ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজনৈতিক প্রাধান্য ও অনিয়ম

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
 জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজনৈতিক প্রাধান্য ও অনিয়ম

নিজস্ব প্রতিবেদক : জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় স্থানীয় সরকারের বাস্তবায়ন করা প্রকল্পে রাজনৈতিক প্রাধান্য, দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি, প্রকল্প বাস্তবায়নে জনসম্পৃক্ততা না থাকা, সম্ভাব্যতা যাচাই না করে প্রকল্প প্রণয়ন ইত্যাদি অনিয়মের অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে ‘জলবায়ু অর্থায়ন ও স্থানীয় সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করা হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার এএসএম জুয়েল এবং ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাহিদ শারমিন।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘জনগণের অর্থে পরিচালিত এই তহবিল যেন কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত না হয় এবং সুষ্ঠুভাবে ব্যবহূত হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা প্রকল্পে যে দূরাবস্থা তার জন্য ট্রাস্টফান্ডের অব্যবস্থাপনা দায়ী। এক্ষেত্রে প্রকল্পে জনগণের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তাই বিসিসিটির তহবিল ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।

এ সময় টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘জলবায়ু ঝুঁকি ও বিপদ বিবেচনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নিশ্চিত করার জন্য জলবায়ু তহবিল বৃদ্ধি; বিসিসিটি ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠন; স্থানীয় জলবায়ু ঝুঁকি যথাযথভাবে যাচাই করে প্রকল্প অনুমোদন এবং বিসিসিটি’র ভূমিকা পরিমার্জন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি: নীতিমালা, আইন ও নির্দেশিকা পরিমার্জন করা দরকার।’

তিনি বলেন, ‘প্রকল্প গতানুগতিকভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। এক্ষেত্রে কাজের গুণগত মান বিবেচনায় না নিয়ে আঞ্চলিক প্রভাব ও রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রকল্পে অর্থায়নে অসামঞ্জস্যতা পাওয়া গেছে।’

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ ১০৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে টিআইবি ছয়টি প্রকল্প নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী তিন ধরনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান - পৌরসভা, জেলা পরিষদ এবং সিটি কর্পোরেশন এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্প প্রণয়নে সুশাসনের যে সকল চ্যালেঞ্জসমূহ পাওয়া গেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ছয়টি প্রকল্পের কোনোটিতেই কমিউনিটি পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রভাব এমনকি চাহিদা নিরূপণ কিংবা বিপদাপন্নতা বিশ্লেষণ করা হয়নি; ছয়টি প্রকল্পের কোনোটিতেই প্রকল্প প্রণয়নকালে জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়নি; প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরিতে সংশ্লিষ্ট মেয়র ও জেলা পরিষদের ক্ষেত্রে প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ও পৌর সচিবের মুখ্য ভূমিকা; পাঁচটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে কাউন্সিলরদের অংশগ্রহণ না থাকা; চারটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে কমিউনিটি পর্যায়ে চাহিদা নিরূপন ও বিপদাপন্নতা বিশ্লেষণ ছাড়াই প্রস্তাবনায় যেসব সমস্যা উল্লেখ করা হয় তার ভিত্তিতে অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকল্প কর্মসূচি এবং বাজেট কমানো হয়; চারটি প্রকল্পে গতানুগতিক অবকাঠামো নির্মাণ; সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রণয়ন। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে তথ্যের উন্মুক্ততার ঘাটতি রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন, ২০১০ অনুসারে জলবায়ু প্রকল্পের সাথে অন্য প্রকল্পের দ্বৈততা পরিহারের নির্দেশ থাকলেও একটি প্রকল্পের মাধ্যমে অন্য প্রকল্পের অসমাপ্ত প্রাচীর নির্মাণ করা হয়।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সচিব, মেয়র ও প্রকৌশলী কর্তৃক আত্মীয়, বন্ধু এমনকি রাজনৈতিক বিবেচনায় ঠিকাদার নির্বাচন করা হয়েছে। একটি প্রকল্পে তহবিল বরাদ্দের পরও নবনির্বাচিত মেয়র ভিন্ন রাজনৈতিক দল সমর্থিত হওয়ায় প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করে অন্য প্রতিষ্ঠানকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধি, ১৯০০ অনুযায়ী আদিবাসীরা করের আওতামুক্ত হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি প্রকল্পে কর ও মূসক ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে কাগজে কলমে আদিবাসী ঠিকাদার নির্বাচন করা হলেও বাস্তবে কাজ সম্পন্ন করা হয় বাঙালী ঠিকাদার দ্বারা। প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন সম্পর্কে স্থানীয় উপকারভোগীরা সংগতি, জবাবদিহি ও ন্যায্য বণ্টন মোটামুটি হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে এবং সুশাসনের মাপকাঠিতে উপকারভোগীগণ সার্বিকভাবে কোনো প্রকল্পকেই শক্তিশালী মনে করেননি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো বিসিসিটি কর্তৃক গুণগত পরিবীক্ষণ এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকালে স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক পরিবীক্ষণে ঘাটতি এবং বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ কর্তৃক প্রকল্প মূল্যায়নে ঘাটতি। এছাড়া পরিবীক্ষণের সময় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করা হয় না।

