ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জিপিএ-৫ যারা পেলে এবং যারা পাওনি

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০২, ৯ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জিপিএ-৫ যারা পেলে এবং যারা পাওনি

মাছুম বিল্লাহ : আমাদের শিক্ষাক্ষেত্র একযুগ আগের তুলনায় উন্নতি হয়েছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবনতিও ঘটেছে। এই উন্নতি ও অবনতির দোলাচলের মধ্যে দিয়েই চলছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। মূলত শিক্ষা জীবনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় হলো ভীত মজবুত করার উপযুক্ত সময়। এজন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা ও মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রয়োজন দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। এ বিষয়গুলোতে রয়েছে আমাদের প্রচুর ঘাটতি। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই আমাদের পাবলিক পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হয়, যথারীতি ফল প্রকাশ করা হয় কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বিচার, বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা ঠিকমতো হয় না।

এবারের মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত ৬ মে। পাসের হার ৭৭.৭৭ শতাংশ। এই হার ২০১৭ সালের চেয়ে ২.৫৮ শতাংশ কম। গত নয় বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম শিক্ষার্থী পাস করেছে মাধ্যমিকে। ফেল করেছে ৫০,৪৭০ জন শিক্ষার্থী।গতবার পাসের হার ছিল ৮০.৩৫ শতাংশ। তবে এবার গতবারের চেয়ে ৫,৮৬৮ জন বেশি জিপিএ-৫ পেয়েছে। মাধ্যমিকে পাসের হারের উল্লম্ফন শুরু হয়েছিল বহু নির্বাচনী প্রশ্ন চালুর পর থেকে এবং সৃজনশীল চালুর পর সেটিতে হঠাৎ ভাটা পরে গেলেও আবার অবজেকটিভের মতোই পাসের হার বাড়তে থাকে; শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল প্রশ্ন বুঝুক আর নাই বুঝুক। হঠাৎ করে এবার আবার ফলের নিম্নগতি। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষাবোর্ড এই নিম্নগতির জন্য কয়েকটি কারণ নির্ধারণ করেছে। তারা এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ার পেছনে ইংরেজি ও গণিতকে দায়ী করেছেন। এবার এই দুটো বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বেশি ফেল করেছে। এ কারণে সার্বিক পাসের হার কমেছে। এবার ঢাকা বোর্ডে গতবারের চেয়ে ইংরেজিতে ৪ শতাংশ ও গণিতে প্রায় ৩ শতাংশ বেশি ফেল করেছে। যশোর বোর্ডে গতবারের চেয়ে ইংরেজিতে ৬ শতাংশ এবং গণিতে ৪ শতাংশ, চট্টগ্রামে ইংরেজিতে ২ শতাংশ, গণিতে ৩ শতাংশ ফেল করেছে। এবার সবচেয়ে বেশি খারাপ ফল করেছে সিলেট বোর্ড। গতবারের চেয়ে এবার এই বোর্ডে ইংরেজিতে ৫ শতাংশ এবং গণিতে প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি ফেল করেছে। গতবার সিলেট বোর্ডে গণিতে ৯১.১৯ শতাংশ পাস করেছে আর এবার পাস করেছে ৭৬ শতাংশ। দিনাজপুরে বোর্ডেরও একই অবস্থা। পাসের হার কমলেও গত বছরের চেয়ে এ বছর বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে।

এবার ফল পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। মেয়েরা ভালো ফল করেছে। এ দুটোই পজিটিভ দিক। তবে গ্রাম ও শহরের পাসের হার এখন বিস্তর ব্যবধান। এবার শতভাগ পাস করেছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১,৫৭৪টি। যা গতবারের তুলনায় ৬৯২টি কম। শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গতবারের তুলনায় ১৬টি থেকে বেড়ে হয়েছে ১০৯টি। এটি উদ্বেগের বিষয়। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এগিয়ে আছে। মেয়েদের পাসের হার ৭৮.৮৫ শতাংশ এবং ছেলেদের ৭৬.৭১ শতাংশ জিপিএ-৫ পেয়েছে। মানবিকে পাসের হার ৬৯শতাংশ, এটি পুরো ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলেছে। বিষয়ভিত্তিক ফল বিশ্লেষনে দেখা যায় গণিতে এবার সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা। এরপর ইংরেজি।

