ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নাটকের দর্শক নেই বলার দিন শেষ

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৩, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নাটকের দর্শক নেই বলার দিন শেষ

‘বড় ছেলে’ নাটকের একটি দৃশ্য

রুহুল আমিন : বাংলা টেলিভিশন নাটকে হুমায়ূন আহমেদের যুগ শেষ হয়েছে অনেক বছর হলো। ইতিমধ্যে বেড়েছে প্রচারমাধ্যম সংখ্যা। বেসরকারি টেলিভিশনগুলো নির্মাতাদের সামনে কাজের সুযোগ তৈরি করেছে। ফলে নির্মাতা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে অনেক মেধাবী তরুণ এগিয়ে এসেছে। অনেকে আবার চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে হাত পাকিয়ে নিতে চেয়েছে টিভি নাটক তৈরি করে। বলা যায়, ঠিক তখন থেকেই কমতে থাকে আমাদের টিভি নাটকের মান। এখানে এজন্য আরেকটি কথা স্মরণ রাখতে হবে, বেসরকারি টেলিভিশনের সংখ্যা বাড়লেও কমেছে নাটক নির্মাণের বাজেট। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের নানা বিধি নিষেধ। অভিনেতা-অভিনেত্রী নেওয়ার ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষের দিক নির্দেশনা থাকে। এগুলো হলো নাটক নির্মাণের পথে প্রধান কিছু বাধা। এর বাইরে রয়েছে নাটক প্রচারের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের ধাক্কা।   

হুমায়ূন পরবর্তী সময় গুটিকয়েক নির্মাতার কাজ মান ও নন্দনতাত্ত্বিক জায়গায় স্বকীয় থাকলেও, বেশিরভাগ নাটকেরই মান ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে। গল্পের দুর্বলতা, নির্মাণের দুর্বলতা, সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানো, ভাঁড়ামি কিংবা মানহীন একঘেয়ে হালকা হতে থাকে বাংলা নাটক। তখন থেকেই বাংলা নাটকের দর্শক নেই। মান পড়ে গেছে বা কেউ নাটক দেখে না- এমন কথাও শোনা যেত। কিন্তু বাংলা নাটকের দর্শক নেই- একথা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা তা প্রমাণ করলো গত দুই ঈদে প্রচারিত দুই নাটক। এই দুই নাটক ছাড়াও গত দুই ঈদে আরো কিছু ভালো নাটক প্রচারিত হয়েছে। চারদিকে অন্তত বাংলা নাটক নিয়ে আলোচনাটা শুরু হয়েছে পুনরায়। দর্শককে টেলিভিশন সেটের সামনে বসিয়ে রাখতে হলে কি দরকার তা অন্ততপক্ষে নির্মাণসংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারবেন এবার। বুঝতে পারবেন টেলিভিশন কর্তৃপক্ষও।    

অনেকে বলেন যুগ পাল্টেছে। তথ্যের অবাধ যাতায়াত আর প্রযুক্তির উন্নতি মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। ব্যক্তি জীবন থেকে সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও এই পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। মানুষের মূল্যবোধ, চেতনা ও কিছুটা আচার-ব্যবহারেও পরিবর্তন এসেছে। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এইসব পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগছে গণমাধ্যমেও। বিনোদন মাধ্যমেও নতুনত্ব আনার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। সেই চেষ্টা করতে গিয়ে এক সময় পরিবারের সবার সঙ্গে বসে সিনেমা দূরের কথা, নাটকও দেখার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। সবাই মিলে টিভির সামনে বসা হয় না। এমনকি পারিবারিক গল্প হলেও না। এখান থেকে উত্তোরণের চেষ্টাও খুব একটা চোখে পড়েনি এতদিন।

গত ঈদুল ফিতরের তৃতীয় দিন প্রচারিত হয় আদনান আল রাজীবের ‘বিকেল বেলার পাখি’ নাটকটি। চেনা মধ্যবিত্তের গল্প। মধ্যবিত্ত পরিবারের যেকোনো মানুষ এই গল্পের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারবেন। রোজ আমাদের এসবের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। অপছন্দের মাছ, বাবাকে ভয় পাওয়া, দরজায় বাবার বেল শুনে সবাই টিভির সামনে থেকে দৌড় দেওয়া, ভাইবোনের খুঁনসুটি, যেই বাবাকে ভয় পাওয়া; যে বাবাকে অপছন্দ করা; সেই বাবাকে নিয়ে পরিবারের বাইরের কেউ কটু কথা বললে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া। গল্পটা অন্য কারো না। আমার, আমাদের।

