাশা’র সঙ্গে এই কথোপকথনে।

হারুন পাশা: আমাদের কথোপকথন যেহেতু ছোটগল্প নিয়ে, সেহেতু শুরুতেই বাংলা গল্পের অবস্থান নিয়ে জানতে চাচ্ছি- বর্তমানে বাংলা গল্প কেমন আছে? নতুন বাঁক নিতে পেরেছে কী?

সেলিনা হোসেন: বাঁক নিতে পেরেছে তা ঠিক বলা যাবে না। কিন্তু ধারাবাহিকক্রমে গল্প যেভাবে রচিত হয়ে এসেছে- সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয় নির্বাচন করে, বর্তমান সময় ধরে গল্পগুলো রচিত হচ্ছে। জনজীবনের পরিপ্রেক্ষিতে, মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা আর শিল্পের জায়গা থেকে চিন্তা করে, যারা যেভাবে ভাববে তার ধারাবাহিক একটা স্রোত আছে। নতুন কোনো বাঁক নিয়েছে তা বলতে পারব না। বনফুল অণুগল্প লিখেছিলেন বা রবীন্দ্রনাথ যেভাবে শুরু করেছিলেন; তারপর দেখেছি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী এবং পরবর্তী সময় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান; পরবর্তী সময়ে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হককে। আমি মনে করি, এই স্রোতে আমাদের গল্পগুলো ঠিকই তৈরি হচ্ছে। এখানে সময়ের ব্যবধানটাই প্রধান।

হারুন পাশা: ছোটগল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সংজ্ঞা রয়েছে। এই সংজ্ঞা অনুসরণ করে কী গল্প লেখা হচ্ছে? সেই সংজ্ঞাটা আমাদের কী প্রয়োজন আছে?

সেলিনা হোসেন: আমি মনে করি, কোনো সংজ্ঞা দিয়ে সাহিত্যের বিচার হবে না। বিবর্তিত ধারায় সাহিত্য নতুন করে তৈরি হবে। নতুন বিষয় আসবে, নতুন আঙ্গিক আসতে পারে, শিল্পবোধ আলাদা হতে পারে। কিন্তু কোনো তাত্ত্বিক ধারণা থেকে এটা হবে না।

হারুন পাশা: আপনি যখন লেখালেখি শুরু করেন তখন বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার পরিবেশ কেমন ছিল?

সেলিনা হোসেন: আমি ষাটের দশকে লেখালেখি শুরু করেছি। কলেজ জীবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে। সেটা ১৯৬৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে। ষাটের দশকে সাহিত্যে ভালো একটি জোয়ার এসেছিল। যেটা আঙ্গিক, শিল্প বা বিষয় নির্বাচনের দিক থেকে। আমাদের লেখকরা সবদিক থেকেই একটা জায়গা তৈরি করতে পেরেছিলেন।

হারুন পাশা: আপনি তো ষাটের গল্পকার। চল্লিশ বা পঞ্চাশ দশকের গল্পকারদের সঙ্গে আপনার কী যোগাযোগ ছিল?

সেলিনা হোসেন: না, তা ছিল না। আমি তখন একজন উঠতি লেখক। লেখালেখি মাত্র শুরু করেছি। তাছাড়া আমি রাজশাহীতে ছিলাম। কাজেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগের বড় ধরনের কোনো সুযোগও ছিল না। ঢাকায় থাকলে হয়তো জানাজানির সুযোগ হতো। এ সুযোগ আমি পাইনি।

হারুন পাশা: আপনি যখন ঢাকায় এলেন তখন কি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু ইসহাক, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে সাহিত্য বিষয়ে আলাপ হতো?

সেলিনা হোসেন: ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির চাকরিতে যোগ দিয়েছি। দেখেছি সাহিত্য বা কাজের সূত্রে তারা বিভিন্ন সময় সেখানে আসতেন। তবে এসব বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করার মতো অত বড় সুযোগ হতো না। তাদের দেখেছি, পরিচয় হয়েছে, কুশল বিনিময় হয়েছে- এই পর্যন্তই। কিন্তু সাহিত্য বিষয়ে আলাপ করা হয়নি। আমার মনে হয়, সেই বয়স কিংবা যোগ্যতা আমার কোনোটাই ছিল না। আড্ডা দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।

হারুন পাশা: আপনার গল্পে ফিরছি। আপনার গল্পের প্রবণতাগুলো কেমন?