শহরাঞ্চলে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি আর গ্রামীণ এলাকায় কলা বিভাগের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের এবার পাসের হার ৮০.৪০ যা গতবার ছিল ৫৯.০৩ শতাংশ অর্থাৎ একলাফে ২১.৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি। হঠাৎ করে এক বছরে এই অস্বাভাবাবিক ফল বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ এই ফলের পেছনে বহু ফ্যাক্টর কাজ করে। শিক্ষকের পরিবর্তন, পড়াশোনার পরিবেশের পরিবর্তন, শিক্ষাদানের ধরন, শিক্ষার্থীদের মোটিভেশন, শিক্ষকের মোটিভেশন, প্রশ্নপত্রের পরিবর্তন ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো কোন ধরনের গবেষণা ছাড়াই এতগুলো ফ্যাক্টরকে  প্রভাবিত করে হঠাৎ এক বছরে ফল বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি কিভাবে হলো? এটি যদি এক সিটিংয়ে শুধু খাতা দেখে নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে পরিবর্তন নিয়ে আসার কারণে ঘটে থাকে সেটি কিন্তু বিশাল এক দুর্যোগ বলতে হবে।

বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট গত বছর থেকে নতুন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করেছে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী যেদিন যে বিষয়ের পরীক্ষা শেষ হয়েছে সেদিনই তিনজন প্রধান পরীক্ষককে ডাকা হয় বোর্ডে। তাঁরা ভালো, মধ্যম  ও নিম্ন এই তিন ক্যাটাগরিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন। সেটিকে মডেল হিসেব ধরে ২০জন পরীক্ষকের সঙ্গে বসে সবাই মিলে একটি মডেল উত্তরপত্র নির্ধারণ করা হয়। সে অনুযায়ী লিখলে এক রকম নম্বর, এর চেয়ে ভালো লিখলে বেশি নাম্বার, খারাপ লিখলে কম নাম্বার প্রদান করা হয়। এরপর পরীক্ষকরা খাতা নিতে গেলে ওই মডেল উত্তরপত্র ধরেই মূল্যায়ন করতে বলা হয় তাঁদের। এতে সবাই একটি মানদণ্ড অনুযায়ী নাম্বার দেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন যে, পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের বিশ্লেষণে দেখা গেছে সাধারণভাবে এমসিকিউতে শিক্ষার্থীরা কম নাম্বার পায়। তারা এই আইটেমেই বেশিরভাগ ফেল করে। লিখিত পরীক্ষায় এটি ঘটে না। তার অর্থ আসলে কি? এমসিকিউতে উত্তর সঠিক না হলে নাম্বার দেওয়া যায় না। সঠিক উত্তরে টিক দিতে পারলে নাম্বার পুরোটাই দিতে হয়। না পারলে নাম্বার দেওয়া যায় না। কিন্তু লিখিত অংশে তারা ভালো উত্তর লিখুক আর খারাপ লিখুক, ছোট লিখুক আর বড় লিখুক, প্রাসঙ্গিক লিখুক কিংবা অপ্রাসঙ্গিক লিখুক পরীক্ষকগণ অনেকেই ভালভাবে না দেখে নাম্বার প্রদান করেন, ফলে এই ঘটনা ঘটে। এটিতো সঠিক মূল্যায়ন নয়। তবে, বেডু যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটি যদি ধীরে ধীরে সকল বোর্ডে এবং সর্বত্র সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায় তাহলে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দেশে অনেকটা পরিবর্তন আসতে পারে।

