ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দ্বীপের পথে অজানার খোঁজে: প্রথম পর্ব

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ৩ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দ্বীপের পথে অজানার খোঁজে: প্রথম পর্ব

জুনাইদ আল হাবিব : মেঘনা-পদ্মার মোহনায় জেগে ওঠা দ্বীপ। বহু বছর ধরে মানুষের ঠাঁই মিলেছে ওখানে। পূর্ব-দক্ষিণে মেঘনা, উত্তর-পশ্চিমে পদ্মা। চারদিক থেকে বিশাল জলরাশি ঘেরা এ জনপদ। মেঘনা বেশ উত্তাল, পদ্মা স্বকীয়তা হারিয়েছে। খরস্রোতা মেঘনাপাড় ভাঙছে হু হু করে। বহু মানুষ ঠিকানা হারিয়ে দিকহারা। নতুন পথের সন্ধানে কেউ কেউ ছুটছেন অন্যত্র। ধীরে ধীরে দ্বীপের মানচিত্র সংকুচিত হচ্ছে। এমন অভিজ্ঞতার কথা বলছি চাঁদপুরের দ্বীপ হাইমচর ঘুরে। দ্বীপ হাইমচরে ৩টি ইউনিয়ন- হাইমচর, নীলকমল ও গাজীপুরা। যেখানে বসাবস করছেন আনুমানিক ৪০ হাজার মানুষ।

ভ্রমণের নেশায় গেলেও হয়েছে খবরের খোঁজ। গত বছরের বর্ষায় প্রথম গিয়েছি। এ বছর গ্রীষ্মের শেষ দিকে দ্বিতীয়বার। অনুপ্রেরণা পেয়েছি একজন পথিকৃৎ উপকূল সাংবাদিকের কাছে। এ জগতে যার যশ ও খ্যাতি সর্বজনস্বীকৃত। ‘উপকূল বন্ধু’ রফিকুল ইসলাম মন্টু তিনি। যিনি খবরের খোঁজে ঘোরেন উপকূলের দুর্গম, বিপন্ন জনপদে। তাঁর সঙ্গেই দু’বার এ দ্বীপে পথচলা আমার। একদিন চাঁদপুরের হাইমচরের মূল ভূ-খণ্ডের চর ভৈরবী মেঘনাতীরে এসে জানতে পারি, ওপারে একটি চর জেগেছে। মানুষও বসাবস করছে। সারাদিনের রোদ ছড়িয়ে ক্লান্ত সূর্যটা ওপারে ডুবে যাওয়ার পথে। উপকূল বন্ধু’র সিদ্ধান্ত, এর পরের দিন সকালে যাবো দ্বীপে। সে সকালে পূর্ব আকাশে সূর্যটা রং-ঢংয়ে ভরপুর। লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে দু’জন সিএনজি যোগে ট্রলার ঘাটে পৌঁছলাম। পথিমধ্যে বৃষ্টি চলার গতি থমকে দিয়েছে। বৃষ্টির জন্য আমাদের আগাম কোনো প্রস্তুতি ছিল না। কেননা আকাশটা ছিল বেশ পরিষ্কার। উপকূল বন্ধু’র ব্যাগে ল্যাপটপ, ক্যামেরাসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ভাগ্যিস, আমার ব্যাগের পকেটে একটা ছাতা ছিল। ক্ষণিকের রক্ষা হলো। সকাল সাড়ে ১০টায় ও-পাড় থেকে ট্রলার এসে ঘাটে ভিড়লো। আবারও বৃষ্টি। তখন দু’জন ট্রলারে গিয়ে উঠলাম। বৃষ্টি শেষ, ট্রলারও চলছে দ্বীপের পথে। দ্বীপগামী মানুষগণও আমাদের সঙ্গে যাত্রী। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে এনেছেন কেউ কেউ। চিকচিকে রোদ, ক্ষণিকের বৃষ্টি আর প্রাণ ছোঁয়া বাতাসের মাঝেই চলছিল ট্রলার। উত্তাল নদী পেরিয়ে ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো দ্বীপকে। ট্রলার চলছে কূল ঘেঁষে। ঠিক উত্তর দিকে। পশ্চিম দিকে চোখ যেতে না যেতেই নজরে আসে মেঘনার ভাঙনের ক্ষত, দ্বীপের বিবর্ণ রূপ!



সাহেবগঞ্জ এ দ্বীপের প্রাণকেন্দ্র। ওখানেই ট্রলার ভিড়বে। সাহেবগঞ্জ যাওয়ার আগেই বিপন্ন চেহারায় আচ্ছন্ন দ্বীপের ভেতর খাল দিয়ে ট্রলার ভিড়তে যাচ্ছিল আরেকটি ঘাটে। এ সময় ভাঙনের কবলে পড়া ভিটে-মাটির মায়ায় মানুষের বুকফাটা আহাজারি শোনা গেল। বিলাপের আওয়াজও কানে ধাক্কা দিচ্ছে। সময়ের পালা বদলে অসহায় মানুষের কাঁন্নায় দ্বীপের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। জলে ভরা খালে ট্রলার চলছিল গন্তব্যে। যাবে পশ্চিমে হয়ে উত্তর দিকে। দক্ষিণে চোখ ফেরালে একটি মাছের আড়ৎ। অনেকটা মাটিহীন উঁচুতে শূন্যের ওপর নির্মিত আড়ৎ। আড়তের ঘরগুলোর খুঁটি গাছ। বাঁশ গাছ বেশি। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রলার সাহেবগঞ্জ বাজারে ভিড়লো। আমরা পৌঁছালাম কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়।

