ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জাগতিক যাতনার কথা বলতেন তিনি

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:২৩, ১৭ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জাগতিক যাতনার কথা বলতেন তিনি

রুহুল আমিন : ‘আমার নাটকগুলো আসলে আমার আত্মজীবনী। আমি সেই নাটক লিখতে পারিনি যেখানে আমি নেই। আমার প্রতিটি নাটকে আমি আছি। এছাড়া কিভাবে লিখতে হয় আমি জানিই না।’ নিজের নাটককে এভাবেই মূল্যায়ন করেছেন বিশ্বখ্যাত নাট্যকার আর্থার মিলার।

আর্থার মিলার একজন মার্কিন নাট্যকার, প্রবন্ধকার, লেখক ও চিত্রনাট্যকার। কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন। পারিবারিক আর্থিক দুরাবস্থা কাটিয়ে উঠতে গুদামেও কাজ করেছেন । তবে বিশ্বব্যাপী তার পরিচিতি নাট্যকার হিসেবেই।

মিলারের নাটকের সবচেয়ে বড় দিক হলো তিনি পারিবারিক সুখ, দুঃখ ও বেদনার গল্প বলতেন।তার কারণও ছিল। ১৯২৯ সালে শুরু হয় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা (দ্য গ্রেট রিসেশন)। মিলারের বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। মায়ের ছিল পোশাক তৈরির কারখানা। মোটামুটি সচ্ছল জীবনই চলছিল তাদের। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে মিলারের পরিবার সম্মুখীন হয় নিদারুণ অর্থকষ্টের। কারো হাতেই সেই সময়ে টাকা পয়সা ছিল না। এই জন্যই ঘুরে-ফিরেই মিলারের নাটকে উঠে এসেছে পারিবারিক গল্প। হতাশাগ্রস্ত সময় ও অভাব অনটনের চিত্র। উঠে এসেছে পারিবারিক আবহ ও বাবা-ছেলের মধ্যকার সম্পর্ক চিত্র।এই জন্যই তো মিলার বলেন, আমার নাটকগুলো আসলে আমার আত্মজীবনী।

১৯১৫ সালের ১৭ অক্টোবর নিউইর্য়কে জন্মগ্রহণ করেন আর্থার মিলার। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে অভাবে পড়ে কাজ নেন একটি গুদামে। কিছুদিন কাজ করে টাকা জমান। এরপর ভর্তি হন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই মূলত তার নাটক লেখার হাতেখড়ি।

১৯৪৪ সালে তার প্রথম নাটক ‘দ্য ম্যান হু হ্যাড অল দ্য লাক’ মঞ্চস্থ হয় ব্রডওয়েতে। তবে সফল হননি মিলার।মাত্র চার সপ্তাহ চলার পর মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় তার নাটক। ভীষণ রকম ধাক্কা খান মিলার। এমনকি লেখালেখির প্রতিও যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এর পরবর্তী তিন বছর তিনি আর লেখালেখি করেননি।

১৯৪৭ সালে তিনি লিখেন ‘অল মাই সন্স’ নাটকটি। নাটকটি নিউইয়র্ক ড্রামা ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ডে সেরা নাটকের পুরস্কার পায়।নাটকের আখ্যান গড়ে উঠেছে একটি যুদ্ধাস্ত্র কারখানাকে কেন্দ্র করে। যেখানে ত্রুটিপূর্ণ অস্ত্র তৈরি করা হয়।

১৯৪৯ সাল আর্থার মিলারের জীবনের সবচেয়ে সফলতম সময়। এ বছর মঞ্চে আসে তার সবচেয়ে বিখ্যাত নাটক ‘ডেথ অব এ সেলসম্যান’। পরে এই নাটক থেকে নির্মিত হয়  চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিজ। ১৯৫৩ সালে তিনি রচনা করেন তার অন্যতম রাজনৈতিক নাটক ‘ক্রুসিবল’। নাটকের প্রেক্ষাপট ১৯৫০ দশকের কমিউনিস্টবিরোধী আমেরিকার প্রেক্ষাপট। এই নাটকটিও পরে সেলুলয়েডে নির্মাণ করা হয়। মিলার নিজেই লিখেছিলেন এর চিত্রনাট্য। এই চিত্রনাট্যের জন্য তিনি অস্কার পুরস্কারের নমিনেশন পেয়েছিলেন। আবার এই নাটকের জন্য তাকে কম কাঠখড়ও পোড়াতে হয়নি। কারণ এই নাটককে কেন্দ্র করেই ১৯৫৬ সালে তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। ‘ক্রুসিবল’ নাটকে ধর্মান্ধতা, ব্যক্তি সম্পর্কের টানাপোড়েন, নিজের সত্যিকারের স্বরূপ আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন মিলার। চেষ্টা করেছেন সমকালীন আমেরিকান জীবনের দার্শনিক অনুভূতিকেই ধরতে।