সেলিনা হোসেন: এ বিষয়ে তো আমি বলব না। সমালোচকরা বলবেন। তুমি যেমন গল্প-উপন্যাস ভালো লিখো, তেমনি একজন ঋদ্ধ সমালোচকও। তুমিই বলো আমার গল্পের প্রবণতা কী? তোমার এম.ফিল থিসিসের বিষয় ছিল- ‘সেলিনা হোসেনের গল্পে নিন্মবর্গ’। আমি মনে করি, আমার গল্পের এটাই প্রধান দিক। তুমি ঠিক বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছো। জনমানুষকে সাহিত্যে উঠিয়ে আনাটাই আমার বড় প্রবণতা।

হারুন পাশা: বই ধরে আলোচনায় যেতে চাই। ‘মতিজানের মেয়েরা’ গল্পগ্রন্থটি লেখার পেছনের গল্প কেমন?

সেলিনা হোসেন: ‘মতিজানের মেয়েরা’ বইয়ের গল্পগুলো ঠিক ওভাবে সাজাইনি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গল্প লিখেছিলাম, তারপর গল্পগুলো নিয়ে বইটি প্রকাশ করি। এটা যে এই ধরনের একটি গল্পের বই হবে সেটা চিন্তা করে গল্পগুলো লিখিনি। কিন্তু চিন্তা করেছি, আমাদের জীবনে নারী ইস্যুতে এই গল্পগুলো কীভাবে আসতে পারে। সেটা থেকেই গল্পের ভাবনাগুলো ঠিক করেছিলাম। কারণ ‘মতিজানের মেয়েরা’ গল্পে মতিজান চরিত্রটি গল্পের বড় একটি অনুষঙ্গ। নিজের ছেলেটা কী করছে সে খোঁজ না রেখে মা ছেলের বউকে নানাভাবে নির্যাতন করছে। এটা তো আমাদের সমাজের একটি দিক। এই দৃষ্টি থেকে আমি নারী বিষয়ে গল্পগুলো লিখেছি। ‘হৃদয় ও শ্রমের সংসার’ গল্পে দেখিয়েছি, এক লোক তিনটি বিয়ে করেছে কিন্তু কোনো সন্তান হয়নি। তাই আবারো বিয়ে করতে চায়। লোকটি এক মেয়ের বাবাকে বলে, তার মেয়েকে সে বিয়ে করতে চায় এবং তাকে এক খণ্ড জমি লিখে দিবে। মেয়েটি এ কথা শোনার পর ভাবে, এক খণ্ড জমির জন্য বাবা তাকে বিক্রি করছে। তারপর মেয়েটি ওই লোকের বাড়িতে গিয়ে বলে, বাবাকে আপনার জমি লিখে দিতে হবে না। আপনি কাজী ডাকেন। পরে স্বামী যখন সন্তান চায় তখন মেয়েটি বলে, পরিবার পরিকল্পনার লোকদের কাছে শুনেছি- শুধু মেয়েদের সমস্যার কারণে নয়, পুরুষের সমস্যার কারণেও সন্তান হয় না। আপনি কি ডাক্তার দেখিয়েছিলেন? ডাক্তার না দেখানো পর্যন্ত আমাকে বিছানায় নিতে পারবেন না। দোষ শুধু আমার ঘাড়ে চাপানো যাবে না। এই যে প্রশ্নটি মেয়ে করতে পারে- এটি প্রতিবাদ। মেয়েদের দমন করার যে জায়গা তার বিপরীতে কথা বলার চেষ্টা করেছি বইটিতে।

হারুন পাশা: ‘মতিজানের মেয়েরা’ গল্পেও এমনটা দেখা যায়...।

সেলিনা হোসেন: হ্যাঁ, গল্পটিতে শাশুড়ি বংশ রক্ষার জন্য ছেলের বউয়ের কাছে সন্তান চায়। কিন্তু নিজের ছেলেকে কখনো প্রশ্ন করছে না। ছেলে বাজারে যায়, পতিতাদের কাছে যায়, নিজে আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে এবং উপভোগ করে। কিন্তু বউ কী করছে সে দিকে কোনো খেয়াল নাই। বউকে যে যত্ন করতে হবে সে চিন্তা শাশুড়ির নাই। ছেলেটি তার বন্ধুকে দিয়ে বাজার করিয়ে যখন বাড়িতে পাঠায় তখন সেই বন্ধুর সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ক হয় এবং তার দ্বারা মেয়েটি গর্ভবতী হয়। মেয়েটির দুটি মেয়ে সন্তান হওয়ার পর শাশুড়ি বলে, ছেলে না হলে তোমাকে তালাক দেওয়াবো। এই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব সমাজে বহমান ছিল। যে কারণে এর বিরুদ্ধে কথা বলাটা জরুরি মনে করেছি। শাশুড়ি লোকজন ডেকে যখন বলে, দুটি মেয়ে হয়েছে, কোনো ছেলে হয়নি। তাই বউকে তালাক দেওয়াবো। তখন বউটি তার মেয়ে দুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, আপনার ছেলের জন্য অপেক্ষা করলে আমি এই বাচ্চা দুটিরও মা হতে পারতাম না। আমি নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, নারীর অবস্থানকে জোরদার করার জন্য গল্পগুলো লিখেছি।

