ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দায়মুক্তির ঐতিহাসিক দিন

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫২, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দায়মুক্তির ঐতিহাসিক দিন

শাহ মতিন টিপু : দায়মুক্তির ঐতিহাসিক দিন আজ। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি জাতীয় গ্লানি থেকে দায়মুক্তি ঘটে বাংলাদেশের। এই দিনের সূচনালগ্নেই রাত ১২টার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। যারজন্য জাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল দীর্ঘ ৩৪টি বছর। আর এর মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় গ্লানির দায়মুক্তি ঘটে।

১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল। এটি ছিল পৃথিবীর অন্যতম জঘন্যতম বর্বর নির্মম নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞ। এই হত্যাযজ্ঞের বিচারের পূর্ণতা পেয়েছিল এইদিনে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয় কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ও লে. কর্নেল সুলতান শাহারিয়ার রশিদ খান এর মৃত্যুদন্ড।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকারী এ পাঁচজনই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা। এদের মধ্যে ফারুকের বাড়ি নওগাঁয়, শাহরিয়ারের কুমিল্লায়, বজলুল হুদার বাড়ি মেহেরপুরে এবং দুই মহিউদ্দিনের বাড়ি পটুয়াখালীতে।

এই রায়ে মৃত্যদন্ডপ্রাপ্ত আরও সাতজন হচ্ছেন আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, মোসলেমউদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও আব্দুল মাজেদ। যারা বিদেশে পালিয়ে ছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের নৃশংস হত্যার বিচার রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। হত্যাকারীদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ নামের কালাকানুন জারি করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, হত্যাকারীদের পুরস্কৃতও করা হয়েছিল বিদেশি মিশনে লোভনীয় পদে চাকরি দিয়ে। এমনকি পরবর্তী সময়ে তাদের কাউকে কাউকে রাজনৈতিক দল গঠন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

হত্যাকান্ডের পর সঠিক বিচারের পথে বাধার পরে বাধা এলেও কোনো কিছুই ধোপে টিকেনি। সময়েরই বিলম্ব ঘটিয়েছে শুধু। এরমধ্যেই কেটে গেছে ৩৪টি বছর।

১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর কোনো মামলা করতে দেয়নি তৎকালীন সরকার। বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে গেলেও দেশে ফিরতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা।

প্রথমে বাধা, এরপর হত্যাকান্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করার জন্য '৭৫ এর ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন খোন্দকার মোশতাক সরকার ইন্ডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন।

দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি বাতিল করলে ওই হত্যাকান্ডের বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়।

হত্যাকান্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মুহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় ২৩ জনকে আসামি করে মামলা করেন।

তদন্ত শেষে পুলিশ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। ওই বছরের ১২ মার্চ ঢাকায় দায়রা জজ আদালতে শুরু হয় বিচার। একই বছর ৭ এপ্রিল ওই আদালত ২০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। মারা যাওয়ায় আসামির তালিকা থেকে বাদ পড়েন মোশতাক আহমেদ, মাহবুবুল আলম চাষী ও মোস্তফা আহমেদ।

১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার দায়রা জজ গোলাম রসুল ২০ আসামির ১৫ জনকে 'ফায়ারিং স্কোয়াডে' মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় দেন। এর আগেই আব্দুর রশিদের স্ত্রী জোবায়দা রশিদ হাইকোর্টের আদেশে মামলা থেকে অব্যাহতি পান।

এরপর ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এ মামলায় বিভক্ত রায় দেয়। ওই বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ১০ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন। অন্য বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশই বহাল রাখেন।

২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম তার রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রেখে তিন আসামি মো. কিসমত হাসেম, আহমেদ শরিফুল হোসেন ও নাজমুল হোসেন আনসারকে খালাস দেন।

তবে হাইকোর্ট প্রচলিত নয় বলে 'ফায়ারিং স্কোয়াডে' মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে 'ফাঁসিতে ঝুলাইয়া' মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আদেশ দেয়।

মৃত্যুদন্ড বহাল থাকা কারাবন্দি চার আসামি বজলুল হুদা, ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দিন আহমেদ একই বছর আপিলের আবেদন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার এ কে এম মহিউদ্দিনকে ২০০৭ সালে দেশে আনা হলে তিনিও আপিলের আবেদন করেন। এভাবে অনেক সময় গড়িয়ে গেলেও শেষাবধি সত্যেরই জয় হয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জাতি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের মধ্যে পাঁচজনের ফাঁসির রায় কার্যকর করার খবরটি সেদিন বিশ্ব গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। কয়েকটি সংবাদমাধ্যম খুনিদের রায় পর্যালোচনার আবেদন খারিজের খবরটিও বেশ গুরুত্বসহকারে প্রচার করে। রায় কার্যকর হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বের খ্যাতনামা বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, বার্তা সংস্থা, অনলাইন পত্রিকা ও সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণে খবরটি প্রচারিত হয়। প্রায় সব সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম ছিল প্রায় একই রকম।

রায় কার্যকর হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে খবরটি প্রচার করে বিবিসি অনলাইন। সংবাদমাধ্যমটির শিরোনাম ছিল, ‘মুজিব হত্যাকারীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করল বাংলাদেশ।’ আল-জাজিরা অনলাইনের শিরোনামে বলা হয়, ‘মুজিব হত্যাকারীদের ফাঁসিতে ঝোলাল বাংলাদেশ।’

এপি, এএফপি, রয়টার্স, পিটিআইসহ বিশ্বের জনপ্রিয় বার্তা সংস্থাগুলো বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার খবর তাত্ক্ষণিকভাবে প্রচার করে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের শিরোনাম ছিল, ‘স্বাধীনতার নেতা মুজিব হত্যাকারীদের ফাঁসিতে ঝোলাল বাংলাদেশ।’ এএফপির শিরোনাম ছিল এ রকম, ‘স্বাধীনতার নেতা মুজিব হত্যাকারীদের মৃতুদন্ড কার্যকর করল বাংলাদেশ।’

ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের শিরোনামে বলা হয়, ‘মুজিবের পাঁচ খুনিকে ফাঁসিতে ঝোলাল বাংলাদেশ।’ দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকার শিরোনাম দেওয়া হয়, ‘স্বাধীনতার নেতা মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের ফাঁসি দিল বাংলাদেশ।’

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলোতেও খবরটি বেশ গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি ভাষার পত্রিকা ডন-এর অনলাইন সংস্করণের শিরোনাম ছিল, ‘মুজিবুর রহমান হত্যাকারীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করল বাংলাদেশ।’ মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার আগে খুনিদের রায় পর্যালোচনার আবেদন খারিজের খবরও প্রচার করে ডন অনলাইন। ওই খবরের শিরোনাম ছিল, ‘মুজিবের খুনিদের মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রাখল বাংলাদেশ।’

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এটি হয়েছে দেশের প্রচলিত সাধারণ আইনে, কোন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তড়িঘড়ি আসামিদের ফাঁসি দেওয়ার কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সব রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিচারের ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জানুয়ারি ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়