আর গেল ঈদুল আজহায় মিজানুর রহমান আরিয়ান নির্মাণ করলেন ‘বড় ছেলে’। এটাও মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প। বাবার রিটায়ারমেন্ট বা রিটায়ারমেন্টের আগে যা বেতন পান, তাতে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার পর দুর্মূল্যের বাজারে সংসার চালাতে বড় কষ্ট হয়। সংসারের বড় ছেলে টিউশনি করে বাবাকে সাহায্য করে। অনেক ভালো ফল করেও চাকরির হয় না। বাবার রিটায়রমেন্ট হয়ে যায়। বড় ছেলের টিউশনির টাকায় সংসার চলে না। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। ঘরে সন্তান নিয়ে ডির্ভোসি ছোট বোন। ডিভোর্সের পর বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকছে মেয়েটা সন্তান নিয়ে। চেষ্টা করছে কিছু একটা করার। ছোট ভাইটা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি সংসার কি। হয়তো তার বড় ভাইই তাকে বুঝতে দেয়নি। বড় ছেলেকে তার ভালোবাসার মানুষ সাধ আর সাধ্যের মধ্যে বিশাল ফারাকটা বুঝতে দেয় না। ছেলেটার জন্য অপেক্ষা করে কখন সে বাদাম নিয়ে আসবে। বাদামই মেয়েটার কাছে প্রবল প্রার্থিত হয়! মানিব্যাগে স্রেফ ১০ টাকার দুটো নোট রেখে বাকিটা বাজার আনতে মাকে দিয়ে দেয় বড় ছেলে। ছোট ভাইয়ের পিকনিকে যাবার আবদার মেটাতে টিউশনি থেকে অগ্রিম টাকা চাওয়া। লোকাল বাসে ঘামে-দুর্গন্ধে প্রতিদিনের অন্তহীন ক্লান্তি। এইতো বড় ছেলের গল্প। নাটকটির ইউটিউব চ্যানেলে বর্তমান ভিউ ৫৭ লাখের ওপরে। বাংলাদেশের আর কোনো নাটক বা টেলিছবির এমন রেকর্ড নেই।

আমাদের চারপাশে প্রতিদিন নানা ঘটনা ঘটছে। গণমাধ্যমে এর উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায় মাঝে মাঝে। উপন্যাস, নাটক বা সিনেমার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। জীবনের প্রতিফলন হতে হবে। দর্শক যখন নাটক দুটি দেখেছে তখন তারা নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পেরেছে। কারণ গল্পটা আমাদের। এই সময়ে এমন ঘটনা হাজার হাজার। নিজের সঙ্গে মিলে যায় এমন কাহিনি হলে কে না দেখবে? নাটক দুটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তার মানে মানুষ এখনো ভালো গল্প হলে, নিজেদের গল্প হলে নাটক দেখে। বিনোদনের পাশাপাশি রূঢ় বাস্তবতার উপস্থাপনে নিজেদের হয়ে কেউ কথা বলছে ভাবতে পারে। আর নির্মাতাদেরও তো প্রকৃত অর্থে এটাই কাজ। চারপাশে কি ঘটছে তা তুলে ধরা। নাটক দুটির নির্মাণ, গল্প বলার ঢং বা নির্মাণসংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে অনেককে সমালোচনা করতে দেখেছি। এটা পজিটিভ দিক। অনেকে এই বলেছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণিটাই এমন। দেশের মেজরিটি পার্সেন্ট মানুষ যদি এই শ্রেণিটা বিলংগ করে তাহলে অস্বীকার করার সুযোগ নাই। তা চলচ্চিত্র হোক আর অর্থনীতির ক্ষেত্রে হোক।

নাটক সিনেমায় এক্সপেরিমেন্টাল কাজের জন্য তো কেউ বাধা দিচ্ছে না। সব ধরনের কাজই হবে। দর্শক যেটা নেওয়ার নেবে। আর দর্শকদের নিজের দর্শক বানানো তো নির্মাতারই কাজ। নির্মাতা কাজের মধ্য দিয়ে নিজস্ব দর্শক তৈরির সুযোগ পায়। এর ভেতরেই ভালো-মন্দের বিচার হয়। ভালো গল্প হলে, পরিবারের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেখতে পারলে বাংলা টেলিভিশন নাটকও হুমড়ি খেয়ে দেখে দর্শক। তাই দর্শক নেই- একথা বলার অন্তত সুযোগ থাকল না ‘বিকেল বেলার পাখি’ ও ‘বড় ছেলে’ নাটকের দর্শকপ্রিয়তার পর। চারপাশের জীবন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি থাকলে নাটক সিনেমা বা উপন্যাস যাই হোক না কেন মানুষ তা গ্রহণ করবেই।

লেখক: সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭/রুহুল/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়