গবেষণার তথ্য অনুয়ায়ী, সুশাসনের ঘাটতির কারণ হিসেবে আইন, নীতিমালা ও নির্দেশিকায় দুর্বলতা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা ও সমন্বয়ের ঘাটতি, প্রকল্প পর্যালোচনা এবং অনুমোদন প্রক্রিয়ায় দুর্বলতা এবং স্থানীয় জলবায়ু বিপদাপন্নতা এবং বরাদ্দের মধ্যে অসামঞ্জস্য উল্লেখযোগ্য।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুশাসনের ঘাটতির প্রভাব হিসেবে প্রকল্পের ফলাফল কার্যকর না হওয়া অন্যতম। একটি প্রকল্পে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট ব্যবহৃত না হওয়া এবং বর্জ্য ট্রান্সফার স্টেশন ভিন্ন কাজে ব্যবহারের ফলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আরেকটি প্রকল্পে জমি মালিকের আপত্তির কারণে ড্রেন নির্মাণ অসমাপ্ত রয়েছে। অপর আরেকটি প্রকল্পে নির্মিত জলাধার দু’সপ্তাহের বেশি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ব্যর্থ এবং আরেকটি প্রকল্পে বিদ্যালয় কাম আশ্রয়কেন্দ্র বিরোধপূর্ণ জায়গায় নির্মাণ করায় শিক্ষকদের মধ্যে উৎকন্ঠা ইত্যাদি। ফলে স্থানীয় জনগণ জলবায়ু তহবিলের প্রত্যাশিত মাত্রায় সুফল হতে বঞ্চিত হচ্ছে।

গবেষণায় প্রাপ্ত ইতিবাচক কিছু দিক উপস্থাপন করা হয় সংবাদ সম্মেলনে। তা হলো-দু’টি প্রকল্পে জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় ভিন্নধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ (পরিবারভিত্তিক দুর্যোগ সহনশীল ঘর নির্মাণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা), দু’টি প্রকল্পে তথ্য বোর্ডের মাধ্যমে প্রকল্প সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রকাশ এবং চারটি প্রকল্পে প্রস্তাবনার সাথে বাস্তবায়নের সঙ্গতি, সকল প্রকল্পের প্রাথমিক কার্যক্রম বিসিসিটি কর্তৃক এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক পরিদর্শন, একটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে উপকারভোগীরা নিজেরাই জনপ্রতিনিধিদেরকে তাদের এলাকায় পেয়ে অভিযোগ জানালে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ কর্তৃক একটি প্রকল্প মূল্যায়ন করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি পরিচালক মো. রফিকুল হাসান।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জানুয়ারি ২০১৭/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়