হারুন পাশা: ‘আকালির স্টেশনের জীবন’ গল্পে আকালি সমাজ-ধর্মের চাপানো নিয়ম মানতে রাজি নয়।

সেলিনা হোসেন: সমাজ মেয়েদের যৌনতাকে স্বীকার করে না। ছেলেটির পাশাপাশি মেয়েরও যে এটা উপভোগের ব্যাপার আছে সমাজ ওভাবে দেখে না। এই বিষয়টি গল্পে তুলে ধরতে চেয়েছি।  গল্পে ছেলেটি কাজের মেয়ে হিসেবে তাকে উপভোগ করেছে এবং মেয়েটিরও ভালো লেগেছে। কারণ এ বিষয়ে মেয়েটির পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না এবং সুযোগও তার জীবনে আসেনি। মেয়েটির গর্ভ হলে ছেলেটির মা ঘটনাটি টের পায়। মেয়েটিকে মারতে গেলে মেয়েটি বলে, আমাকে মারবেন না। আমি চলে যাব। কারণ আমারও ভালো লেগেছে, আমারও এতে আনন্দের জায়গা ছিল। আমি আপনার বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এইভাবে বিষয়টি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে উপস্থাপনের চেষ্টা করতে চেয়েছি। কারণ নারীর যৌনতাকে স্বীকার না করে তাকে সবসময় নির্যাতন করা হয়, সে জায়গাটা অন্যভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছি। নারীরও উপভোগের জায়গা আছে, সেটা যাতে সে খুব সুন্দরভাবে গ্রহণ করতে পারে।

হারুন পাশা: আপনার গল্পে মুক্তিযুদ্ধের একটা বড় অংশ রয়েছে। গল্পগুলো লেখার সময় কীভাবে ভাবনা এগিয়েছে?

সেলিনা হোসেন: মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা আমি দেখেছি। আমি মনে করি, ১৯৭১ সাল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময়টা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে যা কিছু দেখেছি, যা কিছু পড়েছি, অন্যের কাছ থেকে যা শুনেছি, সবকিছু মিলিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের আঙ্গিকে বিভিন্নভাবে গ্রহণ করেছি। তোমার কী বিশেষ কোনো গল্প নিয়ে প্রশ্ন আছে?

হারুন পাশা: না, সার্বিকভাবে জানতে চাই।

সেলিনা হোসেন: মুক্তিযুদ্ধ সাহিত্যের অনেক বড় উপাদান। এই উপাদানকে বিভিন্নভাবে গল্প, উপন্যাস, কবিতায়, নাটকে কাজে লাগিয়েছে সবাই। কারণ এটা জনজীবনের এত বড় একটি ঘটনা, যার থেকে ছোট ছোট বিষয় নির্বাচন করে গল্প লেখা হয়। ‘আমিনা ও মদিনার’ গল্পে বাবার চরিত্রটি ধর্মপ্রাণ এক ব্যক্তির। সে নামাজ পড়ে, মসজিদে ইমামতি করে; তার ধর্মীয় দিক থেকে ঠিক আছে কিন্তু তার মেয়ে দুটিকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায় বাঙ্কারে। সেই মেয়ে দুটি স্বপ্ন দেখে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আসবে, তাদের উদ্ধার করবে। দুর্বিষহ জীবন থেকে তারা মুক্তি পাবে। এটাও যুদ্ধের একটা দিক ছিল। ধর্মের নামে ওরা অনেক কিছুই করেছে। কারণ আমি ইকবাল হলে যেভাবে ছেঁড়া কোরআন শরীফ দেখেছি, সেইদিন আমার প্রথম মনে হয়েছে- এরা কেমন মুসলমান! পবিত্র ধর্মগ্রন্থ এভাবে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছে। এটা থেকেই আমার ওই ধারণাটি এসেছিল। ধর্মের নামে যুদ্ধের যে পরিবেশ ওরা তৈরি করতে চেয়েছিল, সেই পরিবেশ ওরা নিজেরাই রক্ষা করেনি।

