ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ঠান্ডা লেগে থাকার কারণ

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঠান্ডা লেগে থাকার কারণ

এখন চলছে শীতকাল। এসময় ঠান্ডা ও ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। ২০০ এরও বেশি ভাইরাস ঠান্ডায় ভোগাতে পারে, কিন্তু সবচেয়ে পরিচিত কালপ্রিট হচ্ছে রাইনোভাইরাস। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঠান্ডা লাগলে তিনটি উপসর্গ দেখা দেয়, যথা- গলা ব্যথা, নাকবদ্ধতা বা নাক থেকে তরল ক্ষরণ ও কাশি। সাধারণত এসব উপসর্গ ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে চলে যায়। কিন্তু উপসর্গগুলো এসময়ের মধ্যে দূর না হলে তা অন্যকিছুর লক্ষণ হতে পারে। এখানে চিকিৎসকেরা দীর্ঘস্থায়ী ঠান্ডার পেছনে যেসব কারণ খুঁজে পেয়েছেন তা আলোচনা করা হলো।

আবার ঠান্ডা লেগেছে : শীতকাল হচ্ছে ঠান্ডার মৌসুম। এসময় ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঠান্ডা লাগা এবং সেই ঠান্ডা থেকে সেরে ওঠা মাত্র আবারও ভাইরাসের কবলে পড়ে নতুনভাবে ঠান্ডা লাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আগের ঠান্ডার উপসর্গ ও নতুন ঠান্ডার উপসর্গে পরপর ভুগতে হচ্ছে বলে মনে হতে পারে যে ঠান্ডা লেগেই আছে। ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে অবস্থিত সিডার্স সিনাই কিরলান-জোবি ইনস্টিটিউটের ফিজিশিয়ান জশুয়া স্কট বলেন, ‘ঠান্ডা লাগানোর জন্য শতশত ভাইরাস রয়েছে। তাই এক বছরে বা একই মাসে একাধিকবার ঠান্ডায় আক্রান্ত হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।’

ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: ঠান্ডার যে উপসর্গ সবশেষে দূর হয় তা হচ্ছে কাশি, কিন্তু আপনার কাশি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চলে না গেলে এটি সম্ভবত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বলেন ক্যালিফোর্নিয়ার ফাউন্টেন ভ্যালিতে অবস্থিত মেমোরিয়াল কেয়ার অরেঞ্জ কোস্ট মেডিক্যাল সেন্টারের ইন্টার্নিস্ট ক্রিস্টিন আর্থার। তিনি আরো বলেন, ‘দীর্ঘস্থায়ী শুষ্ক হাসি হচ্ছে লিসিনোপ্রিল, বিনাজেপ্রিল ও রেমিপ্রিলের মতো এসিই ইনহিবিটরসের সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এগুলো হচ্ছে রক্তচাপের ওষুধ। কিন্তু নাকবদ্ধতা বা নাক থেকে তরল ক্ষরণ, গলা ব্যথা ও সাইনাসে চাপ এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয়। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে আপনার চিকিৎসককে সম্ভব হলে ভিন্ন ওষুধ প্রেসক্রাইব করার জন্য অনুরোধ করতে পারেন।’

ক্রনিক পোস্টনাসাল ড্রেনেজ: আপনার প্রোডাক্টিভ কফ থাকলে, অর্থাৎ কাশির সঙ্গে পরিষ্কার বা সাদা শ্লেষ্মা বের হলে এটি ক্রনিক পোস্টনাসাল ড্রেনেজের কারণে হতে পারে- এ দশা রাতে শোয়া অবস্থায় আরো খারাপ হতে পারে, বলেন ডা. আর্থার। তিনি আরো জানান, ‘পোস্টনাসাল ড্রেনেজে লোকজন প্রায়সময় নাকবদ্ধতার অভিযোগ করেন ও তাদেরকে প্রতিনিয়ত গলা পরিষ্কার করতে হয়। পোস্টনাসাল ড্রেনেজ হচ্ছে ঠান্ডা-পরবর্তী একটি সাধারণ প্রতিক্রিয়া। অ্যালার্জি, আবহাওয়ার পরিবর্তন ও অন্যান্য এক্সটারনাল ফ্যাক্টর দ্বারাও পোস্টনাসাল ড্রেনেজ হতে পারে।’

