ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জাতীয় সঙ্গীতের বিকৃতি রোধ নাগরিক দায়িত্ব

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৬, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জাতীয় সঙ্গীতের বিকৃতি রোধ নাগরিক দায়িত্ব

হাসান মাহামুদ : ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি শুধু আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসারও এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ। জাতীয় সঙ্গীত বলেই এর আবেদনও অনন্য, মর্যাদাও সর্বোচ্চ। যে কারণে গানটির বাণীতে, সুরে, উচ্চারণে এবং গায়নে শুদ্ধতা ও সোহার্দ্য বজায় রাখা আবশ্যক।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বেশিরভাগ মানুষই; বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার শুদ্ধ ও সঠিক নিয়ম সম্পর্কে অবহিত নন। আবার জাতীয় সঙ্গীতের যথাযথ মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে কিছু কিছু রাষ্ট্রীয় দায়িত্বহীনতা রয়েছে। যে কারণে এর বিকৃতি হতে দেখি আমরা প্রায়ই। এমনকি আশ্চর্যজনক ভাবে সত্য জাতীয় সঙ্গীত কোথায়, কীভাবে, কতটুকু গাইতে বা বাজাতে হবে, সে বিষয়েও অনেকেই জানেন না। এর ফলে সবার অলক্ষ্যেই দেশের প্রতি অবজ্ঞা করা হচ্ছে অহরহ।

আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের বয়স দেশের বয়সের সমান। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ‘স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ তাদের ইশতিহারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করে। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারী বাংলাদেশ সরকার গানটির প্রথম দশ লাইন জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে (মোট চরণ সংখ্যা পঁচিশটি। আজকের এইদিনে (১৯৭২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার করা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির স্বরলিপি বিশ্বভারতী সঙ্গীতবোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশকে জাতীয় সঙ্গীতের কপিরাইট প্রদান করা হয়।

ছয় বছর পর জাতীয় সঙ্গীত বিধিমালা, ১৯৭৮ প্রণয়ন করা হয়। এতে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের কিছু নিয়ম ও বিধি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই সেই বিধিমালার কথা জানি না, নিয়মের কথাও জানি না। যে কারণে অজান্তেই জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ হয়ে যায়। বিধিমালা অনুযায়ী জাতীয় সঙ্গীত উপস্থাপনের কিছু নিয়ম ‍উল্লেখ করা হলে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাবে।

প্রথমত, ২৫ লাইন গানের ১০ লাইনকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাই পুরো গান জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে কখনোই বাজানো বা গাওয়া যাবে না। আবার সব অনুষ্ঠানে পুরো সঙ্গীত বাজানোরও নিয়ম নেই, জাতীয় সঙ্গীতের প্রথম চার লাইন বাজাতে হয়।

২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, সংসদে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে পূর্ণ কর্মসূচির শুরুতে ও শেষে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করতে হয়। তবে এসব দিবসের প্যারেড অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রথম দুটি লাইন বাজানোর নিয়ম রয়েছে।

সব ধরনের জাতীয় দিবসের প্যারেডে জাতীয় সঙ্গীতের প্রথম দু’লাইন বাজানো বাধ্যতামূলক। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শপথগ্রহণ, মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী যখন যে কোন প্যারেডে গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন, তখনও দু’লাইন জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি কোনো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে থাকলে, কোনো বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানকে বাংলাদেশে গার্ড অব অনার প্রদান করা হলে, সিনেমা হলে সিনেমা শুরুতে ও রেডিও-টিভির অনুষ্ঠানের শেষে, রাষ্ট্রীয় শোক দিবস বা এ জাতীয় কোনো অনুষ্ঠানে (মুক্তিযোদ্ধদের দাফনের পূর্বে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা) ইত্যাদি কয়েকটি অনুষ্ঠানে প্রথম দুই লাইন (আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি) বাজানোর নিয়ম রয়েছে।

সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুরো জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী, সব স্কুলে দিনের কার্যক্রম জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হবে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে; ছাত্রছাত্রীরা যেন শৈশবেই জাতীয় সঙ্গীত নির্দিষ্ট সুরে গাওয়া ও এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে। কিন্তু দেশে এখনো বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা নিয়মিত জাতীয় সঙ্গীত বাজায় না বা গায় না।

অনেক অনুষ্ঠানেই দেখা যায়, জাতীয় সঙ্গীতের চার লাইন গাওয়া হয়, বিষয়টি ভুল এবং বিধি অনুযায়ী তা অপরাধ। বিধিতে  বলা হয়েছে, যদি কোনো অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়, তবে তা সবটুকুই (১০ লাইন) গাইতে হবে। আরো অনেক রাষ্ট্রীয় নিয়ম আছে।

