ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

‘তিনটে পেট চালাব কীভাবে’

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০২, ১৮ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘তিনটে পেট চালাব কীভাবে’

নিজ ঘরের সামনে বৃদ্ধ আব্দুর রশিদ হাওলাদার

‘ভিক্ষা করতে পারি না, কারো কাছে হাতও পাততে পারি না, এখন তিনটে পেট চালাব কীভাবে?’ প্রশ্নটি বৃদ্ধ আব্দুর রশিদ হাওলাদারের। তিনি খুলনা মহানগরীর জিন্নাহ পাড়া খালপাড় (জনকল্যাণ স্কুল সংলগ্ন) এলাকার বাসিন্দা।

দুটি ছেলে হারানোর শোক (একজনের মৃত্যু, অপরজন নিখোঁজ) বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। নিজের প্রোস্ট্রেড টিউমার এবং স্ট্রোক করে বিছানায় পড়া স্ত্রীর চিকিৎসা ও ‍ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই তার। তার ওপর নিখোঁজ ছেলের এক সন্তানসহ তিনজনের আহার যোগানোর চিন্তা রশিদ হাওলাদারকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

মাথা গোঁজার জন্য সামান্য ঠাঁই থাকলেও অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্যে মাথার ওপর ছাউনিরও পুরোপুরি ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। জীবন চালাতে একটি মুদি দোকান দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও অর্থের অভাবে তা পারছেন না। জীবনভর কঠোর পরিশ্রম করেও শেষ বয়সে এসে জীবনের কাছে হার মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে দেশের এই বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকের।

বৃদ্ধ আব্দুর রশিদ হাওলাদার রাইজিংবিডির কাছে তার জীবন-সংগ্রামের কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, তিনটে পেট চালানোর জন্য কয়টা ভাত এবং ওষুধ কেনার ব্যবস্থা হলেই কিছুটা স্বস্তি পেতাম।

আব্দুর রশিদ হাওলাদার জানান, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে এবং নাতি-নাতনি নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার। কিন্তু সে সুখ কপালে সয়নি। বড় ছেলে ইলিয়াস হাওলাদার (৪০) ২০১৪ সালে ঢাকায় গিয়ে নিখোঁজ হন। আর সন্ধান পাওয়া যায়নি তার। এখন ওই ছেলের ১৫ বছর বয়সী সন্তানের ভার তারই কাঁধে। ২০১৭ সালে তার ছোট ছেলে মাসুম হাওলাদার (৩৫) যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

বড় ছেলে ইলিয়াসের স্মৃতি আওড়াতে গিয়ে বৃদ্ধ আব্দুর রশিদ জানান, ছেলেটি ভ্যানে করে খুলনার বিভিন্ন স্কুলের ছেলে-মেয়েদের আনা-নেয়ার কাজ করত। এতে তার সংসার ঠিকমতো না চলায় ২০১৪ সালের দিকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় চলে যায় কাজের সন্ধানে। সেখানে জিনজিরা এলাকায় একটি কাঁচামালের আড়তে কাজ নেয়। তারও কয়েকদিন পর তাকে (বাবাকে) ফোন করে জানায়, ‘আব্বা আমি ১০ হাজার টাকা মাসিক বেতনে একটি জাহাজে চাকরি নিছি। কিন্তু আমার ভয় লাগে- জাহাজে ব্লাকের (চোরাচালান) মাল আছে।’ এটিই তার শেষ কথা। তারপর থেকে ছেলের কণ্ঠ আর শুনতে পাননি তিনি। অনেক খুঁজেও মেলেনি তার সন্ধান। বেঁচে আছে কি না তাও জানেন না।

দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বৃদ্ধ আব্দুর রশিদ বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে জীবন-সংগ্রাম। খুলনা শিপইয়ার্ড, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি ও ইস্পাহানি মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছি। জীবনের প্রয়োজনে রিকশা-ভ্যান চালিয়েছি, গাছের চারা বিক্রি করেছি। এখন শরীরে আর আগের মতো শক্তি নাই। তাই কোনো কাজ আর করতে পারি না।’

তিনি জানান, নিজে দীর্ঘ আট বছর ধরে প্রোস্ট্রেড টিউমারে ভুগছেন। চিকিৎসক অপারেশন করাতে বললেও অর্থের অভাবে তা পারেননি। প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০-৫০ টাকার ওষুধ কেনার প্রয়োজন হলেও তার সামর্থ নেই। তার স্ত্রী স্ট্রোক করেছেন। তারও প্রতিদিন অনেক টাকার ওষুধ দরকার। সামান্য ত্রাণ পেলেও তা শেষ হয়ে গেছে।

আব্দুর রশিদের প্রতিবেশী খুলনা আলিয়া কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মুফতি আব্দুর রাজ্জাক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বৃদ্ধ আব্দুর রশিদ আসলেই খুব অসহায় জীবনযাপন করছেন। ঘরে খাবার নেই, মাথার ওপর ছাউনি নেই। উপার্জনও করতে পারেন না।’

স্থানীয় ৩১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফ হোসেন মিঠু রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আব্দুর রশিদকে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘরের জন্য অর্থ বরাদ্দ নেই। বরাদ্দ পেলে চেষ্টা করা হবে।’


খুলনা/নূরুজ্জামান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়