ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ত্যাগ : বিদ্রোহী আত্মার প্রতিধ্বনি || মনি হায়দার

মনি হায়দার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১০, ৮ মে ২০১৫   আপডেট: ১৬:০০, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০
ত্যাগ : বিদ্রোহী আত্মার প্রতিধ্বনি || মনি হায়দার

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

নতুন করে লিখবার কিছু নেই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বাংলা ছোটগল্পের প্রথম মুক্তিদাতা। তাঁর হাতেই বাংলা ভাষার ছোটগল্প প্রাণ পেয়েছে। তিনিই গল্পের কাঠামোতে সৃজনের লাবণ্য, কল্পনার বিস্তার, আধুনিকতার স্পর্শ দিয়ে তুঙ্গে তুলে দিয়েছেন। তাঁর দেখানো পথে এখনও বাংলা ছোটগল্প পরিভ্রমণ করছে। বাংলা ছোটগল্পের উপর রবীন্দ্রনাথ রাহুর প্রবল বিস্তার করে আছেন। তিনি তাঁর সময় অতিক্রম করেও চিরকাল ছুঁয়ে আছেন গল্পের আখ্যানে, ভূগোলে, জ্যামিতিতে, চৈতন্যে, বিরহে, প্রেমে, নারীর অধিকারে, মানুষত্বে, মহত্বে, নির্মমতায়, বিলাসিতায়... আরও কতো কতো যোজনায়।

রবীন্দ্রনাথের ছোট বড় নানা মাত্রিকতার পঁচানব্বইটি গল্পের ভেতরে আমরা মাত্র কয়েকটি গল্প সর্ম্পকে বলি, আলোচনা করি, ব্যাখা ও বিশ্লেষণ করি।  বাকিগল্পগুলো থেকে যাচ্ছে আলোচনার বাইরে। মনে হয় এগুলো বরীন্দ্রনাথের অনাথ বা আশ্রয়হীন গল্প। আমরা চেষ্টা করবো সেই গল্পগুলোকে আশ্রয়হীনের জায়গা থেকে সরিয়ে এনে পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে, নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত করতে।
‘ত্যাগ’ রবীন্দ্রনাথের সেই রকম একটি অনাথ বা আশ্রয়হীন গল্প। ‘ত্যাগ’ শব্দটা উচ্চারণ বা লেখার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝতে পারি,  ত্যাগ করার অর্থ। কিন্তু বুঝলেই তো হয় না, ত্যাগের রয়েছে নানা মাত্রিকতা। গল্পকার কোন গুড়ার্থ করোটির ভেতর রেখে ‘ত্যাগ’ গল্প লিখেছেন, সেটা আগে বুঝতে হবে। বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গল্পের আখ্যান অনুধাবন করার জন্য শুরুতেই মাথায় রাখতে হবে, তাঁর সময়। আমরা প্রায় একশ বছর পর রবীন্দ্রনাথের গল্পের জমিনে প্রবেশ করছি। সেই সময় এবং এই সময়- দুই সময়ের ব্যবধান অনেক। অনেক কিছুরই মিল নেই, অনেক কিছুই জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু একটা জিনিস মানুষের জীবন থেকে হারিয়ে যায়নি। এবং হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও কম। হয়তো যাবেই না, বরং যতদিন যাবে জিনিসটা বা প্রথাটা মানুষের মগজ দখল করে নেবে। জিনিসটা হচ্ছে ধর্ম। ধর্ম চিরকালের অপ্রতিরোধ্য এক প্রথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ত্যাগ’ গল্পে মানুষ ও ধার্মিকের  অন্তঃপরিচয় নিবিড়ভাবে এঁকেছেন এবং মানুষের পক্ষে আশ্চর্য সাহস ও শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন।

