ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘ডাস্টবিনে জীবিকা খুঁজি’

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ১ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ডাস্টবিনে জীবিকা খুঁজি’

ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা ছুঁই ছুঁই। খুলনা নগরীর ময়লাপোতা বায়তুল আমান মসজিদ সংলগ্ন ষাট গম্বুজ মোড়। পাশেই লাইটপোস্ট লাগোয়া বড় ডাস্টবিন।

আলো-আঁধারির মাঝে ষাটোর্ধ এক ব্যক্তিকে ভ্যান চালিয়ে এসে ওই ডাস্টবিনের পাশেই দাঁড়াতে দেখা গেল। ভ্যান থেকে নেমেই তিনি ডাস্টবিনের ময়লা-আবর্জনার মধ্যে কী যেন খোঁজেন। কাছে গিয়ে এ প্রতিবেদক জানতে চাইলে তার সরল জবাব, ‘ডাস্টবিনের মধ্যেই জীবিকা খুঁজি।’

ওই ব‌্যক্তি জানান, তার নাম মো. আব্দুল মান্নান। বয়স ৬৫। বাড়ি নগরীর রায়েরসহল এলাকায়। তিন সন্তানের জনক। প্রায় দেড় যুগ ধরে তিনি ডাস্টবিন ও রাস্তা থেকে প্লাস্টিকের বোতল, লোহার টুকরা, গরু-ছাগলের হাড়সহ বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

আবর্জনা সংগ্রহের জন্য আব্দুল মান্নানের নিজস্ব ভ্যান আছে। তিন চাকার এ ভ্যানটি কিনেছিলেন মালামাল পরিবহনের জন্য। কিন্তু এখন অন্যের মালামাল পরিবহনের পরিবর্তে ময়লা-আবর্জনা বহনের কাজে ব্যবহার করেন তিনি।

প্রথম দেখাতেই তার ভ্যানের দিকে নজর পড়বে যে কারো। কারণ, ভ্যানটি অনেক রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো। চালকের আসনের ওপর সুদৃশ্য ছাতাও শোভা পায়। ভ্যানের ওপর ও চারপাশে কয়েকটি প্লাস্টিকের বস্তা বাঁধা।

আব্দুল মান্নানের শরীরে ময়লাযুক্ত রেইনকোট, বুক তার খোলা। চুল-দাড়ি এলোমেলো। মাথায় ক্যাপ, গলায় বিশেষ মালা। হাতে রং-বেরংয়ের একাধিক ব্রেসলেট ও আঙুলে আংটি। বেশভুষার কারণে অনেকেই মনে করেন, তিনি হয়ত পাগল।

আব্দুল মান্নান রাইজিংবিডিকে বলেন, লোকে তাকে পাগল ভাবলেও তিনি সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ। প্রায় দেড় যুগ ধরে এভাবেই তিনি নগরীর ডাস্টবিন এবং রাস্তা থেকে মানুষের ফেলে দেয়া প্লাস্টিকের বোতল, লোহার টুকরা, গরু-ছাগলের হাড়সহ বিভিন্ন আবর্জনা সংগ্রহ করেন। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ভাঙারি ব্যবসা’। প্রতিদিন সকালে ভ্যান নিয়ে বের হন। আবর্জনা সংগ্রহ করে রাত ১২টা-১টার সময় বাসায় ফেরেন। সংগ্রহ করা ভাঙারি নগরীর বার্মাশীল রোড, শেরেবাংলা রোড ও বসুপাড়ার বিভিন্ন ভাঙারির দোকানে বিক্রি করেন। রোদ, বৃষ্টি, শীত উপেক্ষা করে কঠোর পরিশ্রমের মাধ‌্যমে দৈনিক ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন।

আব্দুল মান্নান জানান, পাশাপাশি তিনি নিজ বাড়িতে টেইলার্সের (দর্জি) কাজ করেন। যেদিন টেইলার্সের কাজ করেন সেদিন ভাঙারি সংগ্রহ করতে পারেন না। আবার যেদিন ভাঙারি সংগ্রহ করতে বের হন সেদিন টেইলার্সের কাজ করতে পারেন না।

আব্দুল মান্নানের তিন ছেলে আসবাবপত্রের দোকান, মোটর গ্যারেজ ও বাসের সুপার ভাইজারের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তারা সংসারে আর্থিক সহযোগিতা করলেও মান্নান তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চান না।

ডাস্টবিনের প্রচণ্ড দুর্গন্ধে অসুবিধা হয় না? এ প্রশ্নের জবাবে আব্দুল মান্নান বলেন, ‘গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে অভ্যাস হয়ে গেছে, এখন আর সমস্যা হয় না। সব কাজই তো কষ্টের। কষ্ট ছাড়া রুটি-রুজি হয় না।‘

স্থানীয় সংবাদকর্মী মো. নাজমুল হাসান রাইজিংবিডিকে বলেন, প্রায়ই রাত সাড়ে ১১টা-১২টায় অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে দেখা মেলে আব্দুল মান্নানের। তার সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হতো, তিনি পাগল। কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলার পর জানা গেল, তিনি আসলে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ। রুটি-রুজির জন‌্যই বেছে নিয়েছেন এ পেশা। বর্তমান সমাজে যেখানে মাদক ব‌্যবসাসহ নানা অপকর্ম করে অনেক আয় করা যায়, সেখানে কঠোর পরিশ্রম করে আয় করা আব্দুল মান্নান সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

 

খুলনা/মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়