হারুন পাশা: আপনি তো বিদেশি পটভূমি নিয়েও গল্প লিখেছেন...।

সেলিনা হোসেন: বিদেশি পটভূমি নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছি। নেলসন ম্যান্ডেলা, চে গুয়েভারা, পাবলো নেরুদাসহ বেশ ক’জনকে নিয়ে কাজ করেছি। এই পটভূমির গল্পগুলো কিন্তু আমার দেশের পাঠককে ওই চরিত্রগুলো বুঝানোর জন্য। প্যালেস্টাইনের কবি মাহমুদ দারবিশ। তাকে আমি কোরিয়ার একটি সাহিত্য সম্মেলনে পেয়েছিলাম। তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য নিরন্তর লিখেছেন, লড়াই করেছেন। কিন্তু তার আগেই তার মৃত্যু হলো। প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার পক্ষে, নিজের পরিচয়ের পক্ষে মাহমুদ যে বিষয়টি হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন, সেই বিষয়টি নিয়ে আমি গল্প লিখেছি। এভাবে গল্প লেখাকে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। এগুলো নিয়ে একটি গল্প সংকলন করার ইচ্ছে আমার রয়েছে।

হারুন পাশা: আদিবাসী জীবনও তো আপনার লেখায় উঠে এসেছে।

সেলিনা হোসেন: আদিবাসীদের জনজীবন নিয়ে গল্প লিখেছি। ‘নীল মাছির উড়াউড়ি’;  কয়েক বছর আগে সাজেক ভ্যালিতে সেনাদের সঙ্গে আদিবাসীদের গোলাগুলির ঘটনায় একজন মারা গিয়েছিল- সেটা নিয়ে লেখা গল্প। গল্পটি শেষ করেছি এভাবে- যে লোকটি মারা গেল, তার মরাদেহ যখন আনা হবে তখন মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো হবে। তখন মৃত লোকটির মেয়ে চিৎকার করে বলে, মঙ্গল প্রদীপ তো জীবিত মানুষের জন্য জ্বলবে, মৃত মানুষের জন্য নয়। এভাবে যেন আর কেউ না মারা যায়। এভাবে গল্পটি আমি শেষ করেছি। আমাদের আদিবাসীদের নিয়ে আরো বেশ কিছু গল্প লিখেছি।

হারুন পাশা: আপনার গল্পের চরিত্ররা কীভাবে তৈরি হয়?

সেলিনা হোসেন: অনেক সময় কাছ থেকে দেখা একজন মানুষ থেকে চরিত্র তৈরি করি। সেটা নারী-পুরুষ যে কেউ হতে পারে। এক্ষেত্রে আমার কল্পনার মিশেলও থাকে। আবার কখনো শুধু আমার কল্পনা থেকে তৈরি হয়। একজন মানুষকে কখনো নির্দিষ্ট গল্পের ছকে ভাবি। এই পটভূমিতে এইরকম একজন মানুষ তৈরি হবে। আবার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে যেগুলো তৈরি করি, সেগুলো তো ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে থাকে। এর সঙ্গে আমার ভাবনা যুক্ত হয়। যুক্ত তো হতেই হবে, যুক্ত না হলেই বরং অন্যরকম হয়ে যাবে।

হারুন পাশা: কীভাবে গল্পের পটভূমি নির্বাচন করেন?