গল্পের পটভূমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়েছেন গ্রাম ও কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে। হেমন্ত তরুণ। ভালোবেসে বিয়ে করেছে কুসুমকে। কুমুম অসামান্য সুন্দরী। কিন্তু ঘটনাটা গল্প হয়ে ওঠার সূত্রপাত তৈরী হয়েছিল আরও আগে। সেই আগের সূত্র ধরে আমাদের কাছে এসে দাঁড়ায় প্যারিশংকর নামের এক প্রতিবেশী। যে প্রতিবেশী ছিল হেমন্তদের। হেমন্তর বাবা হরিহর ছিল গ্রামের মহাজন বা মোড়ল। প্যারিশংকরের মেয়ের জামাই বৌয়ের অলংকার চুরি করে বিলেত যায়। পাঁচ বছর পরে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরলে, প্যারিশংকর জামাইকে ঘরে তুলে নিতে চাইলে হেমন্তের বাবা হরিহর প্রবল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, জাত ও ধর্মের নামে।
প্যারিশংকর কন্যার পিতা। কন্যার সুখের জন্য নিজের সন্মান বিসর্জন দিয়ে হলেও হরিহরের হাতে পায়ে ধরে মিনতি জানায়, ‘দাদা, এ যাত্রা তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি ছেলেটিকে গোবর খাওয়াইয়া প্রায়চিত্ত করাইতেছি, তোমরা তাহাকে জাতি তুলিয়া লও।’

এই লাইনটির ভেতরে গল্পকার সেইকালের সমাজের এক মর্মান্তিক ছবি উপস্থাপন করেছেন। সেই ব্রিটিশরা শাসন করছে উপমহাদেশ। ইংরেজদের শাসনে হিন্দু সমাজ আলোড়িত। কিন্তু তারপরও যদি কোনো হিন্দু ব্রিটেন যেতো , তার জাত চলে যেতো। ব্রিটেনপ্রবাসী হিন্দুর কোনো জাত বা ধর্ম থাকে না। বিপরীত দৃশ্যে দেখি, সেই হিন্দুরাই মোক্ষ লাভ করেছিল ব্রিটিশ বেনিয়াদের কাছ থেকে। গোটা সমাজ ব্যবস্থা চলছিল উল্টো রথে। একজন মানুষ বিদেশে গেলে তার ধর্ম যাবে কেন? জাত যাবে কেন? জাত বা ধর্ম এতোই সহজ? কিন্তু সেকালের সমাজ এভাবেই আবদ্ধ ছিল সমাজের সীমাবদ্ধ আয়তক্ষেত্রের সীমানায়।
আমরা গল্পের কাছে ফিরে যাই। হরিহর স্বাভাবিক দাম্ভিকতায় প্যারিশংকরের দাবি বা কাকুতি-মিনতি ভূতলে পিষ্ঠ করে। কিন্তু প্যারিশংকরও তো মানুষ। মানুষ মাত্রই ক্রোধ, প্রতিশোধ স্পৃহায় প্রবল তাড়িত  প্রাণী। সমাজ, ধর্ম ও জাতের কারণে যখন নিজের কন্যার সঙ্গে জামাতার মিলন ঘটাতে পারলো না গ্রামে, প্যারিশংকর কন্যা নিয়ে চলে এলো কলকাতায়। কলকাতা মহানগরী, বিপুল মানুষের পদভারে কম্পিত কলকাতায় তিনি কন্যা ও জামাতা নিয়ে মিশে গেলেন। কিন্ত প্রাণের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকলো। গল্পের কারিকর যখন রবীন্দ্রনাথ, তখন সেই আগুনের লকলকে জিহ্বা  সকল প্রকাশ অঙ্গিকার নিয়ে সামনে এগুবে এটাই তো স্বাভাবিক।

না। প্যারিশংকরকে  বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। শীঘ্রই প্যারিশংকর হাতের মধ্যে মোক্ষম অস্ত্র পেল। কেবল ‘পেল’ বলাটাই যথেষ্ট হবে না। প্যারিশংকরকে একটু কূটচালও চালতে হয়েছে। একটা গল্পের যথার্থ পরিণতি, সুষ্ঠু প্রয়োগ, সমাজ সুলুকের সন্ধান দিতে হলে  গল্পের অন্যতম টার্নিং চরিত্র প্যারিশংকরকে অবশ্যই একটা আঙুল বাঁকা করতে হবে। প্যারিশংকর কেবল সেটাই করার জন্য দাবার ঘুটি চাললো। ঘুটি হলো নির্দোষ দুটি মানুষ। প্রথম মানুষ হরিহরের ছেলে হেমন্ত। আর দূরের একটি মেয়ে- কুসুম। নিজের অজান্তেই একটি প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের মধ্যে নিপতিত হলো। জগতে এটাই নিয়ম, রাজার ভোগের জন্য সাধারণ কৃষকের প্রাণ যাবে, তাতে কৃষকের কষ্ট হয়, রাজার কি? তিনি তো রাজা। রাজভোগের জন্য প্রজার জীবন যৌবন উৎসর্গ করার প্রথা সেই সূর্যের প্রথম দিন থেকে ঘটে আসছে। সেখানে গল্পের প্রয়োজনে প্যারিশংকরের মতো নামী-দামী মানুষ একজন সামান্য কুসুমকে ব্যবহার করবে, তাতে সমাজ বা রাষ্ট্রের কি এসে যায়?