অ্যালার্জি: নাক থেকে তরল ক্ষরণ ও কাশির অন্যতম কারণ হতে পারে পরিবেশ দ্বারা উদ্দীপ্ত অ্যালার্জি, বলেন ডা. স্কট। অ্যালার্জিও ভাইরাল অসুস্থতার উপসর্গকে নকল করতে পারে। ডা. স্কট আরো বলেন, ‘মৌসুমের ওপর ভিত্তি করে অ্যালার্জিক উপসর্গ দীর্ঘসময় লেগে থাকতে পারে এবং এর সঙ্গে চুলকানি অনুভূত হতে পারে ও চোখ থেকে পানি পড়তে পারে। শীতকাল হলো ঠান্ডার মৌসুম। এসময় যারা বেশি সময় বাইরে অবস্থান করেন তাদের বাইরের অ্যালার্জেন দ্বারা অ্যালার্জিও হতে পারে।’

ব্যাক্টেরিয়াল সাইনুসাইটিস: কখনো কখনো ভাইরাল অসুস্থতার শেষ পর্যায়ে বা নিরাময়ের পর সাইনাসে চাপ, মাথাব্যথা ও জ্বরের মতো নতুন উপসর্গের আবির্ভাব ঘটতে পারে, বলেন ডা. স্কট। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘এমনটা ঘটে, কারণ ঠান্ডা জনিত নাকবদ্ধতা থেকে ব্যাক্টেরিয়ার বংশবিস্তারের জন্য আদর্শ পরিবেশ গড়ে ওঠে। এর ফলে সাইনাস ইনফেকশন হয়ে থাকে। সাধারণত ঠান্ডা লাগার ১০ থেকে ১৪ দিন পর ব্যাক্টেরিয়াল সাইনুসাইটিস হয়ে থাকে। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন প্রয়োজন হয়।’

অ্যাজমা বা সিওপিডি: আপনার কাশির সঙ্গে বুকে বাঁশি বা হুইসেলের মতো শব্দ হলে এবং এসব উপসর্গ লেগে থাকলে ডা. আর্থার অ্যাজমা অথবা ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) থাকতে পারে বলে সতর্ক করছেন। সাধারণত জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে অ্যাজমা ধরা পড়ে, কিন্তু শৈশবের পরিবর্তে প্রাপ্তবয়স্কেও এ রোগ নির্ণীত হতে পারে, জানান ডা. আর্থার। তিনি আরো বলেন, সাধারণত চল্লিশোর্ধ্ব লোকদের মধ্যে সিওপিডি ধরা পড়ে, বিশেষ করে যারা ধূমপানে আসক্ত অথবা এককালে ধূমপান করেছেন। সঠিক ডায়াগনোসিসের জন্য আপনার চিকিৎসক একটি লাং টেস্ট অর্ডার করতে পারেন। বিভিন্ন ধরনের ইনহেলার দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা যায়।’

* নিউমোনিয়া: আপনার প্রতিনিয়ত কাশি হলে এবং এর সঙ্গে বাদামী বা সবুজ শ্লেষ্মা বের হলে, জ্বর আসলে ও শ্বাসকার্যে কষ্ট হলে এটি নিউমোনিয়ার মতো ইনফেকশনের লক্ষণ হতে পারে, বলেন ডা. আর্থার। তিনি আরো বলেন, ‘অধিকাংশ লোক সাধারণত খারাপ অনুভব করেন এবং অভিযোগ জানান যে ফুসফুসে ব্যথা হচ্ছে। অ্যাজমা বা এমফিসেমার মতো দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুস রোগ রয়েছে এমন লোকদের নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বেশি, কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ লোকেরাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।’ আপনার এসব উপসর্গের কোনোটা থাকলে অবিলম্বে মেডিক্যাল সেবা নিন। নিউমোনিয়া হচ্ছে একটি মারাত্মক ও জীবননাশক অসুস্থতা। একারণে এ অসুস্থতায় দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