মিলারের নাটকগুলির মধ্যে ডেথ অব এ সেলসম্যান সবচেয়ে সফল ও কালজয়ী। দুই ছেলে আর এক নিম্ন মধ্যবিত্ত বাবার গল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে এই নাটকের আখ্যান। বাবা উইলি লোম্যান একজন বৃদ্ধ দোকানদার। যিনি রাস্তায় ভ্যান নিয়ে ঘুরে ঘুরে পণ্য বিক্রি করেন। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিক্রি খুবই কম। ছেলেরা বুঝতে পারে বাবা আসলে নিদারুণ কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশীর ছেলেটা দারুণ একটা চাকরি পেয়েছে। কিন্তু তারা দুই ভাই অনেক চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারে না। পরে বাবা একদিন সিদ্ধান্ত নেয় যে তিনি ছেলেদের জন্য কিছু করবেন। একদিন ছেলেরা দেখেন, তাদের বাবা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তারা আরো জানতে পারে তার বাবার ইন্স্যুরেন্স করা ছিল। প্রচুর টাকা তাদের হস্তগত হয়। দুই ভাইয়ের বুঝতে বাকি থাকে না, বাবা তাদের সুখের জন্য এক রকম আত্মহত্যাই করেছেন।

১৯৮০ সালে তিনি ‘প্লেইং ফর টাইম’ নামে টিভির জন্য একটি চিত্রনাট্য লেখেন। বর্ণাঢ্য এক জীবন ছিল মিলারের। মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে তিনি বিখ্যাত নাট্যকার কেনেথ রভির কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারা দুজন ছিলেন দুজনের খুব ভাল বন্ধু। মিলার নিজে রক্সবুরিতে একটি স্টুডিও নির্মাণ করেন। সেখানে বসেই মূলত তিনি লিখতেন তার নাটকগুলো। তিনিই বোধহয় একমাত্র নাট্যকার যিনি একাধারে মঞ্চ, রেডিও, সিনেমার জন্য নাটক ও চিত্রনাট্য লিখেছেন অবিরাম।

মিলার বেশিরভাগ মার্কিনীর ‘আমেরিকান ড্রিম’ ধারণার সঙ্গে একমত ছিলেন না। সে কারণে তার সম্পর্কে বলা হতো যে তিনি প্রো কমিউনিস্ট। মিলার নিজে কখনো কমিউনিজমকে আমেরিকার জন্য হুমকি মনে করেননি।

১৯৫৬ সালে হলিউড অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোকে বিয়ে করেন মিলার। ১৯৬১ সালে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। ওই বছর আর্থারের লেখা চিত্রনাট্যে নিজের শেষ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন মনরো। পরে ১৯৬২ সালে নিজের ফ্ল্যাট থেকে মনরোর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৯৬২ সালে মিলার বিয়ে করেন অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত ফটোগ্রাফার ইগনে মোরাথকে। তাদের দুই সন্তান। রেবেকা এবং ড্যানিয়েল। ২০০২ সালে মোরাথ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর এই বিখ্যাত নাট্যকার অনুরক্ত হয়ে পড়েন ৩৪ বছর বয়সী চিত্রশিল্পী এ্যাগনেস বার্লের সঙ্গে।

মিলার যে জীবনকে যাপন করেছেন, কাছ থেকে দেখেছেন তাকেই তিনি তুলে এনেছেন তার লেখায়, তার নাটকে। সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল ছিলেন। এই দায়ভার থেকেই তিনি সমাজের গভীর থেকে তুলে ধরতেন তার রুগ্ন দশাকে।জীবদ্দশায় কমিউনিস্ট ঘেঁষা এবং আমেরিকা বিরোধী বলে অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তিনি কপটতা পছন্দ করেননি। নিজের অভিজ্ঞতা আর মননে তিনি তুলে ধরতেন জাগতিক যাতনার সাতকাহন। হয় তো এই কারণেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল আমেরিকা বিরোধী বলে।

১৯৪৯ সালে ডেথ অব এ সেলসম্যান নাটকের জন্য তিনি পুলিৎজার পুরস্কার জিতে নেন। কিংবদন্তী এই নাট্যকার ২০০৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ অক্টোবর ২০১৭/রুহুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়