এবার আমরা কুসুমের সন্ধানে যাই। কুসুম বাল্য বিধবা এক মেয়ে কিন্তু খুব সুন্দরী। থাকে প্যারিমোহনের বাসার কাছে  বিপ্রদাস চাটুজ্জের বাড়ি। সেই সামনের বাড়িতে থাকতো গল্পের নায়ক হরিহরের পুত্র হেমন্ত। দুজনের দেখা ছাদে। একটা অলিখিত সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রেমের। বিপ্রদাস চাটুজ্জে মেয়েটিকে নিয়ে কী করবে ভেবে পান না। এই সময়ে কাণ্ডারি হয়ে এলো গল্পের গোদা- প্যারিশংকর।  প্যারিশংকর ভালো মানুষের মোহনীয় রূপে দাঁড়ায় বিপ্রদাসের সামনে ত্রাতা হয়ে। বিপ্রদাস তীর্থে চলে যায় আর কুসুমকে রেখে দেয় প্যারিশংকর। ঘটনাটাকে আরও একটু ঘোট পাকাতে প্যারিশংকর  মেয়েটিকে নিয়ে রাখে তার এক পরিচিত প্রতিবেশী শ্রীপতি চাটুজ্জের বাড়ি। সে বাড়িতে কুসুমকে রেখে আড়ালে বসে নিজের পরিকল্পিত ঘুড়ি মেলে দেয় আকাশে।

কুসুমের প্রেমে বিধস্ত  হেমন্ত। বাধ্য হয়ে হেমন্তের বাবা ছেলের বিয়ে দিলো শ্রীপতির মেয়ে কুসুমের সঙ্গে। আড়ালে বসে কুটিল হাসির ছড়রা খেললো প্যারিশংকর।  নিজের নিষ্ঠুর প্রতিশোধ স্পৃহাকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার জন্য কুসুমের মতো একটি অনাথ মেয়েকে ঘুটির মতো ব্যবহার করেছে। বিয়ের পর যখন সব জানবে হরিহর, মেয়েটিকে কি আর রাখবে? অনাথ মেয়েটি আবার রাস্তায় নেমে আসবে। প্যারিশংকরের মতো কিছু চরিত্র সভ্যতার প্রথম দিন থেকে সমাজে সংসারে আছে, নিশব্দ কুকুরের আবরণে ঘাপটি মেরে এরা গোটা সমাজটাকে দানবীয় কায়দায় চাটতে থাকে।  

প্যারিশংকর কতোটা পাষণ্ড তার বর্ণনা দেন বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর গল্পের ভেতরে চমৎকার ঐন্দ্রিকজালে। কুসুম যে ব্রাহ্মণ  কন্যা নয়, আবার বিধবা জানার পর হেমন্ত ছুটে আসে, ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে। তখন প্যারিশংকর যেভাবে তার কুৎসিত কদাকার অভিব্যক্তি প্রতিশোধের আগুনে প্রকাশ করে তা এক কথায় তীব্র অমানবিক এবং কৌতুকপূর্ণ। প্যারিশংকর সকল ঘটনা নিপুণতায় বর্ণনা করে শ্লেষের সঙ্গে বলে, ‘বিপ্রদাস তীর্থে  গেল। আমি মেয়েটিকে শ্রীপতি চাটুজ্জের বাসায় রাখিয়া তাহাকেই  মেয়ের বাপ বলিয়া চালাইলাম। তাহার পর যাহা হইলো  তোমার জানা আছে। তোমার কাছে আগাগোড়া খোলসা করিয়া বলিয়া বড় আনন্দ লাভ করিলাম। এ যেন একটি গল্পের মতো। ইচ্ছা আছে, সমস্ত লিখিয়া একটি বই করিয়া ছাপাইব। আমার লেখা আসে না। আমার ভাইপোটা শুনিতেছি একটু আধটু  লেখে। তাহাকে দিয়া লেখাইবার মানস আছে। কিন্তু তোমাতে তাহাতে মিলিয়া লিখিলে সব চেয়ে ভালো হয়, কারণ গল্পের উপসংহারটি আমার ভালো করিয়া জানা নাই।’

