ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নিঃসঙ্গতার কবি আবুল হাসান

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৪ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিঃসঙ্গতার কবি আবুল হাসান

রুহুল আমিন  : ‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!

জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা !

দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন।’ (পাখি হয়ে যায় প্রাণ)

আবুল হাসান। বিচ্ছিন্নতা বোধ ও স্পর্শকাতরতা নিয়ে ষাট দশকে আবুল হাসানের আবির্ভাব। আবুল হাসান স্বদেশ, নিঃসঙ্গ মানুষ ও মানুষের অন্তর্গত বেদনা ও মানুষের সংবেদনশীল সত্তার সাথে একাত্ম হয়েছেন। এক অসীম নিঃসঙ্গতার আবর্তনে যিনি ঘুরে ফিরেছেন সর্বক্ষণ। নিজের নিঃসঙ্গতাকে আত্মবিবরণী আকারে কবিতায় এনেছেন। বেদনাবোধ, প্রেম বিরহ, রাজনৈতিক দোলাচাল, অন্তর্গত নদীর রক্তক্ষরণ, জীবনের এপাশ-ওপাশ সবপাশের বির্বণতা তুলে এনেছেন নিপুণ দক্ষতায়। বলে গেছেন সভ্যতার কঠিন সত্যকে সাবলীল ভঙ্গিতে। যেন সব পুড়েছে যাচ্চে তবু কারো কিছু আসে যায় না। তাই তিনি বলেন, ‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা,/ আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে/আমার মৃত্যুর আগে বোলে যেতে চাই,/সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন/কী লাভ যুদ্ধ কোরে? শত্রুতায় কী লাভ বলুন? (জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন)

কিংবা যাই করেন না, পৃথিবী মানুষের অভাব খাদ্য। মনবাদরদী আবুল হাসান সে কথাও বলেছেন তার কবিতায়, ঐযে নষ্ট গলি, নিশ্চুপ দরোজা

ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা, গণিকারা-

মধ্যরাতে উলঙ্গ শয্যায় ওরা কীসের ভাষায় কথা বলে?

ঐযে কমলা রং কিশোরীরা যাচ্ছে ইশকুলে

আজো ঐ কিশোরীর প্রথম কম্পনে দুটি হাত রাখলে

রক্তে স্রোত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে, শব্দ হয়, শুনি

কিন্তু আমি রক্তের কী মাতৃভাষা এখনও জানিনা!

বেদনার কী মাতৃভাষা এখনো জানিনা !

শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ,

আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা!

১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার বর্নি গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন আবুল হাসান। তার প্রকৃত নাম আবুল হোসেন মিয়া, পরবর্তীতে আবুল হাসান নামে কবি খ্যাতি অর্জন করেন। ডাকনাম ছিল ‘টুকু’। বাবার চাকরির সুবাদে ফরিদপুর থেকে ঢাকা আসেন। আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। আরমানিটোলা স্কুলে পড়ালেখার সময় থেকেই আবুল হাসান নিয়মিত কবিতা লিখতে শুরু করেন।

১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্জন সম্পন্ন করেননি তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই হাসান সাহিত্যচর্চায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। এ সময় তিনি ঢাকার তরুণ কবিদের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে আসেন।

১৯৬৯ সালে তিনি দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ এ সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৭২ সালে ‘গণবাংলা’ পত্রিকায় যোগ দেন। ‘গণবাংলা’-য় সাহিত্য বিভাগে শহীদ কাদরীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ সালে যোগ দেন আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক ‘জনপদ’ পত্রিকায়। ‘জনপদ’ পত্রিকায় তিনি ১৯৭৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত সাহিত্য সম্পাদনা করেন। এই দেড় বছরে ‘জনপদ’ পত্রিকায় আবুল হাসানের অনেক রচনা প্রকাশিত হয়েছে- এর মধ্যে আছে কবিতা, প্রবন্ধ এবং উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধ। এই পত্রিকায় তিনি ‘আপন ছায়া’ এবং ‘খোলাশব্দে কেনাকাটা’ শীর্ষক দুটি উপ-সম্পাদকীয় কলাম লিখতেন। ‘খোলাশব্দে কেনাকাটা’ শীর্ষক কলামটির প্রথম চার সংখ্যা তিনি ‘ভ্রামণিক’ ছদ্মনামে লিখেছেন।

১৯৭৪ সালে সহ-সম্পাদক হিসেবে দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় যোগ দেন। ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় তিনি ‘আড়ালে অন্তরালে’ এবং ‘বৈরী বর্তমান’ শীর্ষক দুটি উপ-সম্পাদকীয় কলাম লিখতেন। ‘ফসলবিলাসী হাওয়ার জন্য কিছু ধান চাই’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ রচনা করে সেই সময় তিনি লেখক হিসেবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

১৯৭০ সালটি আবুল হাসানের জীবনে বিশেষ তাৎপর্যবহ। কারণ ‘শিকারী লোকটা’ শিরোনামে একটি কবিতার জন্য এ সময় তিনি সমগ্র এশিয়াভিত্তিক এক প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে বিশেষ পুরষ্কার লাভ করেন। পরে ওই কবিতাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত সমগ্র পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বশীল কবিদের কবিতা-সঙ্কলনে অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (১৯৭০) শীর্ষক ওই গ্রন্থে তদানীন্তন পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিনিধি আবুল হাসানের কবিতা স্থান পায়।

আবুল হাসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাজা যায় রাজা আসে’ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। রাজা যায় রাজা আসে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর তিনি কবি খ্যাতি পান। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘যে তুমি হরণ করো’ প্রকাশ হয় ১৯৭৪ সালে। আর হাসপাতালের বেডে শুয়ে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথক পালঙ্ক’র পাণ্ডুলিপি তৈরি থেকে প্রুফ দেখা সবটাই করেছেন তিনি। ‘পৃথক পালঙ্ক’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে।

১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর মাত্র আটাশ বছর বয়সে আবুল হাসান মারা যান। মৃত্যুর পর তিনি ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি  পুরস্কার ও ১৯৮২ সালে একুশে পদক লাভ করেন।

মৃত্যুর পর ১৯৮৫ সালে নওরোজ সাহিত্য সংসদ প্রকাশ করে ‘আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা’। মূলত কবি হলেও আবুল হাসান বেশ কিছু ছোটগল্প রচনা করেছেন। মৃত্যুর পনের বছর পর ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় তার নয়টি গল্পের সঙ্কলন ‘আবুল হাসান গল্পসংগ্রহ’।

সাহিত্য জগতে আবুল হাসানের মাত্র দশ বছরের পদচারণা। এই দশ বছরে দুহাত ভরে তিনি সোনা ফলেছেন। কবিতায় ছোট গল্পে তিনি যেন কেবল নিঃসঙ্গতা বিলি করেছেন। কিন্তু সে নিঃঙ্গতা মানব মনকে আড়াল করে নয়, মনের অতল তলের নির্জন স্বাক্ষর রাখতেন সেখানে নির্দ্বিধায়। 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ আগস্ট ২০১৭/রুহুল/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়