ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

দর্শনার্থী শূন্য বালাপুর জমিদার বাড়ি

গাজী হানিফ মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:০১, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দর্শনার্থী শূন্য বালাপুর জমিদার বাড়ি

দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে একটি প্রাচীন ও বিখ্যাত জনপদ বাংলার ম্যানচেস্টার বলে খ্যাত নরসিংদী। ১ হাজার ১৩৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ মহকুমা থেকে ১৯৮৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় এ জেলা।

২২ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত নরসিংদী জেলায় রয়েছে ৫টি সংসদীয় আসন ও ৬টি উপজেলা। রাজধানী ঢাকার সন্নিকটে নরসিংদী জেলায় রয়েছে এক গৌরবময় প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তার মধ্যে সদর উপজেলার পাইকারচর ইউনিয়নের বালাপুর ঐতিহ্যবাহী একমাত্র জমিদার বাড়ি অন্যতম।

বর্তমানে অযত্ন আর অবহেলায় বিলীন হওয়ার পথে জমিদার বাড়িটি। সংস্কারের অভাবে সৌন্দর্য হারাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এ জমিদার বাড়ির প্রাচীন সব স্থাপত্য। ফলে জমিদার বাড়ির ইতিহাস ঐতিহ্য দেখতে এসে বিমুখ হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের।

জানা যায়, নরসিংদী জেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে পাইকারচর ইউনিয়নের মেঘনা নদী সংলগ্ন বালাপুর গ্রাম। মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে প্রায় ৩২০ বিঘা জমি নিয়ে বালাপুর জমিদারি স্টেট। এর মধ্যে ৪০ বিঘা জমির উপর সুবিশাল আকৃতির নৈপুণ্যঘেরা কারুকাজ সম্বলিত জমিদার বাড়ি। এটি জমিদার কালী মোহন সাহার পিতামহ নবীন চন্দ্র সাহার।

 

 

নবীন চন্দ্র সাহার ছিল ৩ ছেলে, কালী মোহন সাহা, আশুতোষ সাহা এবং মনোরঞ্জন সাহা। এদের মধ্যে জমিদার কালী মোহনই ছিল প্রধান। বংশধর হিসেবে কালী মোহন সাহার ভাতিজা অনিল চন্দ্র সাহা তার দ্বিতীয় ছেলে, অজিৎ চন্দ্র সাহা ও অশিত চন্দ্র সাহা এবং ভাতিজা বীরেন চন্দ্র সাহার ছেলে দেবাশীষ চন্দ্র সাহাও বাড়িটিতে বাস করতো।

সুবিশাল আকৃতির বাড়িতে ১০৩টি কক্ষ ছাড়াও এর পূর্বদিকে তিনতলা তলা, উত্তর দিকে এক তলা, দক্ষিণ দিকে দুই তলা এবং পশ্চিম দিকে একটি বিশাল আকারের কারুকার্য খচিত গেইটসহ দ্বিতল একটি ভবন রয়েছে। বাড়ির চতুর্দিকেই রয়েছে ইমারত ও কারুকার্যপূর্ণ দর্শনীয় নির্মাণ শৈলী।

বিশাল ভবনটির প্রতিটি কক্ষেই রয়েছে কারুকার্য খচিত দরজা জানালা। জমিদার বাড়ি ঘিরে পশ্চিমে রয়েছে একটি বিশাল পুকুর, উত্তরে রয়েছে বিশাল আকারে দুর্গা পূজামণ্ডপ রাখার একটি দালান, অতিথিদের থাকা-খাওয়া এবং ঘুমানোর জন্য রয়েছে ৩১টি কক্ষ বিশিষ্ট একটি ভবন। তার পাশেই রয়েছে বালাপুর নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। উত্তরে রয়েছে পুরাকীর্তি বিশিষ্ট অসমাপ্ত একটি স্কুল। বাড়ির সম্মুখেই রয়েছে একটি বিশাল আকারের পুকুর, এর পাশেই রয়েছে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা করার একটি বিশাল মাঠ।

তৎকালীন সময়ে এই জমিদার বাড়িতে বিচারের জন্য জমকালো বৈঠক বসতো। সকাল-সন্ধ্যায় জমিদার বাড়িতে শঙ্খ, ঘণ্টি, কাশর, করতাল, জয়শীরি, ঢাক-ঢোল, সানাই, কেনেটসহ নানা ধরনের আকর্ষণীয় বাদ্যযন্ত্র বাজাতো। জমিদার বাড়ির রমণীরা দল বেঁধে পুকুরে স্নান শেষে মন্দিরে পূজা অর্চনায় বসতো। যুগের পরিক্রমায় আজ সেই মন্দির ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টি নন্দিত জমিদার বাড়ি ও এর শত-শত বিরল প্রজাতীর বৃক্ষ আজ বিলুপ্তির পথে।

 

 

সরেজমিনে জমিদার বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমলে দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে তৎকালীন বালাপুরের জমিদার বাবু কালী মোহন স্ব-পরিবারে ভারতের কলকাতায় চলে যান। ভারতে চলে যাবার পূর্বে জমিদারী স্টেট দেখা-শোনার জন্য নিখিল চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিয়ে যান। জমিদারের দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সেজে কাগজ-পত্র করে যার-যার প্রভাব অনুযায়ী বিশাল এই সম্পত্তি ভোগ দখল করে আসছেন। এ বাড়ি থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে ভংগারচর সংলগ্ন মেঘনা নদীর তীরে জমিদারের প্রতিষ্ঠিত কারুকার্য খচিত একতলাবিশিষ্ট একটি বিশাল ভবন ছিল। যা মেঘনা নদীতে জমিদার বাড়ির স্টিমার ঘাট হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ভারতের কলকাতা থেকে স্টিমার এসে বণিকরা এখানে মালা-মাল ও পণ্য সামগ্রী এই ঘাটে খালাস করতো।

জমিদার বাবু স্টিমারে চড়েই তৎকালীন এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার সঙ্গে সওদাগরি-বাণিজ্য করতো। রাতের বেলায় জমিদার বাবু ঘোড়া দৌড়িয়ে স্টিমার ঘাটে এসে প্রমোদ বালাদের নিয়ে আনন্দ স্ফূর্তি, ভোগ-বিলাস করতো। কালের সাক্ষী হিসেবে স্টিমার ঘাটটি বর্তমানে মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে। দর্শনীয় জমিদার বাড়ি দেখতে এক সয়ম দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা এসে নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে সারা বেলা কাটিয়ে দিত। এখন আর পর্যটকদের তেমন দেখা মেলে না।

এদিকে দেড় শত বছরের পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ জমিদার বাড়িতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২৫টি পরিবার বসবাস করতো। ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসে যখন হাজারো মানুষের প্রাণহানি ঘটে, তখন নরসিংদীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. ওয়াদুল আজমের নজরে আসে বাড়ির দিকে। তিনি ঝুঁকিপূর্ণ জমিদার বাড়িতে বসবাস করা ওই পরিবারগুলোকে অপসারণ করে ৯০ হাজার টাকা ও ৩০ বান্ডেল ঢেউটিন প্রদান করে অন্য স্থানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। পরে বাড়ির প্রবেশ পথে দুইটি সাইনবোর্ড দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন লিখে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ করেন।

ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী নরসিংদীর বালাপুর জমিদার বাড়িটি দিন দিন ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ সেই জমিদার ও জমিদারি কোনোটাই নেই। বালাপুর জমিদার বাড়িটি বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এর অস্তিত্ব।



নরসিংদী/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়