সেলিনা হোসেন: যখন পটভূমি নির্বাচন করি তখন আমি সেই পটভূমিতে চরিত্রগুলো দাঁড় করাই। যেমন: ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসের শেষে একজন মা দু’জন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে তার সন্তানকে পাকিস্তানি আর্মির কাছে তুলে দেয়। এটা বাস্তব ঘটনা। কিন্তু এই চরিত্রটি আমি শৈশব থেকে শুরু করেছি। সে কীভাবে এই মানসিক শক্তিটা অর্জন করেছে তা দেখিয়েছি। তার নাম রাখা হয়েছে ‘বুড়ি’। অনেকগুলো সন্তানের মধ্যে তার বাবা-মা তাকে অতটা গুরুত্ব দেয়নি। সে বাবার কাছে গিয়ে নামটা বদল করতে চাচ্ছে। তার ভেতরে যে চেতনা ও চিন্তার জায়গা সেগুলো কিন্তু ধারাবাহিকভাবে দেখিয়ে এসেছি। তার শৈশব-কৈশোর-যৌবন তার বিবাহিত জীবন সবকিছু মিলিয়ে যদি আমি তৈরি না করি তাহলে ওই বুড়িকে নিজের সন্তান উৎসর্গ করার জায়গায় আমি নিতে পারি না। কারণ স্বাধীনতার জায়গাটা সে কীভাবে দেখছে? আমাকে তো তাকে সেই চিন্তার মধ্যে আনতে হবে। সে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখছে- এই যুদ্ধে নিজেকে সে অংশীদার হিসেবে ভাবছে। কী করে স্বাধীনতা আনবে সেটা সে ভাবছে। গ্রামীণ পরিবেশে তার শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু তার চেতনা ও চিন্তার জায়গাটা অনেক বড় ছিল। সে অনেক কিছু ভাবতে পারে। অনেক বিপরীত চিন্তা করতে পারে। অথচ যাদের সাথে সে খেলাধুলা করেছে তারা এই চিন্তাগুলো করতে পারেনি। কাজেই তার তৈরি হওয়ার ব্যাপারটা আমি ভাবনা থেকে যুক্ত করেছি।

হারুন পাশা: এক্ষেত্রে বাস্তবে কোনো চরিত্রের সঙ্গে কথা বলা, আড্ডা দেওয়া কিংবা ফিল্ড ওয়ার্ক করেন কিনা?

সেলিনা হোসেন: আমি তো সবসময়ই ফিল্ড ওয়ার্ক করি। কারণ এটা করতেও আমি ভালোবাসি। শৈশব-কৈশোর থেকেই আমি অজস্র জায়গায় ঘুরেছি, অজস্র মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। এগুলো যে গল্প লেখার জন্য করেছি তা না। হয়তো দুই বছর আগে একটি ঘটনা আমাকে আলোড়িত করেছিল কিন্তু দুই বছর পরে সেই গল্পটা লিখলাম। এভাবেই হয়। বিষয়গুলো মাথায় থাকে, চিন্তায় থাকে কিংবা ছোট ছোট নোট থাকে। যখন লিখতে বসি তখন এগুলো বের করে লিখতে বসি। এমন নয় যে, আজকে কোনো একটি গ্রাম ঘুরে এলাম একটি চরিত্র ভালো লেগেছে, এখনি ওই চরিত্রটা নিয়ে গল্প লিখব। সেটা করি না। কারণ নোট রাখি তারপর চিন্তা করার জন্য সময় নেই।

হারুন পাশা: লিখছেন ৫৫ বছর ধরে। বেরিয়েছে প্রায় আটশ পৃষ্ঠার গল্পসমগ্র। এত সময় ধরে লেখার পরও, বিশাল সমগ্র বেরোনোর পরও কী মনে হচ্ছে এখনো অনেক গল্প লেখা বাকি?

সেলিনা হোসেন: হ্যাঁ, এখনো অনেক গল্প লেখা বাকি আছে। কারণ অনবরত তো বিষয় পাচ্ছি। ব্যক্তির সংকট, গণমানুষের বেঁচে থাকার চেষ্টা ইত্যাদি সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন রূপ নেয়।

হারুন পাশা: গল্প লেখার জন্য নতুন নতুন অনেক পটভূমি পাচ্ছেন। ওই পটভূমিগুলো কেমন, এ বিষয়ে বলবেন কী?

সেলিনা হোসেন: একটি গল্প লেখার বিষয় নিয়ে ভেবেছি। একজন বামন মেয়ে। মেয়েটিকে যখন তার বাবা-মা বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে তখন ছেলেপক্ষ অনেক যৌতুক দাবি করে। মেয়ের বিয়ের জন্য বাবা তখন আবাদি জমি বিক্রি করতে চায়। তখন মেয়েটি বাবাকে বলে, কৃষি জমিটা বিক্রি করে আমাকে বিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। ওই জমিটা বরং আমাকে দিলে ভালো, ওই জমি দিয়ে আমি জীবিকা নির্বাহ করব। এইসব জায়গা থেকে আমি বিষয় বৈচিত্র্য খুঁজছি। অজস্র বিষয় আছে শ্রেণি-বৈষম্য সমাজে। মানুষের অবমাননা অনবরত ক্ষত তৈরি করে।

হারুন পাশা: আপনার গল্পের প্রকরণ নিয়ে এবারের প্রশ্ন। প্রকরণগত কোন ধরনের নিরীক্ষা করেছেন?

