ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

তৃতীয় পর্ব || টোকিও ঘ্রাণ

শাকুর মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ২৯ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তৃতীয় পর্ব || টোকিও ঘ্রাণ

অচেনা শহরে নেমেই প্রথম বন্ধুত্ব হয় এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে আসার পথে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে। এবার এখানে সেই সুযোগ ছিলো না, আমরা এসেছি বাসে। পরদিন সকালবেলা আরেকটি বাস আমাদের নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল কনফারেন্সের ভেন্যুতে। সাড়ে সাতটা থেকে বাস চলেছে, শেষ বাস যখন ছাড়ে তখন জাপানের সময় সকাল সাড়ে আটটা। আমাদের শরীরঘড়িতে তখনো বাংলাদেশের টাইম, ভোর সাড়ে পাঁচটা, সুতরাং আমাদের অনেকেই কোনমতে তাড়াহুড়ো করে দশটার পাঁচ মিনিট আগে রেস্টুরেন্টে পৌঁছে নাস্তাটা ধরেছিলো বটে, বাস পায় নি। দেরী যখন হয়েই গেলো, আমরা পাঁচজন ঠিক করলাম ট্যাক্সি করেই যাই। হোটেল থেকে ৫ মাইল দূরের মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৫ মিনিটে আমাদের নিয়ে যাবে। হোটেলের লবির বাইরে ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে দাঁড়াতেই একটা ট্যাক্সি এসে হাজির, ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে যাবার পর ওটোমেটিক বাম দিকের একটা দরোজা খুলে যায় এবং আমরা হুড়মুড় করে উঠে বসে পড়ি। সামনে আমিই বসি, আমার হাতে ক্যামেরা, পেছনে ৪ জন। ট্যাক্সির দরোজা লাগানো হয় না। ট্যাক্সিওয়ালা কী যেন বলে, আমরা বুঝি না। হোটেলের এক স্টাফ আমাদের উদ্ধার করেন। বলেন, জাপানে ট্যাক্সিতে পাঁচজনের বেশি বসা যাবে না। বাচ্চা শিশু হলেও না। পাঁচজন মানে পাঁচজন- নড়চড় নাই

জাপানে কাপকাপ চলে না। এটা এখন যেমন জানি, রবীন্দ্রনাথের আমলেও ছিল, সেই ১৯১৬-তেও। সুতরাং আমাদের দুজন নেমে গিয়ে অপর ট্যাক্সি ধরলে ওটোমেটিক দরোজা আবার বন্ধ হয়। আমাদের এবার জিজ্ঞাস করা হলো কিছু একটা। আমরা বলি, মেইজি ইউনিভার্সিটি।

তিনি ট্যাক্সিতে রাখা জিপিএস টেপাটিপি করে গাড়ি ছেড়ে দেন। আমরা টোকিও দেখতে শুরু করি।

আমরা যে শহরকে টোকিও নামে ডাকি, জাপানিরা তাকে বলে ‘তৌক্যৌ’। পূর্ব এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র জাপানের বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। সরকারিভাবে এটি তৌকিঔ-তো অর্থাৎ টোকিও মহানগরী নামে পরিচিত। জাপানের ৪৭টি জেলার একটি এই টোকিও বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলির একটি। আয়তনে ঢাকা থেকে প্রায় ৫০ বর্গমাইল কম। প্রায় ৪ হাজার বছর আগে থেকেই এখানে মানুষের বসতি ছিল। এর নাম ছিলো ‘এদো’। কিন্তু তখন ছিলো এটি নিখাঁদ একটি জেলেপাড়া। রবীন্দ্রনাথের যখন ৭ বছর বয়স, ১৮৬৮ সালে কিয়োতো শহর থেকে তোকুগাওয়া রাজবংশ (১৬০৩-১৮৬৭) ক্ষমতাচ্যুত হয়, শোগুনাতের পতন ঘটে এবং সাম্রাজ্যের রাজধানীকে এদোতে সরিয়ে নেয়া হয়। ঐ বছরেই শহরটির আদি নাম এদো থেকে বদলে টোকিও রাখা হয়। টোকিও শব্দের অর্থ পূর্বদিকের রাজধানী। টোকিওতে নাম বদল হবার আগেই ১৭শ শতক থেকেই এদো জাপানের বৃহত্তম শহর ছিল। ১৯শ শতকের শেষে এসে শহরটির জনসংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এখন এ শহরে ১ কোটি ৩০ লাখ লোকের বাস, যাদের অর্ধেক সব সময় মাটির নিচে থাকে। ঘন বসতির এই শহরে যে পরিমান লোকের মাটির উপরে থাকার কথা, তা নেই বলে এই ভর দুপুরেও রাস্তাঘাট যথেষ্ট ফাঁকা। ট্রাফিক সিগনাল খুব পড়ার সুযোগ নাই। যেখানেই রাস্তার ক্রসিং সেখানেই ফ্লাইওভার।