এবারও এসএসসি পরীক্ষায় বহু নির্বাচনী অংশের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। পরীক্ষা বাতিল করার দাবি উঠেছিল কিন্তু করা হয়নি। কারণ বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। বিশ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য পরীক্ষা দ্বিতীয়বার আয়োজন করা চাট্টিখানি কথা নয়। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের পেছনে ছুটতে থাকা মানে নৈতিক শিক্ষার চরম অবক্ষয়ের প্রমাণ। অনেক অভিভাবকগণও এ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তবে এটি করতে গিয়ে লাভের পরিবর্তে খারাপও হয়েছে অনেকের। কারণ সময় নষ্ট ও টেনশনে ছিল তারা। উচ্চ মাধ্যমিকে সরকার কঠোর অবস্থানে থাকায় এ অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে সবাই জিপিএ-৫ পাবে না, সবাই ’এ’ গ্রেড পাবে না,  কেউ কেউ হয়তো প্রচলিত এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণই হবে না। তার অর্থ এই নয় যে, অনুত্তীর্ণদের মধ্যে মেধা নেই। অনুত্তীর্ণ যারা হয়েছে তাদের ভেতরেও রয়েছে অন্য একধরনের মেধা যা প্রচলিত পদ্ধতিতে অবিষ্কৃত হয়নি। তারা জীবনে অন্যভাবে এগিয়ে যাবে, জীবনে শাইন করবে, সমাজে অবদান রাখবে। ফল পাওয়ার পর স্বভাবতই তাদের একটু খারাপ  লাগে। এটি কাটিয়ে ওঠার শক্তিও তাদের আছে। কোন এক প্রশিক্ষণে আমাদের এক দক্ষ এবং নামকরা প্রশিক্ষক বলেছিলেন, তিনি যখন স্কুলে পড়তেন তার রোল নাম্বার ছিল ৮ থেকে ১০এর মধ্যে। তাদের ক্লাসে বরাবর যিনি প্রথম হতেন তিনি কোন কারণে একবার দ্বিতীয় হয়েছিলেন এবং তারপর তিনি তিন সপ্তাহ ধরে ক্লাসেই আসেননি। ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন।উক্ত প্রশিক্ষক ঠিকই বলেছেন, যে ছেলে এত অল্পতে ভেঙে পড়ে, এত নড়বড়ে তিনি কিভাবে জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করবেন, কিভাবে জীবনের চ্যালেঞ্জসসমূহ মোকাবিলা করবেন, কিভাবে দেশ ও সমাজকে সেবা করবেন! এটি কি তাহলে বাস্তবধর্মী শিক্ষা হলো?

যারা ভালো ফল করে তাদের সামনে থাকে  ভিন্ন ধরনের, বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এই ভালো ফলটা ধরে রাখার জন্য তাদের অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। ভালো করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে কিন্তু ভালো না হলে ভেঙে পড়ার তেমন কিছু নেই কারণ জীবনের উন্নতি আলাদা বিষয়। অনেকের পেছনের এই ফল কোন কাজে লাগে না যা আমার অনেক ‘সেলিব্রেটিদের’ জীবন থেকে শিখতে পারি।  প্রচলিত পরীক্ষায় ভালো না করা এমনিক অনুত্তীর্ণ হওয়াটাও অনেক সময় তাদের জীবনের মোড় ঘুড়িযে দেয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে সবাই জিপিএ-৫ এর পেছনে ছোটে। কারণও আছে অবশ্য। জিপিএ-৫ না পেলে তো ভালো কোন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা ভর্তির আবেদনই  করতে পারে না। তাই এই বিষয়টিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। যেমন জিপিএ-৫ এর কথা চিন্তা না করে সাধারণ একটি স্কোরকে মানদণ্ড ধরে দরখাস্ত আহবান করা যেতে পারে। ভর্তি পরীক্ষায় প্রকৃত সৃজনশীল পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করার ব্যবস্থা করলে জিপিএ-৫ এর পেছেন ছুটাছুটি বন্ধ হবে, শিক্ষার্থীরা প্রকৃত ও মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য অনুপ্রাণিত হবে।

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়