সেলিনা হোসেন: বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছি। যাতে নিরীক্ষার বিষয়টি থাকে। একঘেঁয়ে গল্প লিখে গেলাম সেটা না করে শিল্প বিচারের জায়গা থেকে, আঙ্গিকগত বিচারের জায়গা থেকেও গল্পে ভিন্নতা আনার চেষ্টা অনবরত করে থাকি।

হারুন পাশা: বিশ্বসাহিত্যের সাথে বাংলাদেশের ছোটগল্পের তুলনা করলে আমাদের দেশের গল্পের অবস্থানটা কেমন হবে বলে মনে করেন?

সেলিনা হোসেন: আমি তো বলব, আমাদের গল্পের অবস্থান বিশ্বসাহিত্যের সমানই। কারণ আমরা যারা লাতিন আমেরিকার বা আফ্রিকান বা ইউরোপের লিটারেচার পড়ি তখন দেখি তাদের সাংস্কৃতিক পটভূমিতে গল্পটা আসছে। আর আমাদের সাংস্কৃতিক পটভূমিতে আমাদের গল্পটা তৈরি হচ্ছে। আমাদের জীবন অনুষঙ্গ আসছে, ওদেরটা ওদের গল্পে আসছে। সুতরাং আমাদের লেখকদের জায়গা থেকে আমি মনে করি, আমাদের প্রবীণ-নবীন লেখকরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে শিল্পমূল্য বিচারে ভালো গল্প লিখেছেন। অন্য দেশের লেখকরা লিখছেন আমাদের গল্প তাঁদের সমতুল্য।

হারুন পাশা: দুই বাংলার গল্পের ভেতর যদি তুলনা করা যায় তাহলে বাংলাদেশের গল্পের অবস্থানটা কেমন? বিশেষত ’৪৭-এর দেশভাগের পর বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে লেখা গল্পগুলোয় কোন ধরনের পার্থক্য লক্ষ্যণীয়?

সেলিনা হোসেন: ’৪৭-এর পর থেকে  বাংলা সাহিত্যের যে মূল স্রোত, সেই স্রোতের বিপরীতধর্মী একটি স্রোত আমরা তৈরি করতে পেরেছি। ১৯৪৭ সালের পর আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক যে জায়গা তৈরি হয়েছিল তা আমাদের জনসাধারণের প্রেক্ষাপটে বিপুল ঘটনা। এই ঘটনা আমাদের সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমাদের পাশের দেশের লেখকদের এসব দেখতে হয়নি। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিপরীতে একটা উপাদান এসেছে, লেখকরা এই উপাদান নিয়ে গল্প লিখেছেন। ষাটের দশকে আমাদের যেসব আন্দোলন হয়েছে, সেসবের প্রেক্ষাপটে তারা গল্প লিখেছেন। তারপর ’৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ- এই ধারাবাহিক ক্রমের মধ্যে আমরা গল্পের উপাদান খুঁজে বের করেছি। যে কারণে আমাদের ধারাটা মূল স্রোত থেকে ভিন্ন। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণ-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, আবার সামরিক শাসন- আমাদের এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমাদের গল্পটা আলাদা হয়ে যায়।

হারুন পাশা : তরুণদের হাতে ভাঙা-গড়া থাকে। বাংলাদেশি তরুণ গল্পকারদের হাতে গল্পের এই ভাঙা-গড়া কেমন লক্ষ করছেন?

সেলিনা হোসেন : বর্তমানে ভাঙা-গড়াটা ঠিক ওভাবে আসছে না। একটা প্রথাগত গল্প চলছে। তুমি একটু আগে যেটা বললে বাঁক বদল, সেটা হয়নি। গল্পের স্রোতটাকে ওরা ধরে রেখেছে। আমাদের সাহিত্যের স্রোতটাকে তারা বেগবান রেখেছে। লিখে যাচ্ছে। কিন্তু একদম খুব বড় ধরনের আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে তারা আসেনি। কিন্তু স্রোতটা তো ধরে রেখেছে, বন্ধ হয়ে যায়নি। তারা সময়কে ধরেছে। জীবনের নানা অনুষঙ্গ ধরেছে। সেইভাবে গল্পগুলো এসেছে। এটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এক্ষেত্রে অবশ্যই কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের কথা বলতে হবে। জহির তাঁর গল্পে ভিন্নতার আবেশ তৈরি করেছে। বিষয় ও আঙ্গিকের দিক থেকে এই ভিন্নতা চমকপ্রদ। 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়