মিনিটপাঁচেক গাড়ি চলার পর একটা খানদানী ট্যুরিস্ট স্পট আমাদের চোখে পড়ে। খোকন ভাই নিশ্চিত হয়ে বলেন, এটাই সেই রাজবাড়ী। জাপানের রাজা এই বাড়িতেই থাকেন। কিয়োতো থেকে এসে ১৮৬৮ সাল থেকে এখানেই রাজত্ব করছেন।

আকা-১৮র অভ্যর্থনাকারী

জাপানে কি তাহলে রাজাদের সামন্ত শাসন এখনো আছে? এই প্রশ্ন করা যেত আমাদের ড্রাইভারকে। এরকম পর্যটনবান্ধব শহরের যেকোন ক্যাব ড্রাইভারই অর্ধেক ট্যুর গাইডের কাজ করে ফেলেন, কিন্তু এখানে তিনি নীরব। এক দুই কথা বলে বুঝে ফেলেছি, থ্যাঙ্ক ইউ ছাড়া আর কোনো ইংরেজি শব্দ তিনি জানেন না। তবে আমরা যতটুকু জানি, তা হলো জাপান সরকার একটি সংসদীয় রাজতন্ত্র, অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় সম্রাটের ক্ষমতা মূলত আনুষ্ঠানিক । ১৯৪৭ সাল থেকে এভাবেই জাপান শাসিত হচ্ছে। সরকার চালানোর প্রকৃত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর অধীনস্থ মন্ত্রীদের দ্বারা পরিচালিত ক্যাবিনেটের হাতে অর্পিত। ক্যাবিনেট দেশের শাসন বিভাগের সমস্ত ক্ষমতার উৎস। জাতীয় সংসদ প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচন করে এবং তাঁকে তাঁর পদে নিয়োগ করেন সম্রাট। এই সম্রাটের ক্ষমতা নাই রাষ্ট্র পরিচালনার, কিন্তু সম্মান আছে। জাপানের লোকেরা তাঁদের রাজাকে খুব মানে। বর্তমানে যে রাজা এই বাড়িতে থাকেন তাঁর বয়স হয়ে গেছে অনেক, এ ছাড়া তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত। রাজকার্য তাঁর ভালো লাগছে না। তিনি রাজত্ব ছেড়ে দিতে চান। কিন্তু ছাড়ার উপায় নাই। রাজা হবার নিয়ম আছে কেতাবে, রাজাগিরি ছেড়ে দেবার নিয়ম লেখা হয়নি। যিনি প্রথম লিখিয়ে ছিলেন- আমৃত্যু রাজা রাজাই থাকবেন। তিনি মরে গেলে তাঁর বড় ছেলে রাজা হবে এবং আমৃত্যু রাজা থাকবে। রাজার কোনো মেয়ে রাজা হতে পারবে না। পুত্র সন্তান না থাকলে ভাইদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড় সে হবে রাজা। কিন্তু এই রাজার তাঁর ষাটোর্ধ পুত্রকে রাজা বানিয়ে নিজে অবসরে যেতে চান বলে সংসদে নতুন আইন পাস করিয়েছেন, এটা পাস হলে তিনি রাজমুকুট পরিয়ে দেবেন তাঁর পুত্রকে।