কতোটা পাষণ্ড হলে এমন করে একজন মানুষের সর্বনাশ করে আর তাকে দিয়েই সেই সর্বনাশের বাজনা বাজাতে চায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ত্যাগ’ গল্পের কপট চরিত্র প্যারিশংকর। যদিও প্যারির যুক্তি আছে, হেমন্তের বাবা হরিহরের নির্মমতা। হরিহর কেবল গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে নাই, কলকাতায় এসে প্যারি যখন তার এক ভাইয়ের ছেলের বিয়ে দিচ্ছিল, সেখানেও বাগড়া দিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিল। সে ক্ষেত্রে বলা যেতেই পারে ‘যেমন বাঘা ওল, তেমন বাঘা তেতুল’। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অন্যায় করেছে হরিহর, কেনো সেই অন্যায়ের করুণ ফল ভোগ করবে হেমন্ত এবং কুসুম। হরিহরের ছেলে হেমন্ত। সে একটা দায় পেলেও পেতে পারে কিন্তু কুসুম? অসহায়, বিধবা মেয়েটির কী অপরাধ? কেনো সে দুই পরিবারের কুরুক্ষেত্রের নায়িকা হবে?

প্রশ্ন করতে পারি, কিন্তু  উত্তর পাওয়া যাবে না। উত্তর পেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ত্যাগ’ গল্প লিখতে পারতেন না।  উত্তর পেলে গল্পের একটা  অঙ্ক জানা যায়। আর অঙ্কই যদি জানা যায়, গল্প হবে না। অজানা অঙ্ক নিয়েই গল্পের জায়গাজমিন, গল্পের বিস্তার। গল্পের জায়গাজমিন ও বিস্তার সর্ম্পকে খুব ভালো করেই জানতেন বাংলা ছোটগল্পের মহান এই স্রষ্টা। গল্পের ভেতর দিয়ে তিনি এই সময়ের পাঠকদের চিনিয়েছেন সেই সময়ের মানস চালচিত্র, বুভুক্ষু মনের নিদাগ দারিদ্র্য আর দগ্ধ মনের দরজায় রেখেছেন নোনা পাপ। সেকালে মানুষ কতো বিষাক্ত ছিল, কতো পাশবিক ছিল, কতো নির্দয় ছিল, ‘ত্যাগ’ গল্প তারই দায় বহন করছে। কিন্তু এইসব ঘটনা আড়ালে থাকে না। এক সময় তীব্র উল্লাসে বন্যার গতিতে ধেয়ে আসে। কিন্তু এখানে, গল্পে ঘটেছে আরও নিদারুণ করুনাধারায়। পাষণ্ড চরিত্র প্যারিশংকর নিজেই আবার সব গোপন প্রকাশ করে দেয়, তাও আবার ধর্ম রক্ষার মোড়কে।

সমস্ত ঘটনা শুনে, হেমন্ত প্রশ্ন করে, ‘আমাদের যাহা করিবার তাহাতো করিলেন। আবার কথাটা প্রকাশ করিলেন কেন?
প্যারিশংকর বলল, ‘দেখিলাম, তোমার ছোট ভগ্নির বিবাহের সমস্ত স্থির হইয়া গেছে। তখন মনে মনে ভাবিলাম, একটা বাহ্মণের জাত মারিয়াছি কিন্তু সে কেবল কর্তব্যবোধে। আবার আর একটা ব্রাক্ষণের জাত মারা পড়ে, আমার কর্তব্য এটা নিবারণ করা। তাই তাহাদের চিঠি লিখিয়া দিলাম, বলিলাম, হেমন্ত যে শূদ্রের কন্যা বিবাহ করিয়াছে তাহার প্রমাণ আছে।
হেমন্ত বহু কষ্টে ধৈর্য সংবরণ করে বলল, ‘এই যে মেয়েটিকে আমি পরিত্যাগ করিব, ইহার দশা কী হইবে? আপনি ইহাকে আশ্রয় দিবেন?’
প্যারিশংকর বলল, ‘আমার যাহা কাজ তাহা আমি করিয়াছি, এখন পরের পরিত্যক্ত স্ত্রীকে পোষণ করা আমার কর্ম নহে।’

