ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

দেখা হলো মাত্র একটি আকর্ষণ, বাকি আরো চারটি

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৪, ২১ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দেখা হলো মাত্র একটি আকর্ষণ, বাকি আরো চারটি

(ভিয়েতনামের পথে : ২২তম পর্ব)                                       

ফেরদৌস জামান : আগের দিনের মতো আজও ভোরে ঘুম ভাঙল। আজকের দিনটিই এখানকার শেষ দিন। ঘরটার প্রতি মায়া জন্মে গেছে। মনে হচ্ছে কতদিন ধরে এখানে আছি! পাশের ঘরে শুয়ে আছে এ্যামো লাইট। ওর সাথে সম্পর্কটা বেশ এগিয়েছে। এখন পরস্পরের মধ্যে ধার দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক। প্রতিদিন ঘরে ফিরে দেখি বারান্দার টেবিলে বসে ল্যাপটপ মেলে ধরে গভীর ধ্যান দিয়ে কাজ করছে। সামনে বিয়ারের বোতল আর বাম হাতের দুই আঙুলের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট। সময় নিয়ে তার সাথে যে একটু কথাবার্তা হবে, সারাদিন হাঁটাহাঁটির পর ঘরে ফিরে সে মেজাজ আর থাকে না।

অথচ, এ্যামো যেন গল্পগুজব অথবা ভাবের আদান-প্রদান করার জন্য কিছুটা হলেও প্রস্তুত থাকে। গত রাতে বেশ খানিকটা সময় আড্ডা হলো। গুনগুন করে মুখের মধ্যে একটা গানের কলি আউড়ে যাচ্ছিলাম অমনি ধরা খাওয়া। ওর উপকারের ঋণ শোধ করার নয়, আমাদের দুজনের সাথে দুইটি ক্যামেরা। অথচ, মেমরি কার্ড আছে মাত্র আট আট ষোলো গিগাবাইটের। এখানে কোন সাইবার ক্যাফেও নেই যে, সেখানে গিয়ে পেনড্রাইভে ছবিগুলো পার করে নেব। এমন পরিস্থিতিতে উদ্ধার কর্তা হিসেবে পেয়ে যাই পড়শী এ্যামো লাইটকেই। ল্যাপটপটা ছেড়ে দেয় আর ঠাট্টা করে হেসে বলে, বিনিময়ে একটা সিগারেট দিতে হবে। ওর সাথে কথা হয় বিশেষ করে তিন অবস্থায়। ঘর থেকে বের হতে, ঢুকতে এবং রাতে সিগারেট ধার দেয়া-নেয়ার কারবারে। এছাড়া দু’এক কথা যা হয় তা ওই কাজের ফাঁকে। প্রতিদিন ঘরে ফিরে বারান্দার আলোতে আমরা বসি পরের দিনের পরিকল্পনা সাজাতে অথবা অভিজ্ঞতা থেকে দু’চার কথা লিখতে। ওদিকে সে বসে কয়েক গজ ব্যাবধানে, কাঠের রেলিং এর ওপর। মূলত কোন এক গবেষণার কাজে তার থাইল্যান্ড আসা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময় বের করে নিয়ে আশপাশটা ঘুরে দেখতে ছাড়ছে না।



আজ আমার হাতে সময় বেশ আছে। ঢিলেঢালা মেজাজে দিন শুরুর যাবতীয় কাজ সেরে সকালের পাই দেখতে বের হলাম। রাস্তা হিসেবে নির্বাচন করলাম আদালত ভবনের পাশ দিয়ে শহরের পর্যটক প্রধান রাস্তা। দুই দিনে যেমন দেখছি তেমন নয়, পরিচিত এই রাস্তাটি আজ ধরা দিল তৃতীয় রূপে। দিনের বেলা এক রকম, সন্ধ্যার পর থেকে আর এক রকম এবং ভোর বেলায় সম্পূর্ণ নতুন এক রূপ। দেকানগুলো এখনও খোলেনি। দুই পাশ দিয়ে বসেছে সকালের নাস্তার দোকান। হরেক রকম খাবারের পসরা সাজিয়ে খদ্দেরের অপেক্ষারত দোকানিরা সামনে দিয়ে যেতেই ‘কাপন খাপ’ বলে স্বাগত জানায়। এই শব্দ দুটির অর্থ কী হবে জানি না, তবে থাইল্যান্ডের মাটিতে পা রাখার পর থেকে শুনতে শুনতে আন্দাজ করে নিয়েছি- স্বাগতম, কেমন আছেন বা আসসালামুয়ালাইকুম ধরণের কিছু একটা হবে নিশ্চয়। প্রতিক্রিয়া জানাতে জানাতে ইতিমধ্যে আমরাও বলা শিখে গেছি- কাপন খাপ। প্রথম শব্দের পর দ্বিতীয়টা উচ্চারণের ক্ষেত্রে কয়েক মাত্রা দীর্ঘ টান আছে। যথা- কাপন খাআআআপ। শুনতে যেমন ভালো লাগে উত্তর দিতেও তেমন ভালো লাগে। দোকানে গেলে হাসি মুখে এত সুন্দর করে বলে; ইচ্ছে করে দোকানের সমস্ত জিনিস কিনে ফেলি। বন্ধ দোকানগুলো কেবল দোকানই নয়, দেখার মত বিষয়। খামাখা মণখানিক তালা ঝুলিয়ে রাখা নেই, শিল্প কর্মে সজ্জিত। ফেলে দেয়া, কুড়িয়ে নেয়া বা পরিত্যাক্ত জিনিসপত্র দিয়ে চমৎকার করে সাজানো বাহিরটা। ঝাপ অথবা পাল্লায় যুক্ত করা হয়েছে নানান রকম নকশা। পুরনো বাইসাইকেল এবং গাড়িঘোড়ার যন্ত্রাংশ সংস্কার করে প্রদর্শিত হয়েছে শিল্পকর্ম হিসেবে। এগুলো আবার টেবিল-চেয়ার হিসেবেও ব্যাবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ, বাইসাইকেলকে টেবিলে রূপ দেয়া হয়েছে, যাতে হরদিন জমে থাকে পর্যটকদের আনন্দ আসর।