আমার খুব ইচ্ছা করে ভেতরে গিয়ে এই রাজাকে দেখে আসি। শুনি, এই রাজবাড়ির একেবারে ভেতরে যাওয়া যাবে না, এখানে রাজা থাকেন। কিন্তু এরচেয়ে অভিজাত রাজবাড়ি, রাজার ঘর আছে কিয়োতোতে। সেখানে রাজা থাকেন না, দেড়শো বছর আগে সেই রাজবাড়ি শূন্য হয়ে গিয়েছিল, কিয়োতোতে গিয়ে সেটা দেখে আসব। আমাদের ট্যাক্সি চলে আসে মেইজি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছাকাছি। মিটারে ভাড়া ওঠে ২১০০ ইয়েন। টোকিওর ট্যাক্সি ভাড়ার হিসাব জেনে গেছি। গাড়িতে উঠলেই ৪৮০ ইয়েন উঠে যায়, এটা প্রথম ২ কিলোমিটারের ভাড়া। এরপর প্রতি ২৫০ মিটারে ভাড়া উঠে ৯০ ইয়েন করে, তরতর করে বাড়তে থাকে মিটার। ট্রাফিক সিগনালে আটকা পড়লেও হালকা হয়ে মিটার বাড়ে। মেইজি বিশ্ববিদ্যালয় সাইন দেখেই আমাদের ট্যাক্সি থেকে নামতে বলা হলো, ভাড়া দেখালো ২০০০ ইয়েন। নামার আগে মনে হলো গেটটা আরো ২০ গজ দূরে। ট্যাক্সিওয়ালাকে সেটা বলাতে নামিয়ে দিলো গেটের কাছেই, কিন্তু ততোক্ষণে মিটার বেড়ে উঠে গেছে ২১০০ ইয়েনে। ভাড়া নিয়ে দরাদরি করার সুযোগ নাই। পকেটে ক্যাশ না থাকলে ক্রেডিট কার্ডে ভাড়া দেয়া যায়। এই হলো টোকিও ট্যাক্সির অবস্থা। তারপরও ৩৫ হাজার ট্যাক্সি এই শহরে প্রতিদিন চলে। একজন ট্যাক্সি চালক বছরে ৪০ হাজার ডলারের মতো বেতন পেয়ে থাকেন।

ট্যাক্সি থেকে নেমেই দেখি ACA-18 প্ল্যাকার্ড হাতে এক প্রৌঢ়া হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। কাল থেকে এশিয়ার ২১টি দেশ থেকে আসা প্রায় আড়াইশো নিবন্ধিত স্থপতিদের তিন দিনের মেলা বসবে এই খানদানী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। আজ অনানুষ্ঠানিক পরিচয়পর্ব। আমরা মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়ি।

মেইজি বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণেই টোকিওর বিখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৮৬৮ সালে মেইজি রাজবংশ এই টোকিওতে তাঁদের রাজত্ব শুরু করার বছরকয়েক পরেই, ১৮৮১ সালে এখানে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। আদিকালে এর কী রূপ ছিল তার ছবি দেখেছি। দুই পাশে কাঠের দুই পিলার, উপরে আড়াআড়ি আরেকটা কাঠ। এই নিয়ে ছিলো তার গেট, ভেতরে কাঠের একতলা ঘর, টালির ছাদ। সেই রূপ ভেঙে এখন এটা সুউচ্চ দালান। ৪টা টাওয়ার, লিফট এস্কেলেটরে ছড়ানো তাঁর চত্বর। ৩২ হাজার ছাত্রছাত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কিন্তু চলাচলের যে বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে তাতে কোথাও ধাক্কাধাক্কির সুযোগ নাই।

