ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জাতীয় আইনগত সহায়তা

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২৮ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জাতীয় আইনগত সহায়তা

শাহ মতিন টিপু: এটা অবশ্যই আশাপ্রদ খবর যে, বাংলাদেশের প্রতিটি গরিব সহায়-সম্বলহীন মানুষের আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে আইনগত সহায়তা দিচ্ছে সরকার।

গরিব সহায়-সম্বলহীন মানুষেরা যাতে তাদের আইনি অধিকার ফিরে পেতে পারে সেজন্য গড়ে তোলা হয়েছে জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা। এখন প্রয়োজন এই সংস্থার কাছে আইনি অধিকার হারা সহায়-সম্বলহীন মানুষদের পৌঁছে দেওয়া বা যাওয়ার পথ সুগম করা।

কেবল সে লক্ষেই আজ (২৮ এপ্রিল) ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় শেখ হাসিনার অবদান বিনামূল্যে লিগ্যাল এইডে আইনি সেবাদান’ স্লোগানে সপ্তমবারের মতো দেশে “জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস” পালিত হচ্ছে।

দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণকে সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো সরকার ‘আইন সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ কার্যকরের তারিখ ২৮ এপ্রিলকে 'জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস' ঘোষণা করা হয়।

জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, ‘সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ‘রূপকল্প ২০২১’ ও ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নে সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিচারক, আইনজীবী, এনজিও কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগের ওপর নির্ভর করছে আইনি সহায়তা কার্যক্রমের সফলতা।’

প্রদত্ত বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা মানুষের সমৃদ্ধ ও নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সকল ধরনের ভয়ভীতি ও বৈষম্য দূর করে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি’র অন্যতম লক্ষ্য ‘ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার’ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি।’

জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থার সহকারি পরিচালক (প্রশসান) ও সিনিয়র সহকারি জজ কাজী ইয়াসিন হাবিব জানান- দেশের দরিদ্র ও অস্বচ্ছল জনগোষ্ঠী, শ্রমিক, সহিংসতার শিকার নারী-শিশু এবং পাচারের শিকার মানুষের জন্য আইনি সেবা নিশ্চিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আইন প্রণয়নের মধ্যদিয়ে সরকারী খরচায় আইনগত সহায়তা কার্যক্রম শুরু করে। পরে এই আইনের অধীনে বিভিন্ন বিধি প্রণীত হয়। বিধিতে কারা আইনি সহায়তা পাবেন তা নির্ধারণ করা হয়। দেশের সবক’টি জেলা আদালত, চৌকি আদালত এবং সুপ্রিমকোর্টে লিগ্যাল এইড সার্ভিস চালু রয়েছে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসগুলোকে এখন শুধু আইনি সহায়তা প্রদানের কেন্দ্র হিসেবেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি, মামলা জট কমানোর লক্ষ্যে এ অফিসগুলোকে ‘এডিআর কর্ণার’ বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কেন্দ্রস্থল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পক্ষসমূহের সম্মতির ভিত্তিতে লিগ্যাল এইড অফিসে বিকল্প উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়ে থাকে।

২০১৩ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবসটির প্রথম অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিগ্যাল এইড কল সেন্টার “জাতীয় হেল্পলাইন”-এর উদ্বোধন করেন। এ হেল্পলাইনে ১৬৪৩০ নম্বরে ফোন করে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদানকারী সংস্থার মাধ্যমে জনগণ বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পাচ্ছেন।

অবাক সত্য এই যে, দিবসটি সাত বছরে গড়ালেও সরকার যে বিনামূল্যে দেশের দরিদ্র জনগণকে আইনগত সহায়তা দিচ্ছে- এটা আজো অনেকেই জানেননা ।

অথচ দেশের সুবিধা বঞ্চিত অসচ্ছল দরিদ্র জনগণকে আইনগত সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০ নামক একটি আইনও প্রণয়ন করেছেন। এ লক্ষ্যে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে একটি আইনগত সহায়তা কমিটিও রয়েছে। জেলা কমিটির চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা দায়রা জজ এবং উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটির চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পরিষদের চেয়ারম্যানগণ। দরিদ্র জনগণের মধ্যে বাদি-বিবাদি উভয় এ কার্যক্রমের আওতায় বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা পেতে পারেন, এটাও অনেকের অজানা।

প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি এই আইনগত সহায়তা কারা পাবে?

 

নীতিমালা অনুযায়ী:  যে কোন অসচ্ছল ব্যাক্তি, যার বার্ষিক গড় আয় এক লক্ষ টাকার উর্ধ্বে নয়। কর্মক্ষম নন বা আংশিক কর্মক্ষম, কর্মহীন বা বার্ষিক দেড় লক্ষ টাকার উর্ধ্বে আয় করতে অক্ষম এমন মুক্তিযোদ্ধা। বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন এমন কোন ব্যাক্তি। ভিজিডি কার্ডধারী দুস্থমাতা, পাচারের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ নারী-শিশু, দূর্বৃত্ত দ্বারা এসিডদগ্ধ নারী বা শিশু; ভাতা পাচ্ছেন এমন কোন ব্যাক্তি, আদর্শ গ্রাম বা গুচ্ছগ্রামে গৃহ বা ভূমি বরাদ্দপ্রাপ্ত কোন ব্যাক্তি, বয়স্ক অসচ্ছল বিধবা বা স্বামী পরিত্যাক্তা এবং দুস্থ মহিলা, উপার্জনে অক্ষম ও সহায়-সম্বলহীন প্রতিবন্ধী, আর্থিকভাবে অসচ্ছলতার দরুন আদালতে অধিকার প্রতিষ্ঠা বা আত্নপক্ষ সমর্থন করতে অসমর্থ ব্যাক্তি, বিনা বিচারে আটক ব্যাক্তি, যিনি আত্নপক্ষ সমর্থন করতে অক্ষম, আদালত কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল বলে বিবেচিত ব্যাক্তি, জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল বলে সুপারিশকৃত বা বিবেচিত কোন ব্যাক্তি।

আইনগত সহায়তার আবেদন ফরম কোথায় পাওয়া যাবে?