মানুষের বর্বরতা বা নিষ্ঠুর পৈশাচিকতারও সীমা থাকে। থাকে পরিহাসের বা শ্লেষেরও শেষ, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘ত্যাগ’ গল্পের কুটিল চরিত্র প্যারিশংকরের সেই সীমা নেই। কারণ, হেমন্তের সঙ্গে কথোপকথনের শেষ লাইনটায় যখন  উপসংহার টানে- ‘ওরে, হেমন্ত বাবুর জন্য বরফ দিয়া একগ্লাস ডাবের জল লইয়া আয়, আর পান আনিস।’ মানুষ হলে আর কিছু বলার বা লেখার থাকে না, পরিহাসের নির্মমতায় সব ভাষা মুক হয়ে যায়। আমরা যদি চিত্রকল্পটা মনের চোখে দেখি, কী দেখব? বরফ দিয়ে ডাবের জল খাচ্ছে হেমন্ত আর পান খেয়ে মুখ লাল করছে প্যারিশংকর!

প্যারিশংকর নিজের হাতে কুসুমকে তৈরি করেছে, নাটক সাজিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে, আবার সেই মেয়েটি সর্ম্পকেই নিঃসংকোচে বলছে, পরের পরিত্যক্ত স্ত্রী! আমার মনে হয়, অনেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গল্পটি পাঠ করেন নি। যারা পাঠ করেননি, তাদের কাছে মনে হতে পারে, গল্পটি এখানেই শেষ। কিন্তু মনে রাখা দরকার গল্পের নির্মাতা গল্পের নাম দিয়েছেন, ‘ত্যাগ’। ত্যাগটা হলো কোথায়? কেবল শোধ আর প্রতিশোধ পরিঘাতে আমরা এখানে এসেছি কিন্তু গল্পের শেষ হয়নি। গল্পের শেষ হতে হলে আমাদের আর একটু যেতে হবে। কুসুমের পরিচয় জানতে হবে। নিখিলের সব মানুষ জেনে গেছে, কুসুম শূদ্রের কন্যা। আচারনিষ্ঠ ব্রাক্ষণ প্রবল পুরুষ হরিহর কি আর সংসারে রাখবে কুসুমকে? কী হবে হতভাগ্য কুসুমের? কোথায় হবে কুসুমের অধিষ্ঠান? আমরা যখন কুসুমকে নিয়ে বিড়ম্বিত, দ্বিধাখণ্ডিত, ঠিক তখন কালের মহানায়ক গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের চমকে দেন তাঁর শুদ্ধাশ্রয়ী মানবিক বোধনে, ধর্মের আলখেল্লায় ঢাকা অমরাবতির দুয়ার খুলে নিয়ে আসেন বাঙালির শাশ্বত কালের শুভ উপলব্ধি ও বিদ্রোহী শ্লোক, বন্দি মানুষত্বকে দিলেন মুক্তি, ধর্মের নির্মোক পরিহিত বকধামির্কদের মুখে কষিয়ে দিলেন তীব্র চপেটাঘাত।

আমরা ‘ত্যাগ’ গল্পের শেষ কয়েকটি লাইন পাঠ করে এই গল্পআলেখ্যর ইতি টানবো।
‘‘আবার চটি জুতোর শব্দ হইলো। হরিহর মুখজ্জে দ্বারের কাছে আসিয়া বলিলেন, অনেকক্ষণ হইয়া গিয়াছে, আর সময় দিতে পারি না। মেয়েটাকে ঘর হইতে দূর করিয়া দাও।... হেমন্ত উঠিয়া গিয়া পিতাকে বলিল, ‘আমি স্ত্রীকে ত্যাগ করিব না।’
হরিহর গর্জিয়া উঠিয়া কহিল- জাত খোয়াইবি?
হেমন্ত কহিল- আমি জাত মানি না।
তবে তুই সুদ্ধ দূর হাইয়া যা।’’

গল্প তো গল্পই। গল্পকারের নিজের বোধ ও বোধনের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত গল্প, গল্পের চরিত্র, আখ্যান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বোধ ও  বোধনের ভেতরে সমাজ সংস্কারের বৈঠা ধারণ করেছিলেন, সেই বৈঠার আঘাতে প্যারিশংকর ও হরিহর মুখাজ্জিদের পতন হয়েছে। পৃথিবী সুন্দর আর সঙ্গমের লীলায়  রবীন্দ্রনাথে স্নাত হয়ে পূত হচ্ছে। পবিত্র থেকে পবিত্র হচ্ছে ‘ত্যাগ’ গল্পের কুসুম আর  হেমন্ত আমাদের অভিযাত্রী।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মে ২০১৫/তাপস রায়
 

রাইজিংবিডি.কম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়