সেমিনারের স্যুভেনির আর কিট বিতরণ করছে এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। এখানে জাপান স্থপতি ইনস্টিটিউটের কাওকে নাক গলাতে দেখি না। নিজের পাসপোর্ট দেখিয়ে দেয়ার পরই কোনো কথা না বলে ভারি একটা কালো রঙের ব্যাগ ধরিয়ে দেন আমাদের হাতে। এখানে সেমিনারের যাবতীয় বিষয়সহ জাপানের কোথায় কী আছে, কীভাবে যেতে হবে তার স্যুভেনির রয়েছে। এগুলো হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরির দরকার নাই। বেলা দেড়টা থেকে তারা আমাদের বাস আর ফেরিতে করে সড়ক ও নদী পথে টোকিও দেখাবে। আমরা বসে থাকব, যেতে যেতে তারা গল্প শোনাবে। কিন্তু তারপরও আমরা বলি, এগুলো এখানে থাক, ফিরে এসে যাবার সময় নিয়ে যাব। হাতে আমাদের ৩০ মিনিটের মতো সময়। ক্যাম্পাসের একটু বাইরে একটা সিঁড়ির উপর, গাছের তলায় এসে বসে পড়ি কয়েকজন। অনেকের সিগারেটের খুব তেষ্টা পেয়েছে। সিগারেট খাওয়ার মতো জায়গা পাচ্ছে না। খোলা জায়গা দেখে যেই না কেউ একজন সিগারেট ধরিয়ে বসল, অমনি ভেতর থেকে সেই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের এক তরুণী এসে বলল, এখানে কি কেউ সিগারেট খাচ্ছেন?

মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কপথ

এর মধ্যে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে সিগারেট। তিনি বললেন, না তো!

তরুণী বলল, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আমাকে বলা হয়েছিলো এখানে কেউ সিগারেট খাচ্ছেন। যাই হোক, যদি কেউ সিগারেট খেতে চান, তাহলে ঐ বিল্ডিংয়ের নয় তালায় সিগারেট খাওয়ার ঘর আছে সেখানে চলে যেতে পারেন। এটুকু বলেই তরুণী চলে গেলো।

আমাদের সামনে দিয়ে বাঙালি চেহারার এক ভদ্রলোককে চলে যেতে দেখে থামালাম। তাঁর নাম বাচ্চু ভাই। ৩২ বছর ধরে জাপানে আছেন, ব্যবসা করেন। তিনি আমাদের নাসির ভাইয়ের বন্ধু। দেখা করতে এসেছিলেন নাসির ভাইয়ের সাথে। চলে যাচ্ছিলেন। আমাদের দেখে পথ ঘুরে এসে দাঁড়ালেন। আমরা তাকে নিয়ে আড্ডায় বসে পড়ি। বাচ্চু ভাই বললেন, জাপানে ঘরের মধে সিগারেট খেতে হয়, বাইরে না। এখানে পাবলিক প্লেসে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। ধরা পড়লে ৫ হাজার ইয়েন তাৎক্ষণিক জরিমানা। ট্রেনে বাসে দূরের কথা, রাস্তায় বা পার্কেও সিগারেট খাওয়া যাবে না। যেখানে সিগারেট বিক্রি হয় তাঁর কাছাকাছি জায়গায় সিগারেট খাওয়ার ছোট্ট জায়গা থাকে, সেখানে খেয়ে যেতে হবে। সিগারেটের এশট্রে আর কোথাও পাবেন না। জাপানের রাস্তা ঘাটে বা পার্কের কোথাও ডাস্টবিন দেখবেন না। ময়লা ফেলার কোনো ঝুড়ি তারা কোথাও রাখে না, কারণ ময়লা কেউ কোথাও ক্যারি করে না।

এই বলে নিজের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটের মতো একটা ছাইদানী বের করে দেখান। বলেন, এ রকম মোবাইল ডাস্টবিন আমরা ক্যারি করি। চিপাচাপা পেলে কোথাও দাঁড়িয়ে সিগারেট খেয়ে ফেলি আমি নিজেও, কিন্তু ছাই তো আর ঘাসের উপর ফেলতে পারি না। এজন্য এটা রাখি।

জিজ্ঞেস করি, ভাই, আপনি তো জাপানে ব্যবসা করছেন, জাপানে বসে ব্যবসা করতে কেমন লাগে, জাপানিদের সাথে?

মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বাংলাদেশি স্থপতিদের আড্ডা

মজা করে তাকালেন বাচ্চু ভাই। বলেন, এখানে ব্যবসার আরাম একটাই, এখানে ব্যবসা করতে মিথ্যা কথা বলা লাগে না, জাপানিরা মিথ্যা কথা কী জিনিস জানে না- সবচেয়ে আরাম এটা।

বাচ্চু ভাইয়ের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলা হয় না। আমাদের ডাক আসে। বাস রেডি হয়ে আছে । এই বাসে করে আমাদের টোকিও শহর দেখানো হবে। আমরা উঠে পড়ি। (চলবে)

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুন ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়