জেলা জজ কোর্টে অবস্থিত লিগ্যাল এইড অফিসে, কারাগারের কর্মকর্তার নিকট, জেলা আইনজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদকের কার্যালয়ে, জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা ও উপজেলা কার্যালয়ে এবং উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে।

কখন এবং কোন মামলায় সহায়তা মিলবে?

দেওয়ানি, ফৌজদারী, পারিবারিক, জেল আপিলসহ যে কোন মামলা দায়েরের পূর্বে কিংবা চলমান মামলায় মামলার বাদি-বিবাদি, ফরিয়াদি বা আসামি যে কেউ আইনগত সহায়তা পেতে পারেন। বিচারাধীন মামলায় আইন সহায়তার জন্য প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট আদালতকেও অবগত করতে পারবেন।

জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে প্রদত্ত সেবা:

আইনি পরামর্শ প্রদান, আইনি তথ্য প্রদান, মামলার দায়ের এবং প্রতিনিধিত্ব, সরকারি লিগ্যাল এইড তহবিল থেকে ব্যয় বহন করা হয়, সরকারি খরচে মামলা পরিচালনা এবং মামলা দায়েরর জন্য আইনজীবির ফি ও মামলা সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয়ও বহন করা হয়।

লিগ্যাল এইড প্রার্থীদের জন্য সুবিধাদি:

আইনগত সহায়তা প্রার্থীদের জন্য পৃথক সাক্ষাৎকার গ্রহণের ব্যবস্থা। আইনগত সহায়তা প্রার্থীদের জন্য অপেক্ষমান কক্ষ। দুগ্ধপ্রদানকারী মায়ের জন্য পৃথক ব্যবস্থা। সুপেয় পানির ব্যবস্থা।

লিগ্যাল এইড প্রার্থীর জন্য করণীয়:

জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ব্যতীত অন্য কারো নিকট থেকে আইনি পরামর্শ গ্রহণ করবেন না। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার এর পরামর্শ ব্যতিরেকে মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে কোন ব্যাক্তিকে অর্থপ্রদান করবেন না।

জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির অফিস কোথায়?

দেশের প্রতিটি জেলায় জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির অফিস জেলা জজ আদালত ভবনে অবস্থিত। উল্লেখ্য যে, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার প্রধান কার্যালয় ঢাকায় অবস্থিত।

এই আইনটিতে জাতীয় পরিচালনা বোর্ডের সদস্য এবং জেলা কমিটি সমূহের সদস্যের দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্চতা নিশ্চিত করা হয়নি। প্রতিটি কমিটির চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সদস্য পর্যন্ত সবাই ঠিক মতো তাদের দায়িত্ব পালন করছেন কিনা কিংবা দায়িত্বে অবহেলা করছেন তা কিনা তদারকির কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি ।

এই আইনে যদি দায়বদ্ধতা নিশ্চিত না করা হয় তাহলে আইনটি অন্যান্য আইনের মতো নামে মাত্র আইনে পরিণত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কমিটির সদস্যরা সবাই অভিজাত কিংবা উচু শ্রেণীর। যার কারণে তারা দরিদ্র শ্রেণীর সমস্যাগুলোর গভীরতা বুঝতে ব্যর্থ হন বলে প্রতীয়মান হয়। সমাজের অন্যান্য শ্রেণির প্রতিনিধিদেরকেও কমিটিতে স্থান দেয়া উচিত।

জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার জেলা কমিটি আইনী সহায়তার জন্য প্রাপ্ত আবেদন পত্র যাচাই-বাছাই ও গ্রহণ এবং আইনজীবী নিয়োগ করে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে মামলা নিয়মিতভাবে ফলো-আপের কোন ব্যবস্থা নেই।

আবার মামলার খরচ প্রদানসহ অন্য যে কোনো সহায়তা বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তার কোন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। জেলা পর্যায়ে সরকারি আইন সহায়তা তহবিলের মাধ্যমে দায়েরকৃত মামলা সমুহের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো মনিটরিং সেল নেই।

এ আইনের মাধ্যমে বিচার প্রার্থীর পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া সত্বেও, আর্থিক অসামর্থ্যতার কারণে একজন দরিদ্র ব্যক্তির পক্ষে মামলার তারিখে তারিখে হাজিরা প্রদান, স্বাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না বিধায়, একটা সময়ে এসে মামলাগুলো স্থবির হয়ে যায় এবং দরিদ্র মানুষের বিচার প্রাপ্তি অর্থাৎ আইনটির মূল উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্থ হয়।

জেলা পর্যায়ে জেলা কমিটি এবং আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার অফিস কক্ষ আছে। কিন্তু সুর্নিদিষ্ঠ স্টাফ না থাকায় মামলাগুলোর বর্তমান অবস্থার তথ্য জানা যায় না।

এছাড়াও মামলা চলাকালীন বিচার প্রার্থীর সাথে আইনজীবীর মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে; যেমনঃ মামলার তারিখ, স্বাক্ষী, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়ে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে মামলা পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটে এবং নিঃস্ব মানুষটি আরো নিঃস্ব হয়ে যায়। ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি এখনও তেমন সক্রিয় নয় এবং তারা মামলার আবেদন পাঠায় না।




রাইজিংবিডি/ ঢাকা/২৮ এপ্রিল ২০১৯/ টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়