এ পথে অনেকটা হাঁটা হলো। বিপরীত দিকে ফিরে সোজা গিয়ে উপস্থিত হলাম নদীর ধারে। বৃক্ষের ছায়াতলে মনোরম পরিবেশে বড় একটা বার ও রেস্টুরেন্ট। চত্বরের ওপাড়ে বেশ কয়েকটি কটেজ। পাশ দিয়ে এগিয়ে রাস্তার শেষ হয়েছে নদীতে। অপর পাড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কটেজ। রংবেরঙের কটেজের কয়েকটা একেবারে নদীর পাড়ে। পর্যটকদের সুবিধার্থে নদীর উভয় পাড়ের সংযোগ স্থাপনে সেতু নির্মাণের কাজও চলমান। অনেকটা সময় হয়ে গেল। এখন গেস্ট হাউজে ফিরতে হবে। সাড়ে আটটায় টুর অপারেটর কার্যালয়ে উপস্থিত থাকার কথা। যথারীতি নাস্তা সেরে দুজনে বেড়িয়ে পরলাম। আজকের ভ্রমণ একেবারে নিপাট ভদ্রলোকি। পরিশ্রম নেই বললেই চলে। সঠিক সময়ে গাড়ি এসে হাজির। পেছন এবং সামনে গাড়ির দুইটি অংশ। চালকের ঠিক পেছনটাতে আয়েশ করে দুজন বসার মত জায়গা। আমরা তো সেখানেই বসতে চাইলাম। চালক কোন আপত্তি করলেন না। এই অংশটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। কিছুক্ষণের মধ্যে কড়কড়ে ঠান্ডায় শরীরে কাঁপন ধরল। একটু পর বাকি চারজন এসে উপস্থিত। মোটে ছয়জনের দল নিয়ে ঠিক নয়টায় গাড়ি ছেড়ে দিল।



ফাঁকা সড়ক পেয়ে গাড়ি হাকিয়ে চলছে আপন গতিতে। মাত্র দশ মিনিটের মধ্যেই শহর থেকে বেরিয়ে এলাম নির্জনতায়। পাহাড়-পর্বত তথা প্রকৃতির সামন্যতম ক্ষতি না করেও গড়ে তোলা হয়েছে এত চমৎকার সড়ক অবকাঠামো। আধা ঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টার এক সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে পৌঁছে গেলাম পাহাড় শীর্ষে। জায়গাটি সাইট সীং প্লেস বলে পরিচিত। বেশ কয়েকটি পর্যটক দল আমাদেরও আগে এসে ভিড় জমিয়েছে। উভয় পাশে বিস্তীর্ণ উপত্যকা। শেষ প্রান্তে পর্বতশ্রেণী এমন করে দাঁড়িয়ে আছে যেন এক প্রকাণ্ড বেষ্টনি। উপত্যকার মাঝে এই পাহাড়ের শীর্ষদেশ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সড়কের উভয় পাশে সামান্য জায়গার পরই খাঁদ। খাঁদের ধার রেলিং দিয়ে আটকানো। দোলনা এবং নাগোরদোলার মত দু’একটা খেলার উপকরণও আছে। চোখ যতদূর যায় শুধু সবুজ পাহাড়। অন্য কোন গন্তব্যে ছুটে যাওয়ার তাগাদা না থাকলে এমন সুন্দর জায়গায় বসে সারাদিনই পার করে দেয়া যায়। পাঁচ-ছয়টি শিশুর একটা দল; ঐতিহ্যবাহি পোশাক পড়ে অনেক ব্যস্ত সময় পার করছে।

পাই এসে প্রথম সন্ধ্যায় নৃত্যরত শিশুদের পরনে যে পোশাক ছিল ঠিক সেরকম। তাদের ব্যস্ততার একমাত্র কারণ পর্যটকদের ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে দাঁড়ানো। পর্যটকরা শিশুদের ছবি তুলছে। অথবা তাদেরকে সাথে করে নিজের ছবি। বিনিময়ে শিশুর দল হাতে পাচ্ছে সামান্য কিছু অর্থকড়ি। নিয়ন্ত্রণ বা তত্ত্বাবধানের জন্য রয়েছেন একজন মাঝ বয়সি লোক, যিনি এদের কারও পিতা বা অভিভাবক হয়ে থাকবেন। ইতিমধ্যেই এখানে এসে পড়েছে পর্যটকবাহী আরও কিছু গাড়ি। আধা ঘণ্টাও হয়নি, বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট অতিবাহিত  হয়েছে মাত্র, অমনি আমাদের গাইড অর্থাৎ গাড়ি চালক এসে তাগাদা শুরু করলেন। পর্যটকদের লক্ষ্য ভ্রমণ করা আর তার লক্ষ্য সেই ভ্রমণ সার্থক ও সফল করতে বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া। ভ্রমণের সবে শুরু, দেখা হলো মাত্র একটি আকর্ষণ, বাকি আরও চারটি।
(চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়