বায়ুপথে কিছু আটকে থাকা: এটি শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও লোকজনের বায়ুপথে (যেমন- নাক) কিছু একটা আটকে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটি শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সত্য। আপনার বায়ুপথে কিছু আটকে গেলে সর্দির উপসর্গ দেখা দিতে পারে। আটকে থাকা বস্তুটি বের না করা পর্যন্ত অথবা সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে এসব উপসর্গ থাকতে পারে। ডা. স্কট বলেন, ‘সাধারণত এসব উপসর্গের সঙ্গে বাজে গন্ধও থাকে। একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে আটকে থাকা বস্তুটি বের করে আনা।’

যক্ষ্মা: এ মারাত্মক ব্যাক্টেরিয়াল রোগে প্রতিনিয়ত অনিয়ন্ত্রিত কাশি আসে এবং কাশির সঙ্গে রক্ত বের হতে পারে, জ্বর ওঠতে পারে, শরীর ঠান্ডা হতে পারে ও রাতে ঘাম নিঃসরণ হতে পারে। আজকের বিশ্বে যক্ষা বিরল হলেও এখনো কেউ কেউ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ডা. আর্থার বলেন, ‘এ ইনফেকশনটি খুবই ছোঁয়াচে। তাই আপনার ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধের সিস্টেম দুর্বল হলে, দেশের বাইরে বেড়াতে গেলে অথবা যক্ষ্মা রোগীর সংস্পর্শ আসলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার বাড়তি ঝুঁকি রয়েছে। তাই যক্ষার উপসর্গ লক্ষ্য করলে বিলম্ব না করে চিকিৎসক দ্বারা চেক করিয়ে নেয়া উচিত।’

ইমিউনোডেফিশিয়েন্ট: ঠান্ডা লেগে থাকা অন্যতম লক্ষণ হতে পারে যে আপনার শরীরের ডিফেন্স সিস্টেম বা প্রতিরক্ষা তন্ত্র দুর্বল অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মানে হলো, ইনফেকশনের বিরুদ্ধে আপনার শরীরের লড়াই করার ক্ষমতা কমে গেছে, ব্যাখ্যা দেন ডা. বিডাইসি। ডায়েটে প্রয়োজনীয় খাবারের ঘাটতি, অপর্যাপ্ত ঘুম, পানিশূন্যতা, মানসিক চাপ, জিনগত অসুস্থতা, কিছু ওষুধের ব্যবহার ও হিউম্যান ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি ভাইরাসের (এইচআইভি) মতো সিস্টেমিক ইনফেকশন আপনার শরীরের ঠান্ডা নিরাময়ের ক্ষমতা কমাতে পারে। ডা. বিডাইসি বলেন, ‘আপনার ইমিউনোকম্প্রোমাইজড কন্ডিশন থাকলে ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট, বিশ্রাম, তরল পান, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল থেরাপি বা অপকারী অণুজীব ধ্বংসকারক থেরাপি প্রয়োজন হবে।’

ক্যানসার: ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ অথবা প্রেসক্রিপশন ওষুধ খাওয়ার পরও কাশি লেগে থাকলে এবং আপনার ধূমপানের অভ্যাস বা ধূমপানের ইতিহাস থাকলে অথবা অ্যাসবেস্টসের সংস্পর্শে আসলে ক্যানসার রয়েছে কিনা চেক করা উচিত, বলেন ডা. আর্থার। তিনি আরো জানান, ‘সাধারণত এ উপসর্গ সপ্তাহ থেকে অনেক মাস পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে এবং এর সঙ্গে অন্যকোনো উপসর্গ নাও থাকতে পারে। যদিও কিছু লোকের সাধারণ দুর্বলতা, ক্ষুধামান্দ্য, ওজন হ্রাস ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে।’ স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ হিসেবে দীর্ঘস্থায়ী উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা উচিত, এতে ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগ প্রারম্ভিক পর্যায়ে শনাক্ত হতে পারে। এর ফলে অধিক কার্যকরভাবে ক্যানসারের চিকিৎসা করা যায় ও বেঁচে থাকার সময় বৃদ্ধি পায়।


ঢাকা/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়