এবার বাজারের ওপর দিয়ে হাঁটছিলাম দক্ষিণ দিকে। দুর্গম পথ, একেবারে কাদামাখা। পায়ের জুতা তখন হাতে নিয়েই হাঁটতে হয়েছিল। পথিমধ্যে কয়েকজন মানুষের দেখা মিলল। ওদের সঙ্গে গল্প হলো আধ ঘণ্টার মতো। ওদের বিদায় দিয়ে আমরা আরো একটু সামনে এগুলাম। সামনে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খাল। খালের ওপারেই কয়েকটা জনবসতি চোখে পড়ছিল। ওপারে সাঁকো পার হলাম। পা রাখলাম তারেক মোল্লার বাড়িতে। ওই বাড়িতে নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আবু সরদার। তার বয়সটা ঠিক ৭০ ছুঁয়েছে। গরুর যত্ন ও সংসারের কাজ করে ব্যস্ত সময় পার হচ্ছে তার। ওই সংসারে দেখা মিলল মোট পাঁচজনের। দ্বীপে চিকিৎসা সেবা, আশ্রয়কেন্দ্র, শিক্ষা, যোগাযোগ সমস্যা খুব তীব্র। বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি ওখানে। এসব সঙ্কটের কথাই বলছিলেন তারা। গল্প করতে করতে এগিয়ে এলেন আবদুস সামাদ হাওলাদার। বয়স প্রায় ৫৫-এ গিয়ে ঠেকেছে। দু’জনেই দ্বীপের জীবনচিত্র জানাচ্ছিলেন আমাদের। পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলোতে সায় দিচ্ছেন তারেক মোল্লা। আবদুস সামাদ হাওলাদার সংসারের বিবরণ দিচ্ছিলেন। ছেলে মাসুদ রহমানকে নিয়মিত উত্তাল নদী পাড়ি দিতে হয় উচ্চশিক্ষার জন্য- বলছিলেন সেকথা। বলতে না বলতেই উপস্থিত হলেন মাসুদ। শিক্ষা ব্যবস্থার হালচিত্র তুলে ধরলেন তিনি। সবার সঙ্গে ‘উপকূল বন্ধু’ উপকূলের গল্প করছেন।



এক ফাঁকে খাল পাশ ঘেঁষে পাশের বাড়িতে গেলাম। সেখানে জেলেরা জাল বুনছেন। নদীতে যাবেন, ইলিশ ধরার আশায়। ক্যামেরায় সে চিত্র তুলে ফিরে এলাম। ক্যামেরার লেন্সের ধারণক্ষমতা বেশ ভালো। দূরের কিছু চিত্রও ক্যামেরার ফ্রেমে ঠাঁই পেল। গল্পের মাঝে ওরা জানালেন, সাপ-বিচ্ছু, পোকা-মাকড়ের ভয়ের কথা। স্বজনরা দেখালেন, ভাতের মধ্যে পিঁপড়ার রাজত্ব! বেলা বেশ গড়িয়েছে। ঘড়ির কাঁটায় সময় ঠিক সাড়ে তিনটা। গল্পও শেষ হলো। না শেষ নয়, ওখানের জন্য শেষ। পুরো দ্বীপের জন্য শেষ বলা চলে না। মনে হলো, ওখানের এক এক জন মানুষ, খবরের এক একটা শিরোনাম।



এবার ফেরার পালা। সময় অনেক গড়ালেও ক্ষুধা নিবারণের চিন্তা মোটেও নেই আমাদের। ফেরার পথে আবদুস সামাদ হাওলাদারের আবদার, দুপুরের খাওয়া তার বাড়িতেই খেতে হবে। খাওয়া হলো, শেষে টাটকা ও ফরমালিনমুক্ত কলা খেতে দেওয়া হলো আমাদের। আসলে এর স্বাদটাও ভিন্ন। ফেরা হচ্ছিলো অন্য পথে। বেশ জনবসতির মাঝেই। এখান দিয়ে আসতে আসতেও কয়েকজনের সঙ্গে গল্প হলো। দক্ষিণ দিক থেকে হেঁটে সাহেবগঞ্জ বাজারের ওপর দিয়ে ঘাটে এসে পৌঁছলাম। সময় তখন বিকেল চারটা গড়িয়েছে। ট্রলার তখনো ছাড়বে না। জানতে পারলাম পাঁচটায় ট্রলার ছাড়বে দ্বীপ থেকে। প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর মাঝি ট্রলার নিয়ে এলেন। ট্রলার ছেড়ে যাবে ওপারে। ট্রলারের যাত্রীরা শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত। ট্রলারের সামনেই ব্যাগটাকে কোলে নিয়ে বসলাম। খাল দিয়ে ট্রলার চলছে। হঠাৎ দ্বীপের মায়ায় আমার মনে বিষণ্নতা ভর করল। একমনে তাকিয়ে দেখছিলাম, হাতছাড়া দ্বীপকে।



খাল দিয়ে ট্রলার মেঘনার উত্তাল স্রোতের বুক চিরে চলছে। বেশি দূর না যেতেই ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হলো আমাদের। একদিকে যেমন জোয়ার অন্যদিকে তেমন ঝড়। ঢেউ এতটাই ভয়াল ছিল যে, ট্রলার ডুবে যেতে বসেছে। ট্রলারে কান্না শুরু হলো। নারী ও শিশুরা বেশি আতঙ্কে ছিলেন। মাথার উপরে ঢেউয়ের প্রবল তীব্রতা দেখে ধরেই নিয়েছিলাম এটা জীবনের শেষ মুহূর্ত! স্রষ্টার রহমতে বেঁচে এলাম। এজন্য তার দরবারে অশেষ শুকরিয়া। অবশেষে দ্বীপ থেকে ফিরলাম। ট্রলার ভিড়লো ভৈরবী ঘাটে। এবার ফিরতে হবে সড়কে পথে আপন ঠিকানায়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়