এছাড়া বিধিতে বলা হয়েছে, জাতীয় সঙ্গীত শুধু গাইলেই হবে না, তা শুদ্ধ করে গাইতে হবে। আর গাওয়ার সময় এর প্রতি যথাযথ সম্মানও দেখাতে হবে। কিন্তু আমরা প্রায়শই জাতীয় সঙ্গীতের বিকৃতি ও এর প্রতি অবহেলা দেখি। এই তো কয়েকদিন আগেই শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হলো ময়মনসিংহের একটি স্কুলের। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, ১৫ বছর ধরে স্কুলটিতে নাকি জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন হতো না। এর পরিবর্তে মাঝে মধ্যে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করা হতো। অথচ জাতীয় সঙ্গীতের বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক আগেই আদেশ জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

সুপ্রিম কোর্ট থেকেও জাতীয় সঙ্গীতের বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মোবাইল ফোনে রিংটোনে ব্যবহার নিষেধ করা হয়েছে। জাতীয় সঙ্গীত বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করাকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ এই আদালত। বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সঙ্গীতের বিষয়ে কর্মশালারও আয়োজন করা হয়। কিন্তু এতোকিছুর পরও আমরা যেন সবচেয়ে ভালোবাসার গানটাকে সঠিকভাবে গাইছি না।

জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া বা পরিবেশনের ক্ষেত্রেও অনেক বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। অনেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদন করা স্বরলিপি ও সুর অনুসরণ করে জাতীয় সঙ্গীত গান না, অনেকে পারেন না। এর ফলে জাতীয় সঙ্গীত বিকৃত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আবার অনেকে সর্ম্পূণ জাতীয় সঙ্গীত গাইতে পারেন না। যে কেউ মনে করতে পারেন, জাতীয় সঙ্গীত কার মুখস্ত নেই? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যখন জাতীয় সঙ্গীত সমবেতভাবে গাওয়া হয়, তখন কোথায় একটু ছুটে গেলেও আমরা আবার মিলিয়ে ধরি। কিন্তু একা একা একবার চেষ্টা করে দেখুন তো, আপনার পুরো জাতীয় সঙ্গীতটি মুখস্ত আছে কী না?

জাতীয় সঙ্গীত বিধিমালা অনুযায়ী, সিনেমা হলে সিনেমা শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে হবে। নিয়মটি মানা হয়, কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম ছাড়া দেশের অধিকাংশ সিনেমা হলে ক্যারক্যারে আওয়াজ করে তারস্বরে জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠে। সাথে উড়তে থাকে সেই সত্তরের দশকে ধারণ করা বাংলাদেশের পতাকার বিবর্ণ মলিন ভিডিওচিত্র। একপ্রকার ভৌতিকভাবে ‌আচমকা জাতীয় সঙ্গীত শুরু হয়, সেরকম ভৌতিকভাবেই শেষ হয়ে যায়। দর্শকরা ধড়মড়িয়ে দাঁড়ান, শেষে হাঁফ ছেড়ে বেঁচে যাওয়ার ভঙ্গিতে আবার ধড়াম করে সিটের ওপর বসেন।

আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীতের বিশাল একটি সাফল্য রয়েছে। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে ২০৫টি দেশের তুলনামূলক বিচারে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। জাতীয় সঙ্গীত একটি জাতির পরিচয় এবং গৌরবের প্রতীক। জাতীয় সঙ্গীতের সময় দাঁড়িয়ে তার প্রতি সম্মান জানাতে হয়, বিষয়টি অনেকে জানেন না। আর কর্পোরেট সংস্কৃতির আগ্রাসনে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনেও আমরা বিজাতীয় সংস্কৃতিকে ঢুকিয়ে দিয়েছি। অনেকেই জাতীয় সঙ্গীত চলাকালে বিদেশি সংস্কৃতির ছোঁয়ায় বুকে হাত রাখেন। যা একেবারেই অনুচিত।

জাতীয় সঙ্গীতের বিকৃতি ও অবমাননা রোধে কঠোর আইন ও তার বাস্তবায়ন অতীব জরুরী। সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করা হোক জাতীয় সঙ্গীতের বিকৃতি, বন্ধ হোক জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা, জাগ্রত হোক বিবেক। জাতীয় সঙ্গীতকে জানা এবং যথাযথ সম্মান করা প্রত্যেকটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক : সাংবাদিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়